সমাজসেবা অধিদপ্তর বাংলাদেশে ছয় বিভাগে অবস্থিত ছয়টি ছোটমণি নিবাস এবং পিতৃমাতৃহীন বা পিতৃহীন এতিম শিশুদের জন্য জেলা সদর ও কিছু কিছু উপজেলায় ৮৫টি সরকারি শিশু পরিবার পরিচালনা করে। এ ছাড়া আইনের সংস্পর্শে আসা শিশু বা অভিভাবক কর্তৃক প্রেরিত শিশুদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে তিনটি শিশু (কিশোর–কিশোরী) উন্নয়ন কেন্দ্র পরিচালিত হচ্ছে। বেসরকারি পর্যায়ে এতিমখানা এবং নানা ধরনের অনেক প্রতিষ্ঠান আছে।
শিশুদের বিকাশের জন্য প্রাথমিক যত্নকারীদের সঙ্গে নিরাপদ ও নিবিড় সম্পর্ক সৃষ্টি করা প্রয়োজন। তার জন্য চাই ভালোবাসা ও সুস্থিরতা। সুরক্ষিত পারিবারিক পরিবেশে পরিপূর্ণভাবে বেড়ে ওঠা শিশুদের অধিকার, যা জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদের অন্তর্ভুক্ত। সেভ দ্য চিলড্রেন প্রকাশিত ‘কিপিং চিলড্রেন আউট অব হার্মফুল ইনস্টিটিউশন: হোয়াই উই শুড বি ইনভেস্টিং ইন ফ্যামিলি-বেজড কেয়ার’–এ বিভিন্ন গবেষণা ও নানা দেশের অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করে জানানো হয়েছে, শিশুদের জন্য প্রতিষ্ঠান অনিরাপদ, অনুপযুক্ত। প্রতিষ্ঠানে থাকার ফলে শিশুদের শারীরিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও আবেগীয় বিকাশে দারুণ নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। প্রতিষ্ঠানে বাস করা শিশুরা অনেক ক্ষেত্রেই তাদের দেখভালের দায়িত্বে থাকা কর্মচারী, কর্মকর্তা, স্বেচ্ছাসেবক ও পরিদর্শনকারীদের দ্বারা নির্যাতন, শোষণ ও অবহেলার শিকার হয়। কেউ কেউ পাচারের ঝুঁকিতে থাকে। ছয় মাস প্রতিষ্ঠানে থাকলে নবজাতক এবং দুই থেকে চার বছরের শিশুদের যে ক্ষতি হয়, তা পর্যাপ্ত সহায়তা ছাড়া আর কখনোই পূরণ করা সম্ভব না (‘দ্য রিস্ক অব হার্ম টু ইয়াং চিলড্রেন ইন ইনস্টিটিউশনাল কেয়ার’, কেভিন ব্রাইন, ২০০৯)। বিভিন্ন দেশেই শিশু পরিচর্যা বিষয়ে নিয়ন্ত্রণ না থাকায় যে কেউ প্রতিষ্ঠান খুলতে পারে। ফলে তা হয়ে ওঠে নিছক ব্যবসা। কিন্তু যেসব প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য সৎ এবং ব্যবস্থাপনা ভালো, সেগুলোও শিশুদের বিকাশের জন্য সহায়ক নয়।
প্রতিষ্ঠানে বাস শিশুর পুরো জীবনে প্রভাব ফেলে। প্রতিষ্ঠান ছেড়ে যাওয়ার পর অনেকেই ভীষণ দরিদ্র হিসেবে জীবন কাটায়। তাদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা, গৃহহীন হওয়া, মাদকাসক্তি, ঝুঁকিপূর্ণ যৌনাচরণ ও অপরাধে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। বাংলাদেশের গণমাধ্যমে প্রতিষ্ঠানে থাকা শিশুদের পালানো অথবা আত্মহত্যার কথা মাঝেমধ্যে প্রকাশিত হয়। এ তো শুধু সমস্যার সামান্য অংশ। সাধারণভাবে প্রতিষ্ঠানে বসবাসকারী শিশুরা ভালো নেই।
বিভিন্ন দেশে দারিদ্র্য, যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদি শিশুদের প্রতিষ্ঠানে থাকার কারণ। অনেক মা-বাবার কাছে প্রতিষ্ঠানে রাখা শিশুর শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক সেবা নিশ্চিত করার সহজ উপায়। জাতিগত সংখ্যালঘু, প্রতিবন্ধী, এইচআইভি আক্রান্ত শিশুদের বেশি হারে প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করা হয়। সারা বিশ্বে প্রতিষ্ঠানে বসবাসকারী শিশুদের ৮০ থেকে ৯৬ শতাংশেরই মা-বাবা জীবিত। তার মানে প্রতিষ্ঠানে রাখার মূল কারণগুলো নিরসন করলে তারা পরিবারের সঙ্গে থাকতে পারত।
দারিদ্র্য কখনোই কোনো শিশুর প্রতিষ্ঠানে থাকার কারণ হতে পারে না। কিছু উদ্যোগ নিলে শিশুরা পরিবারেই থাকতে পারবে। যেমন পরিবারগুলোকে আর্থিক সহায়তা, মা-বাবার জীবিকার্জনের ব্যবস্থা, শিশু সংবেদনশীল সামাজিক সুরক্ষা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা ইত্যাদি।
