আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যর্থতার বিশালতা উত্তেজনা নিয়ে মাপা হচ্ছে। এটা শুধু ডেমোক্র্যাট কিংবা রিপাবলিকানদের ব্যর্থতা নয়; আমেরিকান রাজনৈতিক সংস্কৃতির স্থায়ী ব্যর্থতা। ভিন্ন সমাজকে বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে মার্কিন নীতিনির্ধারকদের যে আগ্রহের খামতি আছে, এটা তারই প্রতিফলন।
উন্নয়নশীল দেশে আমেরিকার প্রায় সব কটি সামরিক হস্তক্ষেপের পরিণতি হয়েছে করুণ। কোরীয় যুদ্ধ থেকে শুরু করে অন্য কোনো যুদ্ধ—এর ব্যতিক্রম খুঁজে পাওয়া কঠিন। ষাটের দশক ও সত্তরের দশকের প্রথম ভাগে আমেরিকা ইন্দো-চীন অঞ্চলে যুদ্ধ করেছিল। ভিয়েতনাম, লাওস ও কম্বোডিয়ায় এক দশকের বীভৎস গণহত্যা শেষে পরাজিত হয়ে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি জনসন এবং তাঁর উত্তরসূরি রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন—দুজনই এই দোষের ভাগীদার।
একই সময়ে লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকার কিছু অংশে স্বৈরশাসকদের ক্ষমতায় বসিয়েছিল আমেরিকা। কঙ্গোতে মবুতু সেসের স্বৈরশাসনের কথা মনে করুন। ১৯৬১ সালে সিআইএর মদদে প্যাট্রিস লুমুম্বাকে হত্যা করা হয়েছিল। চিলির খুনে সামরিক জান্তা আউগুস্তো পিনোশের কথা স্মরণ করুন। সেখানে ১৯৭৩ সালে আমেরিকার মদদে বামপন্থী সালভাদর আয়েন্দেকে উৎখাত করা হয়েছিল।
আশির দশকে রোনাল্ড রিগ্যানের আমলে প্রক্সি যুদ্ধের মাধ্যমে মধ্য আমেরিকাকে ছারখার করে দেওয়া হয়েছিল। বামপন্থী সরকারকে উৎখাত করতে কিংবা তাদের আসা ঠেকাতে এটা করা হয়েছিল। সেই ক্ষত এখনো সেখানে শুকায়নি।
১৯৭৯ সাল থেকে মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিম এশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশনীতির মূর্খতা ও নিষ্ঠুরতায় পুড়ছে। আফগান যুদ্ধ শুরু হয়েছিল ৪২ বছর আগে। ১৯৭৯ সালে জিমি কার্টার প্রশাসন সেখানকার সোভিয়েত মদদপুষ্ট সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য ইসলামি জিহাদিদের গোপনে সমর্থন দিয়েছিল। সিআইএর মদদপুষ্ট মুজাহিদিনরা ফাঁদে ফেলে সেখানে সোভিয়েত বাহিনীকে ডেকে আনতে সক্ষম হয়। ফলে, ৪০ বছরের সংঘাত ও রক্তপাতের সর্পিল পথে ঢুকে পড়ে আফগানিস্তান।
১৯৭৯ সালে ইরানে সম্রাট রেজা শাহকে ক্ষমতাচ্যুত করা হলে রিগ্যান প্রশাসন ইরাকের স্বৈরশাসক সাদ্দাম হোসেনকে অস্ত্র দেয়। সদ্যোজাত ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামে ইরাক। এ রক্তাক্ত অধ্যায় চলে কুয়েতে সাদ্দাম হোসেনের আক্রমণ এবং পরবর্তীকালে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন দুটি উপসাগরীয় যুদ্ধ পর্যন্ত।
দুর্ভাগ্যজনক সত্য হচ্ছে, আমেরিকার রাজনৈতিক শ্রেণি ও গণমাধ্যম গরিব দেশগুলোর জনগণকে অবজ্ঞা করে। আমেরিকার বেশির ভাগ অভিজাত তাদের নিজের দেশের গরিবদেরও অবজ্ঞার চোখে দেখে।
আফগানিস্তানে সর্বশেষ ট্র্যাজিক অধ্যায়টি শুরু হয়েছিল ২০০১ সালে। ১১ সেপ্টেম্বরের সন্ত্রাসী হামলার এক মাসের মধ্যে। প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ সেখানে সেনা অভিযানের মাধ্যমে ইসলামি জিহাদিদের উৎখাতের ঘোষণা দেন। তার ডেমোক্র্যাট উত্তরাধিকারী প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা আফগানিস্তানে শুধু যুদ্ধটাকেই চালিয়ে যাননি, সেখানে সেনাও বাড়িয়েছিলেন। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য তিনি সিআইএকে সৌদি আরবের সঙ্গে কাজ করার আদেশ দেন। লিবিয়ার নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে উৎখাতের আদেশও দেন তিনি।
সব কটি ঘটনার মধ্যে মিলের দিকটা হচ্ছে, এ ক্ষেত্রে শুধু নীতিগত ব্যর্থতা ঘটেনি। মূল সত্যটা হচ্ছে, আমেরিকার নীতিনির্ধারকেরা বিশ্বাস করেন, যেকোনো রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে সামরিক হস্তক্ষেপ কিংবা সিআইএর মদদে অস্থিতিশীলতা তৈরির মাধ্যমে। যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশনীতির ক্ষেত্রে মার্কিন অভিজাতেরা অন্য দেশ যে দারিদ্র্যের জাঁতাকল থেকে বেরিয়ে আসুক, তা চায় না। মার্কিন সামরিক বাহিনী ও সিআইএর বেশির ভাগ হস্তক্ষেপ হয়েছে সেসব দেশেই, যারা তীব্র অর্থনৈতিক বঞ্চনা থেকে বের হয়ে আসার জন্য সংগ্রাম করছিল।
সম্প্রতি প্রকাশিত আফগান পুনর্গঠন বিষয়ে বিশেষ প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, ২০০১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত আমেরিকা সেখানে ৯৪৬ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। এক ট্রিলিয়ন ডলারের এই বিনিয়োগ কেবল গুটিকয়েকের মন-প্রাণ জয় করে নিতে পেরেছে। কেন? ৯৪৬ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ৮১৬ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়েছে মার্কিন সেনাদের জন্য, যা মোট বিনিয়োগের ৮৬ শতাংশ। আফগানিস্তানের জন্য ১৩০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়েছে, যার ৮৩ বিলিয়ন ডলারই গেছে আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর পেছনে। ১০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়েছে মাদক নির্মূল অভিযানে। ১৫ বিলিয়ন খরচ করা হয়েছে আফগানিস্তানে নিযুক্ত বিভিন্ন মার্কিন সংস্থার পেছনে। এরপর মাত্র ২১ বিলিয়ন ডলার অবশেষ ছিল।
মোট বিনিয়োগের ২ শতাংশেরও কম আফগানিস্তানের জন্য ব্যয় হয়েছে। আফগান জনগণের দারিদ্র্য বিমোচন ও ভৌত অবকাঠামো নির্মাণে প্রকৃত ব্যয় হয়েছে আরও কম। আমেরিকা সেখানে বিশুদ্ধ পানি, পয়োনিষ্কাশন, বিদ্যালয় নির্মাণ, ক্লিনিক স্থাপন, ডিজিটাল যোগাযোগ, কৃষি উপকরণ ও পুষ্টি কর্মসূচির মতো প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে পারত। তাতে আফগানিস্তানের জনগণ অর্থনৈতিক বঞ্চনা থেকে মুক্তি পেত। এর বদলে এমন একটা দেশকে তারা ছেড়ে গেল, যেখানে গড় আয়ুসীমা ৬৩ বছর, মাতৃমৃত্যু প্রতি লাখে ৬৩৮ জন।
এখন সময় এসেছে আমেরিকার নেতাদের এই পথ থেকে বের হয়ে আসার। জনগণের কাছে তাদের জোর দিয়ে বলতে হবে, তারা আর এ ধরনের মামুলি কাজে টাকা খরচ করবে না। দুর্ভাগ্যজনক সত্য হচ্ছে, আমেরিকার রাজনৈতিক শ্রেণি ও গণমাধ্যম গরিব দেশগুলোর জনগণকে অবজ্ঞা করে। আমেরিকার বেশির ভাগ অভিজাত তাদের নিজের দেশের গরিবদেরও অবজ্ঞার চোখে দেখে।
কাবুলের পতনের পর, মার্কিন গণমাধ্যম আফগানিস্তানে আমেরিকার ব্যর্থতার দায় চাপাচ্ছে আফগান সরকারের অসংশোধনীয় দুর্নীতির ওপরে। ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া ও পূর্ববর্তী যুদ্ধগুলোয় লাখো কোটি ডলার ব্যয় করে কিছুই দেখাতে পারেনি আমেরিকা। শুধু বালুতে রক্তের দাগটাই তারা রেখে যেতে পেরেছে।
জেফরি ডি স্যাক্স কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের টেকসই উন্নয়নকেন্দ্রের পরিচালক
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট: ইংরেজি থেকে অনূদিত