ট্রাম্পের ‘মাস্তানি’ থামানোর উপায় কী, আনুগত্য না বয়কট?

তথাকথিত ‘মুক্তি দিবসে’ ট্রাম্প আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ওপর কুঠার চালান। তিনি বিদেশি আমদানির ওপর শাস্তিমূলক শুল্ক চাপিয়ে দেন। যদিও বিশ্বজুড়ে ব্যাপক সমালোচনার পর চীনসহ কয়েকটি দেশ ছাড়া এ পাল্টা শুল্ক তিন মাসের জন্য স্থগিত করেন।ছবি : এএফপি

ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনে যুক্তরাষ্ট্রে চতুর্মুখী অশনিসংকেত বেজে উঠেছে। ফ্যাসিবাদের উত্থান হচ্ছে। শিক্ষা, শিল্প, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, সমাজিক কল্যাণ, মানবিক কল্যাণ ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে। ২৫০ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রে যে জাতীয় অবকাঠামো গড়ে উঠেছিল, তার পুরাটাই আমাদের চোখের সামনে ধসে পড়ছে।

কেউই এটা থামাতে সক্ষম নন বলে মনে হচ্ছে। সে কারণেই প্রতিরোধের ব্যাপারটা এখানে নিরর্থক।

ট্রাম্পের একের পর এক সিদ্ধান্তের মুখে চাক শুমারের মতো ডেমোক্র্যাট নেতারাও অসহায়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সভাপতিরা এবং ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যরা ভয়ে কাঁপছেন। ট্রাম্পের আংটিতে চুমু দেওয়ার জন্য প্রধান আইনি সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সারি বেঁধেছে। প্রযুক্তি খাতের টাইটানরা ভোক্তাদের স্বার্থের কথা চিন্তা না করে ট্রাম্পের কাছে ধরনা দিচ্ছেন।

বিদেশি শিক্ষার্থীদের আটক করা হচ্ছে, বন্দিশিবিরে রাখা হচ্ছে। ফেডারেল বিচার বিভাগও, এমনকি ট্রাম্প প্রশাসনের বিরুদ্ধে যখন কোনো রায় দিচ্ছে, তখনো বাস্তব কোনো প্রতিরোধের উপায় বলতে পারছে না।

মার্কিনদের মধ্যে অনেকেই ট্রাম্পের এই সব কর্মকাণ্ডকে সমর্থন দিচ্ছেন। তাঁর অন্ধকারের রাজপুত্র ইলন মাস্কের কৌশলের প্রতি মার্কিন নাগরিকেরা ব্যাপক বিরূপ হলেও, ট্রাম্পের প্রতি সমর্থন আগের জায়গায়ই রয়েছে। ৫৪ শতাংশ মার্কিন মনে করেন, ট্রাম্প তাঁর আগের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের চেয়ে ভালো করছেন।

দীর্ঘদিন ধরে ঘনিষ্ঠ মিত্র, এমন সব দেশের সঙ্গে সম্পর্ক ধ্বংস করছেন ট্রাম্প। গ্রিনল্যান্ড ও কানাডায় আক্রমণের হুমকি দিয়েছেন তিনি। পানামা থেকে বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জাহাজ চলাচলের পথের নিয়ন্ত্রণ দখলে নেওয়ার হুমকিও দিয়েছেন তিনি।

ঐতিহাসিক কূটনৈতিক চুক্তিগুলো তিনি জানালার বাইরে ছুড়ে ফেলেছেন। যেসব গবেষক, শিক্ষাবিদ ও সংস্থা বৈচিত্র্য, সমতা ও অন্তর্ভুক্তিমূলক কর্মসূচি পরিচালনা করে, তাদের হুমকি দিচ্ছেন।

এরপর এল শুল্ক ঝড়। তথাকথিত ‘মুক্তি দিবসে’ ট্রাম্প আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ওপর কুঠার চালান। তিনি বিদেশি আমদানির ওপর শাস্তিমূলক শুল্ক চাপিয়ে দেন। যদিও বিশ্বজুড়ে ব্যাপক সমালোচনার পর চীনসহ কয়েকটি দেশ ছাড়া এ পাল্টা শুল্ক তিন মাসের জন্য স্থগিত করেন।

তবে ট্রাম্পের অভিষেকের পর থেকে এ পর্যন্ত পুঁজিবাজারগুলো ১১ ট্রিলিয়ন ডলার খুইয়েছে। এর অর্ধেকটাই শুল্ক আরোপের ঘোষণার পর অল্প কয়েক দিনে। ব্যবসায়ীরা এটাকে ‘হত্যাকাণ্ড’ ও ‘রক্তস্নান’ বলছেন।