পরিবারেও শিশু নির্যাতন ও অবহেলার শিকার হতে পারে। পরিবার যদি শিশুকে সুরক্ষা দিতে অক্ষম বা অনিচ্ছুক হয়, তাহলে রাষ্ট্রকে বিকল্প পরিচর্যার ব্যবস্থা করতে হবে। যেমন নিকটাত্মীয়-পরিজন বা আগ্রহী পালক পরিবারের কাছে রাখা ইত্যাদি। যদি এগুলোর কোনোটিই শিশুর জন্য উপযুক্ত না হয়, কেবল তখনই প্রতিষ্ঠানের কথা বিবেচনা করতে হবে। সেখানে সেবার মান বজায় রাখা জরুরি। প্রতিষ্ঠানে থাকতে হলে তা হবে শিশুর নির্দিষ্ট চাহিদা মেটাতে অন্তর্বর্তীকালের জন্য। শিশুকে পরিবারে ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। তা সম্ভব না হলে পরিবারভিত্তিক বিকল্প পরিচর্যা খোঁজা দরকার। যেকোনো রকম ব্যবস্থায় শিশুদের রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে বিদ্যমান বিকল্পগুলো যাচাই এবং সেগুলোর সুবিধা-অসুবিধা বিশ্লেষণ করতে হবে। পুরো প্রক্রিয়ায় শিশুর মতামত শোনা এবং ‘শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থ’কে আমলে নেওয়া প্রয়োজন।
২০০৯ সালের নভেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ
সভায় ‘দ্য ইন্টারন্যাশনাল গাইডলাইনস ফর দ্য অলটারনেটিভ কেয়ার ফর চিলড্রেন’ গৃহীত হয়। ইন্দোনেশিয়া, জর্জিয়া, লাইবেরিয়াসহ বিভিন্ন দেশ এ নির্দেশনা কাজে লাগিয়ে পরিবারভিত্তিক বিকল্প পরিচর্যার দিকে যথেষ্ট অগ্রসর হয়েছে।
বাংলাদেশের শিশু আইন ২০১৩ অনুযায়ী শিশু সুরক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কথা, যার অংশ হিসেবে বিকল্প পরিচর্যাও থাকবে। কিন্তু এর বাস্তবায়নে তেমন অগ্রগতি হয়নি। অনেক ক্ষেত্রেই বিকল্পগুলোর কোনো ধরনের বিশ্লেষণ ছাড়াই সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে শিশুদের বছরের পর বছর রাখা হচ্ছে। জাতিসংঘ শিশু অধিকার কমিটি বাংলাদেশে অপ্রয়োজনে শিশুদের প্রতিষ্ঠানে থাকা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে; পরিবারগুলোকে শক্তিশালী করা এবং পরিবারভিত্তিক বিকল্প পরিচর্যায় জোর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। একটি কার্যকর শিশু সুরক্ষাব্যবস্থার জন্য পর্যাপ্ত বিনিয়োগ এবং সমাজকর্মী, শিক্ষক, স্বাস্থ্যকর্মী, আইনজীবীসহ সংশ্লিষ্ট সবার দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে। সব ধরনের বিকল্প পরিচর্যার মান নির্ধারণ এবং তদারকির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশেই এতিমখানা বা প্রতিষ্ঠানে দান করার ক্ষেত্রে অনেকের আগ্রহ আছে। সরকার এবং কোনো কোনো দাতা সংস্থাও এতে অর্থ বরাদ্দ করে। এর ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো টিকে আছে এবং বিস্তার লাভ করছে। আফ্রিকার কয়েকটি দেশে পরিচালিত গবেষণায় জানা যায়, পরিবারের তুলনায় প্রতিষ্ঠানে ছয় থেকে দশ গুণ বেশি খরচ হয়।
দারিদ্র্য কখনোই কোনো শিশুর প্রতিষ্ঠানে থাকার কারণ হতে পারে না। কিছু উদ্যোগ নিলে শিশুরা পরিবারেই থাকতে পারবে। যেমন পরিবারগুলোকে আর্থিক সহায়তা, মা-বাবার জীবিকার্জনের ব্যবস্থা, শিশু সংবেদনশীল সামাজিক সুরক্ষা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা ইত্যাদি।
বাংলাদেশে মা-বাবা, সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার কর্মীসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে শিশুদের প্রতিষ্ঠানে বসবাসের নেতিবাচক দিক নিয়ে সচেতনতার অভাব আছে। এর পরিবর্তন দরকার। এতিমখানা বা অন্য প্রতিষ্ঠানে সহায়তা করার আগে সবাইকে ভাবতে হবে যে শিশুকে পারিবারিক পরিবেশে রাখা যেত কি না। এ দান শিশুর কল্যাণে কাজে লাগছে, নাকি তার জন্য ক্ষতিকর? সরকার, দাতা সংস্থা, সুশীল সমাজ, বেসরকারি খাত ও সমাজকে পরিবারে বিনিয়োগের মাধ্যমে শিশুদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া ঠেকাতে হবে। প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক ব্যবস্থার আমূল সংস্কার প্রয়োজন।
লায়লা খন্দকার উন্নয়নকর্মী