‘শিক্ষকেরা সাধারণ মানুষ নয়, তাই যোগ্যতা ছাড়া শিক্ষকতা পেশা গ্রহণ করা কাম্য নয়’—জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলের এই বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। ওই দেশের বিচারক, চিকিৎসক ও প্রকৌশলীরা যখন সে দেশের সর্বোচ্চ বেতনভোগী শিক্ষকদের সমতুল্য বেতন প্রত্যাশা করে তা দেওয়ার অনুরোধ জানান, তখন ম্যার্কেল তাঁদের বলেন, ‘যাঁরা আপনাদের শিক্ষাদান করেছেন, তাঁদের সঙ্গে কীভাবে আপনাদের তুলনা করি?’
সংগত কারণেই শিক্ষকের সামাজিক অবস্থান ও মর্যাদার কথা বলতে গেলে যোগ্যতা, দায়িত্ব ও কর্তব্যের বিষয়টি সামনে আসে। তাই দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে চাই, শিক্ষককে হতে হবে গবেষণাধর্মী ও সৃষ্টিশীল। প্রশ্ন হলো এই মহান পেশার প্রতি শিক্ষকেরা কতটুকু যত্নবান? কতটুকু নিষ্ঠাবান? কতটুকু আন্তরিক? এসব বিষয়ে শিক্ষকদের আত্মবিশ্লেষণের এখনই উপযুক্ত সময়।
১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে সর্বক্ষেত্রেই পুনর্গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। শিক্ষকদের জন্যও শুরু হয় নতুন ভাবনা। দুই বছর পর ১৯৪৭ সালে ইউনেসকোর এক সভায় বিশ্বের শিক্ষকদের জন্য একটি ‘সনদ’ প্রণয়নের বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করা হয়। ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা ঘোষণা করে, ‘শিক্ষা লাভ মানুষের মৌলিক অধিকার এবং ব্যক্তিত্ব বিকাশের হাতিয়ার’। এরই ফলে ১৯৫২ সালে বিশ্ব শিক্ষক সংঘ (ডব্লিউসিওটিপি) গঠিত হয়। এরপর বিশ্ব শ্রম সংস্থার (আইএলও) উদ্যোগে অনুষ্ঠিত বিশেষজ্ঞদের এক সভায় শিক্ষকদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা এবং তার সমাধানের জন্য কিছু প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।
তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৬ সালের ৫ অক্টোবর ইউনেসকোর এক সভায় বিশ্বের শিক্ষকতা পেশার জন্য কী দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং কী অধিকার ও মর্যাদা, তার জন্য ১৪৬ ধারা-উপধারাবিশিষ্ট একটি সুপারিশমালা প্রণয়ন করা হয়। ইউনেসকো বা আইএলওর সুপারিশকেই ‘শিক্ষক সনদ’ বলা হয়। বিশ্বের ১৭২টি দেশের ২১০টি শিক্ষক সংগঠনের প্রতিনিধিত্বশীল সংস্থা এডুকেশন ইন্টারন্যাশনালের ক্রমাগত অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৪ সালে অনুষ্ঠিত ইউনেসকোর ২৬তম অধিবেশনে গৃহীত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে ইউনেসকোর তৎকালীন মহাপরিচালক ড. ফ্রেডারিক মেয়রের যুগান্তকারী ঘোষণার ফলে ওই সময় থেকে প্রতিবছরের ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালিত হয় এবং বিশ্বের সব দেশে ‘শিক্ষক সনদ’ বাস্তবায়নের আহ্বান জানানো হয়।
চলমান কোভিড-১৯ মহামারির সংকটকালে ইউনেসকো গতিশীল মনের অধিকারী, কর্তব্যনিষ্ঠ, জ্ঞানবান নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষকসমাজের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ২০২১–এর বিশ্ব শিক্ষক দিবসে মূল বিষয় নির্ধারণ করেছে ‘শিক্ষক: সংকটে নেতৃত্ব দেওয়া, ভবিষ্যৎকে নবতরভাবে কল্পনা করা।’ দিবসটি উদ্যাপনকালে সারা বিশ্বের শিক্ষকেরা অতীতের সব অর্জন ও ব্যর্থতার সমীক্ষা করবেন। সেই সঙ্গে বিশ্বব্যাপী শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার নিয়ে সম্মিলিতভাবে সচেষ্ট হবেন, যাতে কেউ শিক্ষার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয়। এ কথা বলা নিশ্চয় অত্যুক্তি হবে না যে অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় কোভিড-১৯-এ শিক্ষাব্যবস্থা এক সংকটকাল অতিক্রম করছে, আর এ জন্য শিক্ষাব্যবস্থা এবং শিক্ষকতার চ্যালেঞ্জকে অতিমাত্রায় সম্প্রসারিত করেছে।
