টিএসসিতে সুরের আসরে অসুরেরা হামলা করেছে। তার জবাবে কাওয়ালি গানে গানে মানুষেরা ফেসবুক ভাসিয়ে দিচ্ছে। সংগীতকে কখনো পরাজিত করা যায় না। পাকিস্তান আমলে রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ করার চেষ্টায় লাভ হয়েছিল রবীন্দ্রসংগীতের ভক্তদেরই। অসুরদের পরাজিত করেই সুর টিকে থেকেছে। মায়ের সন্তান মাঠেঘাটে ঘুরে বেড়াবে, কিন্তু যেই তাকে মারার হুমকি আসবে, অমনি মা সেই সন্তানকে জানপ্রাণ দিয়ে আগলে রাখা শুরু করবে। সংস্কৃতি আক্রান্ত হলে তার শক্তি বরং আরও বেড়ে যায়। তাই কাওয়ালিকে তরুণদের মনপিঞ্জিরায় সুপ্রতিষ্ঠিত করে দেওয়ার কৃতিত্ব অবশ্যই ছাত্রলীগের।
ক্ষণজন্মা শিল্পী পাবলো পিকাসোর আঁকা ‘গুয়ের্নিকা’ নাৎসিদের নজরে আসার পর প্রতিবাদের সেই তীব্র চিত্র দেখে এক নাজি সেনা অফিসার জিজ্ঞেস করলেন, ‘এটা কে করেছে’? পিকাসো ঘুরিয়ে উত্তর দিলেন, ‘তোমরা করেছ’। টিএসসির ঘটনার পরে বিভিন্ন জেলায় কাওয়ালির আসরের ঘোষণা আসছে। আজ আবার টিএসসিতে হবে প্রতিবাদী কাওয়ালির জমায়েত। অনেক বাড়িতে কাওয়ালি বাজতে শুনছি। বিষয়টা আর গানে আটকে নেই, কাওয়ালি হয়ে উঠেছে জুলুমের বিরুদ্ধে এক সাংস্কৃতিক নিশান। কে তা করে তুলল? পিকাসোর মতো করে উত্তর আসবে, ‘তোমরা করে দিয়েছ’।
দানবেরাই সংগীতকে ভয় করে। আর সংগীত দূর করে মানুষের ভয়। কিন্তু যারা চায় ভয়ের লোমশ থাবার তলে দেশ থরথর করে কাঁপুক, তারা মর্মের গানকে ভয় পাবেই। কাওয়ালি মরমি সংগীত। যারা বাউলদের চুল কেটে দেয়, যারা রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ করে আর যারা কাওয়ালির আসরে হামলা করে, শিল্পীর টুঁটি চেপে ধরে; তাদের মধ্যে আসলে কোনো তফাত নেই। কারণ, সংগীত মানুষকে এক করে, তাদের ভেতর থেকে জাগায়, তাদের সুন্দরের সপক্ষে দাঁড় করায়। দলীয় পতাকায় ‘প্রগতি’ লেখা থাকলেই যে কেউ প্রগতিশীল হয়ে যায় না, তা কী চমৎকারভাবেই না প্রমাণিত হয়ে গেল।
তালেবান গানকে ভয় পায়, পাকিস্তানে হত্যা করা হয়েছে খ্যাতনামা এক কাওয়ালিশিল্পীকে। আর বাংলাদেশে শিল্পীদের টুঁটি চিপে গানের জলসা তছনছ করল কারা?
একটি টিভির অনুষ্ঠানে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক প্রশ্ন তুলেছেন, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে একটি মৌলবাদী সংগঠন ফায়দা হাসিল করতে চেয়েছিল কি না…জঙ্গিবাদে জড়িত ছাত্রসংগঠনের কর্মীরা এখানে জড়িত ছিল কি না ইত্যাদি। অথচ যত ফায়দা গানের জলসাটি সরবরাহ করতে পারত, হামলা চালিয়ে তাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেওয়া হলো। তালেবান গানকে ভয় পায়, পাকিস্তানে হত্যা করা হয়েছে খ্যাতনামা এক কাওয়ালিশিল্পীকে। আর বাংলাদেশে শিল্পীদের টুঁটি চিপে গানের জলসা তছনছ করল কারা? ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক অনুষ্ঠান আয়োজনের পেছনে মৌলবাদীদের হাত দেখতে পাচ্ছেন। কিন্তু মানুষ দেখল, মৌলবাদীরা যা করতে চায়, তা করে দিল প্রগতিবাদের দাবিদারেরা। এই প্রগতির নামধারী সংগঠনের মাইক থেকে জাতীয় দিবসে দেদার নিম্ন রুচির হিন্দি গান বাজে। সেসব শুনে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের কথা ভেবে মাথা হেঁট হয়ে আসে।
কাওয়ালির ঐতিহ্য অনেক পুরোনো। অথচ তাকে ঠেলে পুরান ঢাকায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেই পুরান ঢাকার পিয়ারু সরদার ভাষা আন্দোলনের একজন নেতা ছিলেন। ঢাকা ছিল গানের আর বাগানের শহর। সেই শহরে শাহবাগ, পরীবাগ, সেগুনবাগিচা, সবুজবাগ, আরামবাগ, লালবাগ, গোপীবাগ, রাজারবাগ, মালিবাগ, সোবহানবাগ—এসব ছিল। চল্লিশের দশকেও গানে ভরপুর ছিল ঢাকা। দীপেন্দ্রেনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখায় পাচ্ছি, বুদ্ধদেব বসুর লেখায় পাচ্ছি। বাগিচা থাকলে গানও থাকবে। চল্লিশের দশকের ঢাকা ছিল বাগান আর হারমোনিয়ামের শহর। সেখানে, টিএসসিতে গানের জলসায় হামলা করে বোঝানো হয়েছে, ঢাকার পুরোনো ঐতিহ্যকে ফিরতে দেওয়া হবে না! পুরান ঢাকায় ঢুকিয়ে দেওয়া কাওয়ালিকে সংস্কৃতির মূল মঞ্চে আসতে হলে বাধা তো আসবেই। ভাষা আন্দোলনে শামিল কুট্টিরা কাওয়ালি ভালোবাসে। এই হামলা তাদের ওপরও বর্তায়। ঢাকায় ভাটিয়ালিও নেই, ভাওয়াইয়া নেই, জারি-সারি নেই, যাত্রাগান, মাইজভান্ডারি নেই। খালি মাইক ফাটানো চিৎকার আর আতশবাজির হিন্দি-লেডি গাগা এখানে চলবে। আর কিচ্ছু না।
ওই টিভি অনুষ্ঠানের উপস্থাপক বললেন, মাইজভান্ডারি কি কাওয়ালি? না, তা কাওয়ালি নয়, তবে উভয় ধারাতেই সুফিধারার মরমি ভাবদর্শন রয়েছে। টিএসসির অনুষ্ঠানে মাইজভান্ডারির গানও হওয়ার কথা ছিল। মাইজভান্ডারির গান নিয়ে অসাধারণ গবেষণা গ্রন্থ লিখেছেন জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের প্রধান ও বিশিষ্ট বাংলাপ্রেমী অধ্যাপক হ্যান্স হার্ডার। তাঁর ‘সুফিজম অ্যান্ড সেইন্ট ভেনেরেশন ইন কনটেমপোরারি বাংলাদেশ: দ্য মাইজভান্ডারিজ অব চিটাগাং’ বইটিতে মাইজভান্ডারি ঐতিহ্যকে নিম্নবর্গীয় মানুষের আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধির চর্চা হিসেবে দেখেছেন।
কাওয়ালির পক্ষে দাঁড়াতে গেলে তাকে ইসলামি বলা কিংবা বাঙালি সংস্কৃতির অংশ বলারও দরকার নাই। টিএসসিতে মান্দি-গারো-চাকমাদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়ে থাকে, সেগুলি কি বাঙালি সংস্কৃতির অংশ? সংস্কৃতির বিভিন্ন ধারা থাকবে, সেসব মিলিয়েই বাংলাদেশ ও তার সংস্কৃতি।
এ দেশের জনসংস্কৃতিতে যে উদার মানবতাবাদী ভাব অজস্র ধারায় বয়ে চলেছে, তাঁর গবেষণা সেই সত্য তুলে ধরে। কাওয়ালিও চাপা পড়া মানবতাবাদের কথা বলে। এটা উদার অসাম্প্রদায়িক মানুষের আধ্যাত্মিক আকুতির গান। কাওয়ালির পক্ষে দাঁড়াতে গেলে তাকে ইসলামি বলা কিংবা বাঙালি সংস্কৃতির অংশ বলারও দরকার নাই। টিএসসিতে মান্দি-গারো-চাকমাদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়ে থাকে, সেগুলি কি বাঙালি সংস্কৃতির অংশ? সংস্কৃতির বিভিন্ন ধারা থাকবে, সেসব মিলিয়েই বাংলাদেশ ও তার সংস্কৃতি। এই দেশ কখনো একজাতীয় বা এক ধর্মীয় ছিল না। তাই যদি ধরেও নিই, কাওয়ালি বাঙালি নয়, তাতে অসুবিধা কী? সংস্কৃতিকে জাতীয়তাবাদী খোপে আটকে রাখার চিন্তাটাই ফ্যাসিবাদী।
প্রত্যেক মানুষের মনে এক আধ্যাত্মিক সরোবর রয়েছে। দুনিয়াদারির বারো ভেজালে সেই সরোবর যখন দূষিত হয়ে যায়, তখন সংগীত তাকে পরিশুদ্ধ করে, তাতে ভালোবাসার ঢেউ জাগায়। বাউলের গানে যে সহজ মানুষের সাধনা, রবীন্দ্রসংগীতে যে অসীমের প্রতি টান, কাওয়ালিতে যে আত্মার কাঁদন শোনা যায়, তা বাংলাদেশের সংস্কৃতির অমূল্য সম্পদ। কী করে কেউ এসবের বিরোধী হতে পারে?
বন্ধু সংগীতজ্ঞ সাইম রানা চমৎকারভাবে বলেছেন, ‘কাওয়ালিসংগীত পুরান ঢাকার একটি গৌরবময় ঐতিহ্য। মধ্যযুগে এই সংগীতের মাধ্যমে উত্তর ভারতীয় সংগীতের এক মহাজাগরণ সৃষ্টি হয়েছিল। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের মধ্যে খেয়ালের যে সাংগীতিক বিস্তার, এর সঙ্গে কাওয়ালির সম্বন্ধ নিবিড়। এর সূচনা হয়েছিল তুর্কি চারণ কবিদের মাধ্যমে। ভারতে খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি, নিজামউদ্দিন আউলিয়া, ওস্তাদ আমির খসরু, সেলিম চিশতি, বদরুদ্দিন রিয়াজ, শাহনেওয়াজ প্রমুখ কাওয়ালিসংগীতের বিকাশ ঘটান। বর্তমানকালের নুসরাত ফতে আলী খান, আবিদা পারভিন, বাংলাদেশের রুনা লায়লার নামও সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।’
এই ঐতিহ্যের ওপর আঘাত হেনে নিষিদ্ধবাদীদের আরও মদদ দেওয়া হলো। অথচ ১৯৪৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দিল্লি ভ্রমণের এক অভিজ্ঞতায় বলেন, ‘খাজাবাবার দরগার পাশে বসে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান হচ্ছে। যদিও বুঝতাম না ভালো করে, তবুও মনে হতো আরও শুনি। আমরা দরগাহ জিয়ারত করলাম, বাইরে এসে গানের আসরে বসলাম। অনেকক্ষণ গান শুনলাম, আমরা যাকে ‘কাওয়ালি’ বলি। কিছু কিছু টাকা আমরা সকলেই কাওয়ালকে দিলাম। ইচ্ছা হয় না উঠে আসি। তবুও আসতে হবে।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা ৫৬)
তরুণদের জমায়েতকে তারা তো ভয় পাবেই, যারা জানে যে তারা জনপ্রিয় নয়, ন্যায়ের পক্ষেও নয়। যদি ছাত্রলীগ কনসার্ট করতে পারে, তাহলে অন্যেরা কাওয়ালির জলসা করতে পারবে না কেন?
ওরা আসলে ভয় পেয়েছে এমন এক জমায়েতকে, যারা সন্ত্রাসী শক্তির নিষেধ উপেক্ষা করে জড়ো হয়েছিল। তরুণদের জমায়েতকে তারা তো ভয় পাবেই, যারা জানে যে তারা জনপ্রিয় নয়, ন্যায়ের পক্ষেও নয়। যদি ছাত্রলীগ কনসার্ট করতে পারে, তাহলে অন্যেরা কাওয়ালির জলসা করতে পারবে না কেন? পারবে না, কারণ কাওয়ালির জলসা আয়োজকদের হাতে ক্ষমতাসীনদের অনুগ্রহসূচক কোনো সনদ ছিল না। তাদের ছাড়া আর কারও জমায়েত তারা হতে দেবে না। কিন্তু কেন দেবে না? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কি একটি গোষ্ঠীর জমিদারি আঙিনা? প্রশাসন ও প্রক্টররা কী করেছেন? কর্তৃপক্ষ দায়ী নয় বললে হবে না, দায়িত্বে যেহেতু রয়েছেন, সেহেতু এই সন্ত্রাসের দায় আপনাদের ওপরও বর্তাবে।
টিএসসিতে রয়েছে সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্য, রয়েছে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের শহীদ ডা. মিলনের স্মৃতিমঞ্চ, রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্বোপার্জিত স্বাধীনতা ভাস্কর্য, অদূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে অপরাজেয় বাংলা। অথচ এই অঞ্চলে ছাত্রছাত্রীদের ওপর হামলা ও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। অথচ এদিকে উপাচার্যের বাড়ি, ওদিকে শাহবাগ থানা। টিএসসিকে আর কত লাঞ্ছিত করা হবে? শুধু টিএসসি নয়, ঢাকা কার শহর, কার রাজধানী, সেই প্রশ্নও মনে জাগছে।
ফারুক ওয়াসিফ লেখক ও সাংবাদিক
[email protected]