বাংলা একাডেমির মূল বইমেলা এখন বর্ধমান হাউসের চত্বরের বাইরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে চলে গেছে। উদ্যান মেলার উপযুক্ত স্থান কি না, তা নিয়ে তর্ক আছে। এ লেখা তা নিয়ে নয়। আমাদের যা কিছু আছে, তা–ই দিয়ে মেলাটাকে শিশু সংবেদনশীল মানুষ আর প্রতিষ্ঠানের মেলাতে রূপ দেওয়া যায় কি না, সেটিই এ লেখার মূল ভাবনা।
কেন শিশুবান্ধব মেলা
আজ থেকে ১০ বছর আগে অনেকে বাংলা একাডেমির ‘ঘিঞ্জি বইমেলা’ অন্য কোথাও সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব দিয়ে লেখালেখি শুরু করেছিলেন। তখন অনেকেই ‘গেল গেল’ বলে আওয়াজ তুলেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আটকে রাখা যায়নি সেই দাবি। তবে সুকান্তর সেই ‘খাদ্য সমস্যার সমাধান’ মার্কা সমাধান মিলেছে। অভাবের তাড়নায় বন্ধু চেয়েছিলেন চাল, মজুতদার তাঁকে দিয়েছিলেন চালকুমড়ো আর বলেছিলেন ‘এই নাও ভাই, চালকুমড়ো,/ আমায় খাতির করো,/ চালও পেলে কুমড়ো পেলে/ লাভটা হল বড়।’
লাভ হয়েছে বটে। কিন্তু কাদের? শিশুদের জন্য সেই ‘থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়’। নানা শিশুকেন্দ্রিক প্রকল্পের চাপে শিশু কর্নার হয়েছে, শিশুদের জন্য আলাদা দিন ও সময়ের ঘোষণা এসেছে। ভালো করে চিন্তা করলে মনে হবে, এসবই আরোপিত। গত মৌসুমে ঝড়বৃষ্টির পর যখন বালু–ইট ফেলার প্রয়োজন হলো, তখন শিশুদের কর্নারের কথা সবাই ভুলেই বসেছিল। আসলে দুটো উদ্দেশ্য মাথায় রেখে মেলার আয়োজন হয়। প্রথমটি নিশ্চয়ই বাণিজ্যিক; দ্বিতীয়টি হয়তো সাধারণ মানুষের বিনোদন। আজকাল কোনো কিছুই বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য ছাড়া হয় কি? অনেকের মতে, সেটাই আসল। মানুষ বৈষয়িক হলেই ভালো, বই পড়ে বৈষয়িক হলে আরও ভালো।
আমাদের বইমেলার দিকে গভীরভাবে তাকালে বোঝা যাবে, এটা ক্রমে যেন একাডেমির বোঝা হয়ে উঠছে। অসীম সম্ভাবনা সত্ত্বেও বইমেলায় না হচ্ছে ব্যবসা, না হচ্ছে বিনোদন কিংবা একুশ স্মরণ। মেলাটি শিশুদের টানতে পারছে না। এখনকার পাঠক আগামীর ক্রেতা শিশুদের টানতে না পারলে মূল ভিতটাই যে দুর্বল হয়ে যাবে, সেটা আমরা কবে বুঝব?
জীবিকার জন্য হাজার পদের ব্যবসা আছে। কেউ চুল ছাঁটার সেলুন চালাচ্ছেন, কেউ হয়তো চায়নিজ রেস্টুরেন্ট নাম দিয়ে স্রেফ নুডলস, ভাজা ভাত, সসে ঢাকা চিংড়ি বিক্রি করছেন। তাঁদের কেউই হয়তো জাতিসংঘের শিশু সনদ পড়েননি। কিন্তু ব্যবসাটা বুঝেছেন। বুঝেছেন কীভাবে শিশুদের টানতে হয় সেলুনে কিংবা রেস্তোরাঁয়। চারটি টেবিল তুলে দিয়ে শিশুদের দম ফেলার একটা জায়গা করে দিয়েছেন অনেক রেস্তোরাঁর মালিক। সেলুনের মালিক শিশুর মানানসই চেয়ার বসিয়েছেন। সারা দিনে হয়তো তিন–চারটি শিশু আসে তাঁর সেলুনে, কিন্তু চেয়ারটায় ময়লা পড়ে না। কোনো কোনো সেলুনে বড়দের বইয়ের পাশাপাশি শিশু–কিশোরদের উপযোগী বইও রাখা হয়। বই রাখার পর দেখা যায়, লোকজন আগে এসেই যে তাড়াহুড়া করত, এখন তা করছে না। বই পড়ার সুবিধার কথা মাথায় রেখে অনেক শিশু–কিশোর সেই সেলুনে যায়। এটিই ব্যবসা। সেলুনের মালিকেরা বুঝতে পেরেছেন, কোথায় লগ্নি করতে হবে। যে শিশু আজ তার সেলুনে এল, সে বড় হয়েও আসবে। বন্ধুদেরও বলবে আসার জন্য। চীনা খাবারের দোকানেও তা–ই হচ্ছে।
অন্যদিকে আমাদের বইমেলার দিকে গভীরভাবে তাকালে বোঝা যাবে, এটা ক্রমে যেন একাডেমির বোঝা হয়ে উঠছে। অসীম সম্ভাবনা সত্ত্বেও বইমেলায় না হচ্ছে ব্যবসা, না হচ্ছে বিনোদন কিংবা একুশ স্মরণ। মেলাটি শিশুদের টানতে পারছে না। এখনকার পাঠক আগামীর ক্রেতা শিশুদের টানতে না পারলে মূল ভিতটাই যে দুর্বল হয়ে যাবে, সেটা আমরা কবে বুঝব?
