২০১৮ সালের ৩ জুলাই দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা এবং লাঞ্ছনার প্রতিবাদে আমি নগ্নপদে নীরব প্রতিবাদের ডাক দিয়েছিলাম। আমার প্রিয় ক্যাম্পাস রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন কোটা সংস্কার আন্দোলনে যোগ দেওয়ায় এক নিরীহ সাধারণ ছাত্র তরিকুলকে হাতুড়ি দিয়ে নির্মমভাবে পিটিয়ে তার কোমরের হাড় ভেঙে দেওয়া হয়েছিল, তার রক্তে মতিহারের সবুজ চত্বর রক্তাক্ত হয়েছিল, সেদিন একজন শিক্ষক হিসেবে নীরব আর নির্বিকার থাকতে পারিনি। তাই সব ভয়, সব বাধা পেরিয়ে সেদিন নগ্ন পায়ে সেই নীরব প্রতিবাদের ডাক দিয়েছিলাম। সেদিনের রেশ ধরে দেশের অনেক পত্রিকা সোচ্চার হয়েছিল। অনেকে কলাম লিখেছিলেন। তাঁদের মধ্যে লন্ডন থেকে সাংবাদিক কামাল আহমেদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রয়াত অধ্যাপক তারেক শামসুর রেহমানও লিখেছিলেন। সবার এই সম্মিলিত সোচ্চারে সেবারের মতো ছাত্রলীগকে থামানো গেলেও আসলে তারা মোটেও থামেনি; বরং দিন দিন আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। আবরার হত্যাসহ অসংখ্য ঘটনা তারই সাক্ষ্য বহন করে।
আবার মনে হয় সময় এসেছে আমাদের সোচ্চার হওয়ার। একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশে কোনো একটি ছাত্রসংগঠন শিক্ষাঙ্গনে যা খুশি তাই করে যাবে, তার ন্যায়সংগত প্রতিবাদ হবে না, প্রতিকার হবে না, এটা হতে পারে না।
সাম্প্রতিক কালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারদলীয় এ ছাত্রসংগঠন আবাসিক হলের সিট-বাণিজ্য নিয়ে চরম নৈরাজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। একের পর এক তারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর চড়াও হয়ে তাদের হল থেকে বিতাড়িত করছে। গত মাসে আমার বিভাগের এক শিক্ষার্থীকে তার কক্ষ থেকে বিছানাপত্র ফেলে দিয়ে সেখানে অন্যকে তুলে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে, তার আগে আরও এক ছাত্রের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনা বিস্তারিতভাবে জাতীয় পত্রিকাসহ সংবাদমাধ্যমে এসেছে। প্রশাসন কখনো কখনো ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীকে বড়জোর অন্য রুমে তুলে দেয়। পৃথিবীর কোনো সভ্য সমাজে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে এ রকম নৈরাজ্য, এ রকম অসভ্যতা আছে কি না, আমার জানা নেই।
কিছুদিন আগে শেষ বর্ষের এক শিক্ষার্থী এসে অত্যন্ত দুঃখভারাক্রান্ত মনে জানাল, পরীক্ষার মধ্যে প্রায়ই অনেক রাতে হলের জুনিয়ররা এসে কবে পরীক্ষা শেষ হবে খোঁজ নিতে থাকে। পরীক্ষা শেষ হলে সঙ্গে সঙ্গে সেখানে একজনকে তারা তুলে দেবে। একবার এক শিক্ষার্থী এসে বলল, স্যার, হলে সিট হয়েছে, কিন্তু আমার রুমের সিট দখল হয়ে আছে, আমাকে উঠতে দিচ্ছে না। আমি পরামর্শ দিলাম হলের প্রাধ্যক্ষের কাছে গিয়ে বলতে। কদিন পর এসে সে জানাল, তিনি বলেছেন, আমার দায়িত্ব ছিল তোমাকে সিট দেওয়া, দিয়েছি; এখন তোমার দায়িত্ব সিটে ওঠা। কিন্তু হল প্রশাসন এ ক্ষেত্রে আমার কাছে মনে হয়েছে অনেকটাই অসহায় এবং কিছুটা এড়িয়ে চলার পন্থা অবলম্বন করে।