ইউরোপের ভাগ্যের জন্য এসব প্রশ্নের উত্তর খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেটা করতে ব্যর্থ হলে রাশিয়ার প্রভাববলয়ে থাকা ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ বিপদের মুখে পড়বে। ট্রাম্পের আমলে যেমন একই ধরনের বিপদের মুখে পড়েছে গ্রিনল্যান্ড, মেক্সিকো ও কানাডা।

যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানুফ্যাকচারিং বা পণ্য উৎপাদন খাতের ভিত্তি যাতে একলাফে বাড়ে, তার জন্য একটা নিরর্থক প্রচেষ্টা। এই অর্থনৈতিক নীতি বিদেশি ও দেশি কোম্পানিকে এবং সেই সঙ্গে গোটা অর্থনীতিকে তাদের নতজানু করবে। শিল্পকারখানাগুলো সংকুচিত হবে অথবা বন্ধ হয়ে যাবে।

সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় পড়বে শ্রমিকশ্রেণি। তারা যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য দেশগুলোয় কাজ হারাবে। ট্রাম্প প্রশাসন গত মাসে ২ লাখ ৭৫ হাজার লোককে চাকরি থেকে বরখাস্ত করে। কোভিড মহামারির সময়ও এত লোক কাজ হারাননি। ধনী অভিজাত ব্যক্তিরা ও ট্রাম্পের মিত্ররা এই ঝড় এড়াতে সক্ষম হবেন। প্রকৃতপক্ষে, ট্রাম্পের নতুন করনীতি তাঁদের জন্য বড় পুরস্কার নিয়ে আসছে।

ট্রাম্প সামরিক মিত্রদেরও পরিত্যাগ করেছেন। কয়েক প্রজন্ম ধরে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে সামরিক জোট বিশ্বকে নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা দিয়েছে। রাশিয়ার হুমকির সামনে ইউরোপকে নিঃসঙ্গ ফেলে চলে গেছেন ট্রাম্প।

ফেডারেল ক্ষমতার জোরে যুক্তরাষ্ট্রের দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর মাস্তানি করা যতটা সহজ, বিদেশি রাষ্ট্রের ওপর সেটা করা এত সহজ নয়। বাকি বিশ্বকে অবশ্যই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। মাস্তানেরা ভয় দেখিয়ে কিংবা জোর করে তাদের লক্ষ্য অর্জন করে।

কিছু দেশ মনে করছে, সবচেয়ে ভালো পথ হলো, যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপর আমদানি শুল্ক তুলে দেওয়া এবং চুক্তিতে যাওয়া। তারা ট্রাম্পের কাছে করুণা ভিক্ষা করতে চাইছে। কিন্তু ট্রাম্পকে বিশ্বাস করা যাবে কিংবা তাঁর সঙ্গে চুক্তি করা যাবে, সেটা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।

আরও পড়ুন

এই মাস্তানি রুখে দেওয়ার সবচেয়ে সেরা অস্ত্র হচ্ছে সংহতি। একমাত্র সংগঠিত ও সমন্বিত প্রতিরোধই সেটা পারে। জোচ্চোরকে এটা দেখানো জরুরি যে একসঙ্গে সবার শক্তি তাঁর চেয়ে বেশি।

তবে এটা একটা জটিল প্রক্রিয়া। ইউরোপ কখনো ঐক্যবদ্ধ কণ্ঠে কথা বলেনি।

ইউরোপ কখনোই তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র ও বৈশ্বিক পরাশক্তি কাছ থেকে বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়নি। পরস্পরের সঙ্গে বিরোধ থাকা দেশগুলো কি নিজেদের অভিন্ন স্বার্থে একমত হতে পারে না?

ইউরোপের ভাগ্যের জন্য এসব প্রশ্নের উত্তর খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেটা করতে ব্যর্থ হলে রাশিয়ার প্রভাববলয়ে থাকা ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ বিপদের মুখে পড়বে। ট্রাম্পের আমলে যেমন একই ধরনের বিপদের মুখে পড়েছে গ্রিনল্যান্ড, মেক্সিকো ও কানাডা।

হিটলার ইউরোপ জয় করে ফ্যাসিবাদের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছিলেন। আজ আবার ইউরোপের ঘাড়ের ওপর ফ্যাসিবাদ নিশ্বাস ফেলছে। আবার সেটা ঘটলে কী হবে?

যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ভরসা করা ছেড়ে দিন। ট্রাম্পকে তাঁর অপরাধের মূল্য চুকাতে দিন। মাস্তানিকে জিততে দেওয়া যাবে না।

  • রিচার্ড সিলভারস্টেইন, লেখক
    মিডলইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত