জেলা পরিষদ ভারতীয় উপমহাদেশের অত্যন্ত শক্তিধর এবং ঐতিহ্যবাহী স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, যা গ্রামীণ স্থানীয় সরকারব্যবস্থার সর্বোচ্চ স্তর হিসেবে স্বীকৃত। ১৮৮২ সালে লর্ড রিপনের স্থানীয় সরকারবিষয়ক সিদ্ধান্তের সূত্র ধরে ১৮৮৫-১৮৮৬ সাল থেকে অবিভক্ত ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে জেলা পরিষদ গঠিত হতে থাকে এবং নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ১৯২০ সাল থেকে এ পরিষদসমূহে নির্বাচন ও প্রতিনিধিত্বশীলতার বিকাশ ঘটে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্ব পর্যন্ত এ দেশে জেলা পরিষদব্যবস্থা বহাল থাকে।
স্বাধীনতার পর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে পূর্ব প্রচলিত স্থানীয় সরকারব্যবস্থার সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও নির্দেশনার অধীনে এর ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হয় এবং স্থানীয় শাসন ও সরকারব্যবস্থা হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি লাভ করে। বিশেষত, ১৯৭২-এর সংবিধানের ৯, ১১, ৫৯, ৬০ ও ১৫২ ধারাসমূহে ‘স্থানীয় সরকার’ বা ‘স্থানীয় শাসনসংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান’-এর রূপ, চরিত্র, আদল, কার্যক্রম, প্রশাসন ও অর্থায়ন বিষয়ে ব্যাপক নির্দেশনা দেওয়া হয়। স্বাধীনতার এই ৪৫ বছরে (২০১৬) সরকার ও সংবিধানে বহু ধরনের পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। স্বাধীনতার পর গ্রামীণ স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে বহু স্তরীয় একটি কাঠামো হিসেবে নীতিগতভাবে মেনে নেওয়া হয় এবং নগরের ক্ষেত্রে এক স্তরীয় পৌরসভাকাঠামো প্রতিষ্ঠিত হয়। তিন স্তরীয় গ্রামীণ স্থানীয় সরকার ও শাসনব্যবস্থায় ইউনিয়ন পরিষদের ধারাবাহিকতা নিরবচ্ছিন্নভাবে রক্ষিত হলেও অন্য দুটি স্তর তথা থানা ও জেলা পর্যায় নিয়ে নানা দ্বিধাদ্বন্দ্ব, সংশয় ও সিদ্ধান্তহীনতা কাজ করতে থাকে। ফলে দীর্ঘদিন যাবৎ ওই দুই স্তরে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বিকাশ অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে।
১৯৮১ সালের পরের ১০ বছর থানা (বর্তমান উপজেলা) পর্যায়ে পরিষদ গঠিত হলেও তা পুনরায় ১৮ বছর (১৯৯১-২০০৯) স্থগিত থাকে। জেলার ক্ষেত্রে সেটি আরও বেদনাদায়ক। জেলা নিয়ে স্বাধীনতার পর প্রতিটি সরকারের ভেতরে একধরনের অস্থিরতা ও উত্তেজনা কাজ করেছে বলে প্রতীয়মান। জনপ্রতিনিধি ও স্থায়ী সিভিল সার্ভিস নিয়ন্ত্রিত কাঠামোর মেলবন্ধন ও পারস্পরিক সম্পর্কের পুনর্গঠনের রূপরেখা নিয়ে অস্পষ্টতা ও দ্বিধাদ্বন্দ্বের কোনো অবসান হয়নি। একদিকে জেলা ও উপজেলায় মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরসমূহের বিস্তৃতি ঘটেছে, অন্যদিকে স্থানীয়ভাবে গণতান্ত্রিক প্রশাসন সৃষ্টির সাংবিধানিক অঙ্গীকার অধরা থেকে গেছে। বর্তমানে উপজেলা পর্যায়ের সরকারি দপ্তরের সংখ্যা ২৪ ও কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা পেনেরা শয়ের মতো। জেলায় ডেপুটি কমিশনারের কার্যালয় ছাড়া আরও ৪৩টি দপ্তর রয়েছে।
উপজেলা পরিষদ ১৯৯৭ সালের স্থানীয় সরকার (উপজেলা পরিষদ) আইন বলে ২০০৯ সালে গঠিত হয়েছে এবং উপজেলা পর্যায়ে ১৭টি দপ্তর পরিষদের আইন অনুযায়ী হস্তান্তরিত। কিন্তু এখানে নির্বাচিত পরিষদ, হস্তান্তরিত ১৭টি দপ্তর ও অহস্তান্তরিত ৭-৮টি দপ্তর মিলে সমন্বিত কোনো একীভূত প্রশাসন ও সেবাকাঠামো এখনো (২০১৬) গড়ে ওঠেনি। জেলায় দীর্ঘদিন নির্বাচিত পরিষদ অনুপস্থিত। কিন্তু জেলা পরিষদ ভবন, কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং নিয়মিত সরকারি বাজেট বরাদ্দের ব্যবস্থা বহাল আছে। প্রতিটি জেলা পরিষদের জেলাব্যাপী অনেক স্থাবর-অস্থাবর সহায়সম্পদ রয়েছে এবং তা জেলা প্রশাসন, মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগ এবং জেলার সাংসদদের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়ে আসছে।
স্থানীয় সরকার (জেলা পরিষদ) আইন ২০০০-এর অধীনে ধারা ৮০(২) অনুসরণ করে ২০১১ সালে জেলা পরিষদে সরকারি কর্মচারীদের বাইরে থেকে ‘রাজনৈতিক প্রশাসক’ নিয়োজিত হন। এমনকি ২০১১ সালে রাজনৈতিক প্রশাসক নিয়োগের পরও বড় কোনো পরিবর্তন হয়নি। প্রশাসক–নিয়ন্ত্রিত জেলা পরিষদ ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে পাঁচ বছর পূর্ণ করতে যাচ্ছে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হয়েছে, আশা করা যায়, ডিসেম্বর ২০১৬ সালের মধ্যে দেশের সমতলভূমির ৬১টি জেলা পরিষদে ২০০০ সালের জেলা পরিষদ আইনের অধীনে নির্বাচন হবে। নির্বাচনপদ্ধতি বিতর্কিত হলেও এ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত জেলা পরিষদই হবে দেশের প্রথম নির্বাচিত জেলা পরিষদ। এ জেলা পরিষদসমূহে একজন চেয়ারম্যান, ১৫ জন সাধারণ আসনের সদস্য এবং ৫ জন সংরক্ষিত আসনের নারী সদস্যসহ সর্বমোট ২১ জন প্রতিনিধি নিয়ে এ ব্যবস্থা কার্যকর হতে যাচ্ছে। যেহেতু আসন্ন নির্বাচন ঘিরে সব আলোচনা, তাই হয়তো নির্বাচন ছাড়া আরও গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয় ঢাকা পড়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে জেলা পরিষদ যেহেতু গত ৪৫ বছর সুপ্ত বা লুপ্ত অবস্থায় ছিল, তাই বর্তমান প্রজন্মের কাছে জেলা পরিষদের বাস্তব চিত্র বা ধারণা নেই। তাই সাধারণ মানুষ আপাতত এ প্রতিষ্ঠানটি নিয়ে খুব বেশি হয়তো ভাবছে না। তা ছাড়া সাধারণ মানুষ যেহেতু ভোট দিচ্ছে না, তার ফলেও তাদের কাছে বিষয়টি এখনো অপরিচিত ও ধোঁয়াশায় আচ্ছন্ন। কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে যতই দিন যাবে এ প্রতিষ্ঠানটি ধীরে ধীরে স্থানীয়ভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।
>বাংলাদেশে তিন স্তরীয় কাঠামো এত দিন কার্যকর ছিল না। ফলে আন্তস্তরীয় সহযোগিতা ও সমন্বয়ের ধারণা প্রয়োগের অবকাশ ছিল না। জেলা পরিষদ নির্বাচনের পর নবনির্বাচিত পরিষদ কার্যক্রম শুরু করলে এসব বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠবে
ভারতে সংবিধানের ৭৩ ও ৭৪তম সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৯৩ সালের পর থেকে প্রতিটি অঙ্গরাজ্যে তিন স্তরীয় পঞ্চায়েত–ব্যবস্থা তথা গ্রাম পর্যায়ে গ্রাম পঞ্চায়েত, ব্লক পর্যায়ে পঞ্চায়েত সমিতি বা মণ্ডল পঞ্চায়েত এবং জেলা পর্যায়ে জেলা পরিষদ বাধ্যতামূলকভাবে গঠিত হয়েছে। প্রতিটি স্তরের কার্যপরিধি সুনির্দিষ্ট। গ্রামীণ স্থানীয় সরকারের এ তিন স্তরকে সংবিধানের ভাষায় বলা হয় ‘পঞ্চায়েতি রাজব্যবস্থা’। একটি একক আইন দ্বারা তিনটি স্তরই কাজ করে। তিনটি স্তরেই এক দিনে একই তফসিলে নির্বাচন হয়। একসঙ্গে কার্যকাল শুরু ও শেষ হয়। তাতে তিন স্তরের মধ্যে অর্থ ও পরিকল্পনার সহযোগিতা ও সমন্বয় সম্ভব হয়।
বাংলাদেশে তিন স্তরীয় কাঠামো এত দিন কার্যকর ছিল না। ফলে আন্তস্তরীয় সহযোগিতা ও সমন্বয়ের ধারণা প্রয়োগের অবকাশ ছিল না। জেলা পরিষদ নির্বাচনের পর নবনির্বাচিত পরিষদ কার্যক্রম শুরু করলে এসব বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠবে। ভবিষ্যতে সরকার এবং সব রাজনৈতিক দল আশা করি স্থানীয় সরকার পুনর্গঠনের বিষয়ে আরও গঠনমূলক ও বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করবে। এত দিন যাবৎ যে সনাতনী রাজনীতি, তা ছিল শুধু কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতাকেন্দ্রিক। কেন্দ্রের বাইরে স্থানীয় রাজনীতিতে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের রাজনীতি ও ক্ষমতাবলয়ের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণকে গুরুত্বসহকারে দেখত না। গত এক দশকে রাজনৈতিক দলগুলোর সে সনাতনী ধারণায় পরিবর্তন এসেছে। এখন অন্তত রাজনীতি করার জন্য হলেও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে সমাদৃত হচ্ছে। এভাবে স্থানীয় নেতৃত্ব বিকশিত হলে নিচ থেকে বিকেন্দ্রীকরণ আন্দোলন জোরদার হবে।
নির্বাচনের পর সরকারকে জেলা পরিষদ কার্যকর করার ক্ষেত্রে অনেক আইনি পদক্ষেপ নিতে হবে। বিশেষত, জেলার উন্নয়ন সমন্বয় এবং জেলার সামগ্রিক সরকারি সেবাব্যবস্থার গতিশীলতা আনতে জেলা পরিষদের ভূমিকাকে জোরদার করার লক্ষ্যে সুচিন্তিত এসব পদক্ষেপ যাতে কাজে লাগে, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
প্রফেসর তোফায়েল আহমেদ: সুশাসন ও স্থানীয় সরকারবিষয়ক গবেষক, লেখক ও উন্নয়নকর্মী।