আমাদের শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নের প্রশ্নে কিছুটা আলোকপাত করতে চাই। শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়ন ও শিক্ষা উপকরণ দেওয়া হয় সত্য। কিন্তু শিক্ষকের মানোন্নয়ন ছাড়া শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব নয়। সে জন্য প্রয়োজন প্রগতিশীল, মেধাবী ও সৃজনশীল ব্যক্তিদের শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করা। শিক্ষককে জ্ঞানসমৃদ্ধ, কুশলী ও দক্ষ রূপে গড়ে তোলার জন্য শিক্ষকতা জীবনের প্রথম থেকেই প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও গবেষণাকর্মের প্রয়োজনীয় সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। শিক্ষকের ন্যায্য অধিকার ও মর্যাদার কথা বলতে গেলে বলতে হয়, বিষয়টি চরমভাবে উপেক্ষিত। উল্লেখ্য, আমাদের গোটা শিক্ষাব্যবস্থার প্রায় ৯৫ ভাগই পরিচালনা করে বেসরকারি শিক্ষক, আর একটি স্বাধীন দেশের জন্য বেসরকারি শিক্ষকতার অবস্থা অত্যন্ত লজ্জাজনক।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ও পাকিস্তান শাসনামলের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি দুটি ধারায় বৈষম্যমূলক শিক্ষাব্যবস্থা চলছে। একটি স্বাধীন দেশে কোনোক্রমেই এই ধরনের বৈষম্য থাকা উচিত নয়। তাই স্বাধীনতা লাভের পর শিক্ষকসমাজের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বৈষম্যের অবসানকল্পে শিক্ষাব্যবস্থার সব স্তরকে জাতীয়করণের মাধ্যমে এক ও অভিন্ন ধারায় রূপান্তর করতে সরকার নীতিগতভাবে অঙ্গীকার করলেও আজও তা বাস্তবায়িত হয়নি। শিক্ষকতা পেশা সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দাবি রাখলেও অবহেলা ও অবজ্ঞার ফলে শিক্ষকতা পেশা ক্রমেই মেধাবীদের আকর্ষণ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। সেই কারণে ‘শিক্ষা সার্ভিস কমিশন’ গঠন করে অভিন্ন নিয়োগ নীতিমালায় মেধাসম্পন্ন দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন। তেমনিই সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকদের বৈষম্য দূর করে যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বেসরকারি শিক্ষকদের সরকারি শিক্ষকদের অনুরূপ নিয়মিত বেতন-ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে প্রাইভেট টিউশনি, কোচিং বা অন্য কোনো বাড়তি কাজের দ্বারা অর্থ উপার্জন করতে গিয়ে নিজ দায়িত্ব পালনে বাধার সম্মুখীন হতে না হয়।
এখনো আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় বেসরকারি শিক্ষকদের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা থাকলেও সঠিক মূল্যায়ন হয় না। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটিতে রাজনীতিকদের অন্তর্ভুক্ত করার ফলে এবং পরিচালনা কমিটি গঠনে অসংগতিপূর্ণ নীতিমালা থাকার কারণে বেসরকারি শিক্ষকদের চাকরির কোনো নিরাপত্তা নেই। যেহেতু এখন সরকার বেসরকারি শিক্ষকদের বেতনের প্রারম্ভিকের শতভাগ (মূল বেতন) ও প্রয়োজনীয় অন্যান্য ভাতার আংশিক প্রদান করছেন, তাই শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ গড়ে তোলার জন্য অবিলম্বে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটি প্রথা বিলুপ্ত করে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনুরূপ নিয়মে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে হবে।
কোনো বঞ্চনা নয়, করুণা নয়, বরং শিক্ষার গুণগত মান বিকাশে শিক্ষকতা পেশার প্রতি ন্যায়বিচার এবং সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। বিশ্ব শিক্ষক দিবসে এটাই প্রত্যাশা।
● অধ্যাপক মোহাম্মদ মাজহারুল হান্নান বাংলাদেশ অধ্যক্ষ পরিষদের সভাপতি ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক কোষাধ্যক্ষ