শিশুরা কেমন বইমেলার স্বপ্ন দেখে
বইমেলায় শিশুদের একরকম অঘোষিত বার্তায় বলে দেওয়া হয়, ‘সব দিন বড়দের, তোমাদের কয়েক ঘণ্টা’। অথচ, তারা ক্রেতার ৪৭ ভাগের বেশি। অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্রী বলেছে, ‘বইমেলায় ছুটির দিনে শিশুপ্রহর থাকলেও সেটা খুব কম সময়ের জন্য। মাত্র কয়েক ঘণ্টা। এত কম বিনোদনে চলবে? আরও কিছু যদি থাকত। এই যেমন স্থায়ী খেলাধুলার ব্যবস্থা কিংবা আনন্দ করার জন্য শিশু চত্বরের মধ্যেই স্থায়ী শিশু কর্নার। লেখকদের কাছাকাছি যাতে বড়রা যেতে পারে, তার জন্য আলাদা মঞ্চ আছে। শিশুরা কী দোষ করেছে? শিশুদের নিয়ে লেখা গল্প, ছড়া স্বয়ং লেখকদের মুখে শোনার ব্যবস্থা থাকলে কত্ত মজা হতো!’
ঢাকার মেয়ে উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের ওই শিক্ষার্থী ঢাকার বাইরে থেকে আসা শিশু–কিশোরদের কথা ভেবেছে দেখে খুব ভালো লাগল। সে বলল, ‘বইমেলায় আমরা যারা অনেক দূর থেকে আসি, তাদের জন্য একটু বিশ্রামের ব্যবস্থা থাকলে ভালো হতো। এক ঘণ্টা ঘোরাঘুরি আর ১০ মিনিট বিশ্রাম। বইমেলার ভেতরে বসার জায়গা নিতান্তই কম। অনেক বয়স্ক মানুষেরই কষ্ট হয়। আর মেলার সময়টা বেলা তিনটা থেকে না করে সকাল থেকে শুরু করলে সময় পাওয়া যেত।’ খুলনা থেকে একজন বইপড়ুয়া কিশোর নতুন বইয়ের ঘোষণা প্রসঙ্গে বলেছে, ‘মেলায় নতুন প্রকাশিত বইগুলোর নাম মাইক্রোফোনে ঘোষণা দেওয়া হয়। ব্যাপারটা আরেকটু ডিজিটাল হলে ভালো হতো। মেলায় বড় একটি বা দুটি স্ক্রিনে সদ্য আসা বইয়ের প্রচ্ছদ ও বিস্তারিত দেখানো গেলে কোনো বইয়ের ঘোষণাই মিস হতো না।’
শিশু–কিশোরদের সঙ্গে কথা বললে তাদের মনের অনেক কথা আমরা জানতে পারতাম। একাডেমির সেই চেষ্টা থাকা প্রয়োজন। শিশুদের কাছেও শেখার আছে। একটা শিশু আর পরিবারবান্ধব বইমেলা করতে শিশুমনস্ক একটা মন চাই।
আরও কয়েকটি সুপারিশ
১. মেলায় ঢুকে যে শিশুরা তাদের চত্বরে যাবে, সে রকম কোনো নির্দেশনা থাকে না। সেটা থাকা দরকার।
২. শিশুদের জন্য আলাদা পানি পান বা তাদের মাপের উপযোগী শৌচাগার ও হাত ধোয়ার বেসিনের ব্যবস্থা থাকা দরকার।
৩. যেসব প্রকাশক বড়দের সঙ্গে সঙ্গে শিশুদের জন্য বই প্রকাশ করেন, তাঁরা ডেডিকেটেড শিশু স্পেস রেখে স্টল বানাতে পারেন, যেখানে মা–বাবার সঙ্গে শিশুরা গিয়ে তাদের বই খুঁজতে পারবে।
৪. বড় শিশুর সঙ্গে মা যে কোলের সন্তানকে নিয়ে আসেন, তার জন্য কোনো ব্রেস্টফিডিং কর্নার থাকতে পারে।
যে বইমেলা শিশুকে আকর্ষণ করবে, সেই বইমেলা দেশকে পথ দেখাবে। একটা পড়ুয়া জাতি গড়ে তোলা হোক আমাদের সবার লক্ষ্য। সেই লক্ষ্যে শিশুরা থাকবে সবার চিন্তায় আর কাজের প্রতিফলনে।
গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক।
nayeem 5508 @gmail.com