দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে অগ্রসর অর্থনীতির দেশ শ্রীলঙ্কা, যেখানে মাথাপিছু জিডিপি চার হাজার ডলারের বেশি। শ্রীলঙ্কার ৯৫ শতাংশ মানুষ শিক্ষিত, তাদের শিক্ষাব্যবস্থা দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে গণমুখী। তাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থাও দক্ষিণ এশিয়ার সেরা। শ্রীলঙ্কান তামিল টাইগারদের ওপর সরকারি বাহিনীর বিজয়ের মাধ্যমে ১৯৮৩ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত চলা গৃহযুদ্ধের সমাপ্তির পর বিশ্বের কাছে একুশ শতকের সফল অর্থনৈতিক উন্নয়নের মডেল হয়ে ওঠার সম্ভাবনা ধারণ করছিল দেশটি। কিন্তু ওই গৃহযুদ্ধে একতরফা বিজয় অর্জনের সময় প্রায় ৪০ হাজার বেসামরিক তামিল জনগণকে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়েছে বলে জাতিসংঘের তদন্ত কমিটি অভিযোগ উত্থাপন করে।
ফলে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং প্রতীচ্যের বেশির ভাগ দেশ শ্রীলঙ্কাকে ‘অস্পৃশ্য রাষ্ট্রের’ অবস্থানে নিয়ে যায়। গৃহযুদ্ধে বিজয় এসেছিল বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এবং তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপক্ষের শাসনামলে, যিনি বর্তমান প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের বড় ভাই। মাঝখানে এক মেয়াদের জন্য মাহিন্দা রাজাপক্ষে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মাইথ্রিপালা সিরিসেনার কাছে হেরে যাওয়ায় বিরোধী দলের নেতার আসনে বসেছিলেন। কিন্তু ওই সময়ে শ্রীলঙ্কার ভোটের রাজনীতিকে দলীয় জোরজবরদস্তির প্রতিযোগিতায় পর্যবসিত করে রাজাপক্ষে পরিবার পরবর্তী নির্বাচনে আবারও জয়লাভ করে ক্ষমতায় ফিরে আসে।
এক বছর ধরে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি কঠিন সংকটে ক্রমে তলিয়ে যাচ্ছে। দেশটিতে আমদানি করা পণ্যের ক্রমবর্ধমান ঘাটতি জনজীবনকে পর্যুদস্ত করে দিচ্ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর সংঘবদ্ধ মজুতদারি এতই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যে অনেক নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহে সৃষ্ট কৃত্রিম সংকট তদারকের জন্য একজন মিলিটারি জেনারেলের নেতৃত্বে ‘কন্ট্রোলার অব সিভিল সাপ্লাইজ’ নামের কঠোর নজরদারি সংস্থা গড়ে তুলেও অবস্থা সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। গাড়ি, স্যানিটারি আইটেম, কিছু ইলেকট্রনিক পণ্যের আমদানি সরাসরি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি শ্রীলঙ্কার সরকার দেশে ‘অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থা’ ঘোষণা করেছে। কারণ, দেশটি এখন ‘অর্থনৈতিক ধস’-এর সম্মুখীন। বেশ কয়েক মাস ধরে ভয়ংকর খাদ্যসংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশটি। অথচ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ একেবারে তলানিতে পৌঁছে যাওয়ায় বিদেশ থেকে খাদ্যদ্রব্য আমদানি করে সংকট মোকাবিলার সামর্থ্য এখন তাদের নেই বললেই চলে।
অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতির হার দিন দিন বাড়ছে। শ্রীলঙ্কান রুপির বৈদেশিক মান কিছুদিন আগেও ছিল ১ ডলারে ১৯০ রুপি, গত এক মাসে সেটা বেড়ে ২৩০ রুপিতে পৌঁছে গেছে। বর্তমানে দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার থেকে ২ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ওঠানামা করছে, অথচ আগামী এক বছরের মধ্যে শ্রীলঙ্কাকে ৭ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের ঋণ সুদাসলে পরিশোধ করতেই হবে। এর মানে, শ্রীলঙ্কা নিজেকে ‘আর্থিক দেউলিয়া’ ঘোষণার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে।
দেশটির এ দেউলিয়াত্ব ডেকে এনেছে করোনা মহামারি, কয়েক বছর ধরে উল্টোপাল্টা নানা প্রকল্পের জন্য বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের হিড়িক এবং রাতারাতি কৃষি খাতে ‘অর্গানিক ফার্মিং’ চালুর জন্য প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের একটি হঠকারী সিদ্ধান্ত। গোতাবায়া দেশের কৃষিবিদ ও বিজ্ঞানীদের সঙ্গে সলাপরামর্শ না করেই সম্পূর্ণ নিজের খামখেয়ালি সিদ্ধান্তে দেশের কৃষিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। কিন্তু মতাদর্শগত অবস্থান থেকে ‘অর্গানিক ফার্মিং’ পদ্ধতি চালুর ঘোষণা দেওয়া এক কথা, আর ধাপে ধাপে পরিকল্পিত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে তা সফলভাবে চালু করা অনেক কঠিন আরেকটা প্রক্রিয়া—এটা হয়তো তাঁর কিংবা বড় ভাই প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষের বিবেচনায় যথাযথ গুরুত্ব পায়নি! এ কারণে এক অভূতপূর্ব ফলন বিপর্যয়ে পতিত হলো শ্রীলঙ্কার কৃষি খাত। খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন এক বছরে বিপর্যয়করভাবে নেমে এল এক-চতুর্থাংশে।
অন্যদিকে, করোনাভাইরাস মহামারি শ্রীলঙ্কায় খুব বেশি মানুষের মৃত্যু না ঘটালেও সর্বনাশ ডেকে আনল শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের গুরুত্বপূর্ণ খাত পর্যটন খাতকে প্রায় ধসিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে। দুই বছর ধরে সারা বিশ্বের পর্যটন খাতে এমন বিপর্যয় গেড়ে বসেছে, যা থেকে উত্তরণ এখনো সুদূরপরাহত। শ্রীলঙ্কার রপ্তানি আয়ের আরও দুটি প্রধান সূত্র এলাচি ও দারুচিনিও বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মহামারির এই দুই বছরে। এ কারণে শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক আয়ে বড়সড় ধস নামল। এর সঙ্গে যুক্ত হলো ২০০৯ সাল থেকে বৈদেশিক ঋণের অর্থে যেখানে–সেখানে প্রকল্প গ্রহণের বদখাসলতের চরম মূল্য চুকানোর পালা।
শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক দেউলিয়াত্ব থেকে শিক্ষণীয় হলো, রাজাপক্ষে পরিবার ভোটের রাজনীতিকে যেভাবে ‘পারিবারিক একনায়কত্বে’ পর্যবসিত করেছে, সেটা একটা সমৃদ্ধ অর্থনীতির দেশকেও গভীর সংকটের গিরিখাতে নিক্ষেপ করতে পারে।
শ্রীলঙ্কার সংখ্যাগুরু সিংহলিরা গৃহযুদ্ধের কারণে ভারতের ওপর ক্ষিপ্ত ছিল, যার সুযোগ নেওয়ার জন্য তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপক্ষে গণচীনের দিকে অনেকখানি ঝুঁকে পড়েছিলেন। চীনও শ্রীলঙ্কার ভূরাজনৈতিক অবস্থানের গুরুত্বের বিবেচনায় দেশটিকে নিজেদের প্রভাববলয়ে টেনে নেওয়ার জন্য বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) আওতায় হামবানটোটায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ,কলম্বোয় সমুদ্রবন্দরের কাছে চায়নিজ সিটি নির্মাণসহ আরও কয়েকটি প্রকল্পে সহজ শর্তে প্রকল্প ঋণ প্রদান করে। পরবর্তী সময়ে যখন হামবানটোটা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ সম্পন্ন হয়, তখন দেখা গেল যে বন্দর ব্যবহারের যথেষ্ট চাহিদা পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
বন্দরের আয় বাড়াতে চরমভাবে ব্যর্থ হওয়ায় শেষ পর্যন্ত শ্রীলঙ্কা ৯৯ বছরের জন্য বন্দরটিকে চীনের কাছে লিজ দিতে বাধ্য হয়। একই রকম বিপদে পড়তে হচ্ছে কলম্বোর চায়নিজ সিটি ও কয়েকটি বিমানবন্দরের সম্প্রসারণ প্রকল্প নিয়ে। যথাযথ ‘প্রকল্প মূল্যায়ন’ পদ্ধতি অবলম্বনে এসব প্রকল্প গৃহীত না হওয়ায় এগুলোর কোনোটাই যথেষ্ট আয়বর্ধনকারী প্রকল্প হয়ে উঠবে না। এ জন্যই উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ মহলে বলা হচ্ছে, লোভে পড়ে শ্রীলঙ্কা ‘চীনা ঋণের ফাঁদে’ আটকে গেছে। আরও মারাত্মক হলো, ‘সভরেন বন্ড’ ছেড়ে শ্রীলঙ্কা আন্তর্জাতিক অর্থবাজার থেকে কয়েক বিলিয়ন ডলার পুঁজি সংগ্রহ করেছিল ওই সময়ে, যেগুলোর ম্যাচিউরিটি ২০২২ সাল থেকেই শুরু হতে চলেছে। কিন্তু এখন তো সুদাসলে ওই বন্ডের অর্থ ফেরত দেওয়ার সামর্থ্য শ্রীলঙ্কার নেই।
শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক দেউলিয়াত্ব থেকে শিক্ষণীয় হলো, রাজাপক্ষে পরিবার ভোটের রাজনীতিকে যেভাবে ‘পারিবারিক একনায়কত্বে’ পর্যবসিত করেছে, সেটা একটা সমৃদ্ধ অর্থনীতির দেশকেও গভীর সংকটের গিরিখাতে নিক্ষেপ করতে পারে।
বাংলাদেশেও আমরা গণতন্ত্রকে ‘নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর একনায়কত্বে’ পর্যবসিত করেছি। সম্প্রতি এলডিপির কর্নেল অলি আহমদ স্বীকার করেছেন, ১৯৯১ সালে প্রেসিডেনশিয়াল ব্যবস্থা থেকে আবার সংসদীয় ব্যবস্থায় পরিবর্তনের সময় তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার হাতে রাষ্ট্রের সব ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার উদ্দেশ্যে তিনি, ব্যারিস্টার সালাম তালুকদার ও কর্নেল মোস্তাফিজুর রহমান সলাপরামর্শ করে সংবিধানকে এমনভাবে সাজিয়েছিলেন যে এর পর থেকে রাষ্ট্রের একাধিপতি হয়ে গেছেন শুধুই প্রধানমন্ত্রী। রাষ্ট্রপতিকে এভাবে সাংবিধানিকভাবে ‘শিখণ্ডী’তে পরিণত করার জন্য এখন কর্নেল অলি আহমদ জাতির কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। শ্রীলঙ্কার দেউলিয়াত্ব এবং অর্থনৈতিক ধস থেকে সময় থাকতে যেন আমরা শিক্ষা গ্রহণ করি।
মইনুল ইসলাম অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়