এসব দেখেশুনে খুব কষ্ট পাই। নিজের কাছে নিজেকে অসহায় মনে হয়। ৪ জুন ফেসবুকে লিখেছিলাম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে আবাসিক হলে যে সিট-বাণিজ্য চলছে, তার প্রতিবাদে এবং শিক্ষার্থীদের ন্যায্য অধিকার আদায়ে সাধারণ শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের নিয়ে প্রয়োজনে অনশনে বসব! এ পোস্টে একজন লিখেছে, ‘জন্ম আমার আজন্ম পাপ জন্মেছি এই দেশে। এর বেশি কিছু বলার সুযোগ নেই স্যার। বাবা-মা অনেক আশা নিয়ে পাঠিয়েছে, তাদের কাছে মৃত লাশ হয়ে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে নেই স্যার। তাই একজন সাধারণ শিক্ষার্থী হিসেবে সব মুখ বুজে সহ্য করা ছাড়া কিছু করার নেই।’ আরেকজন এ পরিস্থিতির জন্য মূলত শিক্ষকদেরই
(সবাই নন) দায়ী করেছে। তার মতে, যাঁদের (শিক্ষকদের) নীতির ওপর অটল থাকার কথা, তাঁরাই আজ নোংরা রাজনীতির কাছে সর্বস্ব বিকিয়েছেন। এক শিক্ষার্থী বলেছে, ‘আগে শুনেছি, যাদের রেজাল্ট ভালো, তাদের জন্য সিঙ্গেল রুম বরাদ্দ। কিন্তু ক্যাম্পাসে আসার পর দেখলাম পুরো বিপরীত।’
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, সংবাদমাধ্যম ও ব্যক্তিগত আলাপচারিতার মাধ্যমে যে বিষয় পরিষ্কার, তা হলো হলের সিট নিয়ে অনেক দিন থেকে একটি ছাত্রসংগঠন নৈরাজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। যারা এসব হীন ও জঘন্য কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত, যারা সংগঠনের নাম করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের অধিকার থেকে বঞ্চিত কিংবা উৎখাত করে, তারা ছাত্র নামধারী সন্ত্রাসী। এ নৈরাজ্যের প্রতিবাদে ১৩ জুন আমরা কয়েকজন শিক্ষক, দুজন অভিভাবক এবং কিছু শিক্ষার্থী সিনেট ভবনের সামনে প্যারিস রোডে দাঁড়িয়েছিলাম। সেদিন মানববন্ধনে উপস্থিত দুজন বীর মুক্তিযোদ্ধা অভিভাবক বলেছিলেন, শিক্ষাঙ্গনের এই নৈরাজ্যে তাঁরা ভীষণ লজ্জিত এবং ব্যথিত। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও তাঁরা সেই একই পরিবেশ দেখতে পাচ্ছেন। আক্ষেপ নিয়ে তাঁরা বললেন, তাঁরা কি এই বাংলাদেশ দেখতে চেয়েছিলেন?
আমার অনেক ছাত্র ছাত্রলীগ করে। তাদের মধ্যে মানবতা দেখেছি, বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা দেখেছি, দেশের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা দেখেছি। তবে তাদের মধ্যে যে এক দুর্বৃত্তশ্রেণি তৈরি হয়েছে, এ বিষয়ে ছাত্রলীগকে সচেতন হতে হবে, দায় নিতে হবে। তাদের রুখে দিতে হবে। যে সংগঠন বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া, যে সংগঠন মুক্তিযুদ্ধে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছে, তাদের এই অবনমন দুঃখজনক ও নিঃসন্দেহে জাতির জন্য হতাশার।
ভয়ের সংস্কৃতি কার্যকর রেখে সবার মুখ বন্ধ করার যে নীতি সর্বত্র দেখা যাচ্ছে, সেখান থেকে ফিরে আসার সময় হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আবাসিক হলের সিট-বাণিজ্য বন্ধে শিক্ষক হিসেবে আমার দায় রয়েছে। দায় রয়েছে ছাত্র, অভিভাবক বা সমাজের সবার।
● ড. ফরিদ খান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক