শিশুকে রাগিয়ে, কাঁদিয়ে, ভয় দেখিয়ে, লজ্জা দিয়ে বড়দের কেউ কেউ আনন্দ পান। শিশুর অসহায়ত্ব তাঁরা উপভোগ করেন। কিন্তু শিশুর কাছে এগুলো নিষ্ঠুরতা। শিশু কীভাবে উপভোগ করবে সেই অপমান, যখন একজন বড় কেউ পেছন থেকে এক ঝটকায় তার পরনের কাপড় খুলে দিয়ে আনন্দে হাসতে থাকেন। শিশুর অপ্রস্তুত অবস্থা এবং লজ্জায় রাঙা হয়ে কেঁদে ফেলা দেখে অন্য বড়রাও যোগ দেন সেই উল্লাসে।
এখন সেসব উদ্ভট উল্লাস পরিবারের গণ্ডি ছাড়িয়ে নানা সামাজিক মাধ্যমে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। শিশুর নানা সরলতা আর অবাস্তব কল্পনা (ফ্যান্টাসি) নিয়ে আজকাল অনেকেই সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট দিচ্ছেন। অনেক মা-বাবা এসব করে নাকি রোজগারও করছেন।
একজন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন কর্মী বিদেশ থেকেন। করোনাকালের শুরুর দিকে তিনি লকডাউন নিয়ে লগর মশকরা শুরু করলেন। মজার ছলে একদিন তিনি তাঁর সন্তানকে জানালেন, ‘আজ লকডাউন। কোনো রান্নাবান্না হবে না। আজ রাতে খাওয়া নেই। না খেয়েই আমাদের দিন-রাত কাটাতে হবে।’ মা-বাবার প্রতি অকুণ্ঠ আস্থা আর বিশ্বাসবোধ থাকায় সন্তানটি প্রথমে মা-বাবার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার অনুরোধ করে সবিনয়ে। তারপর জানায় তার তৃষ্ণা-ক্ষুধার কথা সজল নয়নে। মা-বাবা তাঁদের সিদ্ধান্তে অবিচল থাকেন। মেয়েটা প্রথমে নীরবে, তারপর ফুঁপিয়ে, শেষে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে থাকে। নিষ্ঠুর স্বামী-স্ত্রী শিশুর সেই বুকফাটা কান্না আর খাবারের সজল আকুতি ভিডিও করেন, তারপর সেটা ছেড়ে দেন সামাজিক মাধ্যমে। যথারীতি সামাজিক মাধ্যমে অসামাজিক উল্লাস আর বন্ধ হয় না। হাজার হাজার লাইক আর ওয়াও পড়তে থাকে। দু-একজন অন্য সুরে কথা বললেও অন্যরা তাঁদের জানিয়ে দেন, যাঁদের সন্তান তাঁদেরই ভাবতে দিন, তাঁদের ছেলেমেয়ে নিয়ে তাঁরা কী করবেন না-করবেন, সেটা তাঁদের ব্যাপার, আপনি বলার কে?
পরে নানা চাপে বাধ্য হয়ে পোস্টটা সামাজিক মাধ্যম থেকে প্রত্যাহৃত হয়। কিন্তু ততক্ষণে কপি পেস্ট হয়ে শোভা পেয়ে গেছে হাজার শিশু-অসংবেদনশীলদের দেয়ালে। শিশু বড় হয়ে যখন দেখবে তার শৈশব সামাজিক মাধ্যমে খোলা হাঁড়ি-ডেকচি হয়ে আছে, তখন তার অস্বস্তি হবেই। নিজের ছবি অপরিচিত অন্য কারও ওয়ালে দেখে বা কোনো অরুচিকর খারাপ মন্তব্যে চোখে পড়লে আঁতকে উঠবেই। ভালো লাগবে না। ভুগবে মানসিক বিপর্যস্ততা বা অবসাদে। শিশু মনোবিজ্ঞানীরা সে রকম আভাসই দিচ্ছেন। তাঁরা এই মানসিক বিপর্যস্ততাকে বলছেন পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজ-অর্ডার (পিটিএসডি বা বিপর্যয়-পরবর্তী মানসিক চাপজনিত রোগ)।
লুসির বয়স যখন ৭ বছর, তখন থেকেই তার বিভিন্ন ছবি বাবা সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করতেন। লুসি এখন ১৬ বছরের, তার এসব ছবি নিয়ে অনেক আপত্তি। লুসি জানিয়েছে, ‘যখন আমার বয়স ১২ কিংবা ১৩ বছর, তখন আমি বুঝতে শুরু করলাম যে ফেসবুকে থাকা কিছু জিনিস বেশ অস্বস্তিকর।’ লুসির কথায় বাবা আপত্তি ছাড়াই কন্যার অনেক ছবি এখন মুছে দিয়েছেন। কিন্তু লুসি মনে করে, ‘বাবা ছবিগুলো সরিয়ে দিলেও কিন্তু কেন আমি সরিয়ে দিতে বলছি, সেটি বাবার কাছে হয়তো পরিষ্কার নয়। তাঁর কাছে বিষয়টা মনে হয় রহস্যময় থেকে গেছে। কিন্তু আমাকে যদি প্রশ্ন করা হতো, এসব ছবি সবাই দেখুক, তা আমি চাই কি-না, তাহলে আমি অবশ্যই না বলতাম।’
এই প্রসঙ্গে ইংল্যান্ডের অন্য এক কিশোরী বিবিসিকে বলে, ‘ছোটবেলায় এসব দেখে বেশ এক্সাইটিং মনে হলেও, এখন বিষয়টা একেবারেই ভালো লাগছে না।’
গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের এক সূর্যমুখী বাগানে পরিবার নিয়ে ঘুরতে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের এক ক্রিকেটার। সেখানে তার শিশুকন্যার কয়েকটি ছবি তুলে নিজের ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে পোস্ট করেন। ছবি দেখে অনেকে মন্তব্য করতে থাকেন। লাগামহীন, খারাপ ও ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য করতেও কসুর করেননি অনেকে। সেসব মন্তব্যের স্ক্রিনশট শিশুটির ওই ছবির ওপর বসানো একটি পোস্ট ফেসবুকে দ্রুত ভাইরাল হয়ে যায়। এর আগে অন্য আরেক ক্রিকেট তারকার মেয়ের ছবিতেও এমন আপত্তিকর মন্তব্য দেখা গিয়েছিল।
সন্তানকে নিয়ে মা-বাবার আহ্লাদ একটু বেশি থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বেশির ভাগ সময়ই তাঁরা তাদের শখ-আহ্লাদ মেটাতে গিয়ে শিশুকে কোন বিপদে ঠেলে দিচ্ছেন আর তার ফলাফল কী হতে পারে, সেটা নিয়ে বিশেষভাবে ভাবছেন কি তাঁরা ।
চিন্তিত বিশ্ব।
সমীক্ষা বলছে, ব্রিটিশ অভিভাবকেরা সন্তান জন্মানোর সময় থেকে বছরে গড়ে ২০০টি করে ছবি পোস্ট করেন। অর্থাৎ শিশুর ৫ বছর বয়স হওয়ার আগেই তার ১০০০টি ছবি চলে যায় সামাজিক মাধ্যমে। বলা বাহুল্য, এসব ছবি প্রকাশের ক্ষেত্রে শিশু-কিশোরদের অনুমতির কোনো তোয়াক্কা কেউ করেন না । অথচ বড়দের ক্ষেত্রে অনুমতি ছাড়া ছবি পোস্ট করলে তা হয় অপরাধ।
শিশুদের সামাজিক মাধ্যমে বুলিংয়ের ঝুঁকি কমানোর জন্য এক দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ নিয়েছে ফ্রান্স। নতুন এক আইন অনুযায়ী, ফেসবুক কিংবা অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমের দেয়ালে শিশুদের অপ্রস্তুত ছবি পোস্ট করলে ৩৫ হাজার ইউরো পর্যন্ত জরিমানা কিংবা জেল হতে পারে। শিশুদের ব্যক্তিগত জীবনের গোপনীয়তা রক্ষা করতেই এমন সিদ্ধান্ত।
শুধু শিশুর ‘মালিক’ বনে যাওয়া মা-বাবা নন, অন্যরাও এমনকি গণমাধ্যমও শিশুর ছবি যখন খুশি যেমন খুশি ছাপতে বা অনলাইনে পোস্ট দিতে পারে না।
বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ নিজস্ব একটা নজরদারি বা ‘অ্যালগরিদম’ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলছে। শিশুর আপত্তিকর কোনো ছবি থাকলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেটা সরিয়ে নেওয়া হয়। তবে ‘অ্যালগরিদম’-এর চোখে ধুলা দেওয়ার নানা ফন্দিফিকিরও বেরিয়েছে।
তামিলনাড়ুর চেন্নাইয়ে ২০১৭ সালে দুটো ফেসবুক পেজের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন মানবাধিকারকর্মীরা। খালি চোখে মনে হবে না যে তারা কোনো নীতি লঙ্ঘন করেছে। তারা ৫ থেকে ১৫ বছরের মেয়েদের ছবি পোস্ট করেছিল। সেখানে কোনো ছবিই সেই অর্থে অশ্লীল ছিল না। তাই ফেসবুকের ‘অ্যালগরিদম’এ কিছু ধরা পড়েনি।
তবে ফেসবুক পেজ দুটিতে সব ছবিই ছিল ‘চুরি’ করা বা লিফটেট। অর্থাৎ, অন্যান্য পেজ থেকে নেওয়া। তবে ছবির মন্তব্য ছিল মূলত তামিল ভাষায় আর সেটা ছিল অত্যন্ত কুরুচিকর। ছোট ছোট মেয়েদের ছবিতে এমন মন্তব্য দেখেই অভিযোগ দায়ের করা হয়েছিল। পুলিশের তৎপরতায় ফেসবুক পেজগুলো নিষিদ্ধ হয়।
শিশুর ছবি পোস্টের ঝুঁকি
শিশু বড় হয়ে এসব ছবি আর মন্তব্যে তার মন খারাপ হয়ে মানসিক অবসাদে কিংবা সংকটে যাওয়ার ঝুঁকি ছাড়াও অন্য আরও ঝুঁকি আছে।
• শিশুদের ব্যক্তিগত ছবি পেডোফিলিক ব্যক্তিদের (যাঁরা শিশুদের প্রতি যৌনাকর্ষণ বোধ করেন) আয়ত্তে চলে যেতে পারে।
• এমন কিছু সোশ্যাল সাইট আছে যাদের কাজই হচ্ছে এই ধরনের ছবি প্রোফাইল থেকে হ্যাক করে নিয়ে ভিডিও আকারে পর্নো ওয়েবসাইটগুলোতে ছড়িয়ে দেওয়া।
• এসব ছবি নিয়ে শিশুদের ওপর পর্নোগ্রাফি ফিল্ম তৈরি করে সাইবার অপরাধীরা।
এসব চক্র এখন খোদ ঢাকাতেও সক্রিয়। ২০১৪ সালে ঢাকায় এ রকম এক চক্রকে আটক করে সিআইডি৷ গত বছরের অক্টোবরে আরেকটি শিশু পর্নোগ্রাফি চক্রের সদস্যদের আটক করতে পেরেছে পুলিশ৷ চক্র দুটির কাছ থেকে ভয়ংকর সব তথ্য পেয়েছেন তদন্তকারীরা৷ এই চক্রের জাল দেশের বাইরেও বিস্তৃত। বিদেশি খদ্দেরদের কাছে তারা নিয়মিতভাবে এ দেশের শিশুদের ছবি বিক্রি করত।
শিশুর ছবি সামাজিক মাধ্যমে দিতে হলে কোন কোন বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে:
• সমবয়সীদের সঙ্গে তার খেলাধুলা, হুটোপাটির ছবিও পোস্ট করেন। এমন কোনো ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় দেবেন না, যেখানে আপনার সন্তানের অন্তর্বাস দেখা যাচ্ছে। ছেলে হোক বা মেয়ে, এই ধরনের ছবি অ্যাকাউন্ট থেকে হাতিয়ে নেওয়ার জন্য বসে থাকে হ্যাকাররা।
• শিশুর ছবি পোস্ট করার সময় স্থান, যেমন স্কুল বা পার্কের নাম লেখা ঠিক নয় ।
• স্কুলের পোশাকে বা শিশুর গোসলের ছবি একেবারেই না।
• হরহামেশা ছবি পোস্ট না করাই ভালো। নিজের বন্ধু তালিকার মধ্যেও কারও অসৎ উদ্দেশ্য থাকতে পারে।
• কম্পিউটার বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক ডিভাইসে প্রাইভেসি সেটিং ভালো করে বুঝে নিয়ে তবেই সেটা ব্যবহার করতে হবে।
সবার মনে রাখতে হবে, শিশুরও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বা প্রাইভেসির বোধ আছে।
গওহার নঈম ওয়ারা গবেষক