গত বছর ঠিক এই সময়ে হাঙ্গামার কেন্দ্রে ছিল লিবিয়া এবং ভূমধ্যসাগর। তুরস্কের বিরুদ্ধে গ্রিকদের সমর্থনে যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়েছিল ফরাসিরা। সমুদ্রসীমা রক্ষার নামে ইউরোপকে আঙ্কারার বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রায় রাজি করিয়ে ফেলেছিলেন মাখোঁ। ঠিক প্রায় এক বছর পর লিবিয়ায় আজ আর যুদ্ধ নেই। মানুষ ঘরে ফিরেছে। বিদ্যুৎ, খাবার সরবরাহ স্বাভাবিক হয়েছে। পাঠক প্রশ্ন করতে পারেন, এই এক বছরের মধ্যে কী এমন ঘটল যে আঙ্কারার বিরুদ্ধে আর যুদ্ধের হুংকার দিচ্ছেন না মাখোঁ। উত্তরটা সোজা: লিবিয়ার যুদ্ধ লিবিয়ার মানুষের ছিল না। এটা ছিল পশ্চিমা, বিশেষ করে ফরাসিদের চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ। আঞ্চলিক ও রাজনৈতিক কারণে আজ যুদ্ধ থেমেছে সত্য, তবে যেকোনো মুহূর্তে আবার শুরু হতে পারে। অর্থনৈতিক স্বার্থে বর্তমানে সবাই যুদ্ধের ময়দানে না লড়ে আলোচনার টেবিলে লড়ছেন।
মার্কিন সমর্থন আর চাপে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় গঠিত হয়েছে নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। প্রেসিডেন্ট হয়েছেন মোহাম্মদ ইউনুস মানফি আর প্রধানমন্ত্রী আবদুল হামিদ মোহাম্মদ দাবিবাহ। আগামী ২৪ ডিসেম্বর এই সরকারকে নির্বাচন করতে হবে। মানফি আর দাবিবাহ দুজনই আঙ্কারার ঘনিষ্ঠ, আবার পশ্চিমেও তাঁদের গ্রহণযোগ্যতা আছে। উভয়েই নির্বাচিত হয়ে আঙ্কারা গেছেন। চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন। তবে মানফি-দাবিবাহর আঙ্কারা-ঘনিষ্ঠতা এবং আঞ্চলিক রাজনীতির হিসাব-নিকাশ লিবিয়ায় স্থায়ী শান্তি নষ্ট করতে পারে।
পাঠকের নিশ্চয়ই মনে আছে, ২০১১ সালে ন্যাটো গাদ্দাফির বিরুদ্ধে লিবিয়ায় বোমাবর্ষণ শুরু করে। আকাশ থেকে যখন ন্যাটোর বোমা বর্ষিত হচ্ছিল, ব্রাদারহুডের একটি অংশ তখন জমিন থেকে গাদ্দাফির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিল। এই বোমাবর্ষণে সবচেয়ে উৎসাহী ছিলেন তৎকালীন ফরাসি প্রেসিডেন্ট সারকোজি। ‘অপারেশন ইউনিফাইড প্রটেক্টর’কে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ থেকে রকেটের গতিতে পাস করিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। সারকোজির বিরুদ্ধে অভিযোগ, নির্বাচনী প্রচারণার জন্য গাদ্দাফির কাছ থেকে প্রচুর অর্থ নিয়েছেন তিনি। ওবামা তাঁর আত্মজীবনী আ প্রমিজড ল্যান্ড সারকোজি এবং তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের লিবিয়াসম্পর্কিত সিদ্ধান্তগুলোর সমালোচনা করেছেন। ওবামার পর লিবিয়ার গৃহযুদ্ধ বারবার রং বদলেছে। পশ্চিম আর সৌদি-আমিরাত বলয়ের লাগাতার তাগাদা সত্ত্বেও হাফতারের ত্রিপোলি দখল অভিযান ব্যর্থ করে দিয়েছিল তুরস্কের ড্রোন বৃষ্টি। নিন্দুকেরা বলেন আঙ্কারার ড্রোন বৃষ্টি হাফতার এবং তাঁর আন্তর্জাতিক সঙ্গী, বিশেষ করে সৌদি এবং ফরাসিদের আলোচনার টেবিলে বসতে বাধ্য করে।
পরিবর্তিত এই পরিস্থিতিতে লিবিয়ায় স্থায়ী শান্তি এবং সামাজিক নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা অনেকগুলো শর্তের ওপর নির্ভরশীল। এগুলোর যেকোনো একটি ভঙ্গ হলে পশ্চিমের উসকানিতে লিবিয়ায় আবার গৃহযুদ্ধ লেগে যেতে পারে।
প্রথমত, লিবিয়া-তুরস্ক সমুদ্র চুক্তি। গাদ্দাফির বেঁচে থাকাটা সারকোজির জন্য যতটা বিপজ্জনক ছিল, বর্তমানে ফরাসিদের জন্য ঠিক ততটাই বিপজ্জনক লিবিয়া-তুরস্ক সমুদ্র চুক্তি। প্রধান কারণ গ্রিস এবং এরদোয়ানের ক্রমাগত পশ্চিমা ও ফরাসি রাডারের বাইরে চলে যাওয়া। ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর লিবিয়া ও তুরস্ক একটি সমুদ্রসীমা চুক্তি করে। এই সমুদ্র চুক্তি ইসরায়েল, গ্রিক সাইপ্রাস, মিসর, লেবাননসহ পূর্ব ভূমধ্যসাগরতীরবর্তী দেশগুলোর স্বাক্ষরিত ইস্টমেড গ্যাস পাইপলাইনকে অকেজো করে দিয়েছে। ইস্টমেড গ্যাস পাইপলাইন পূর্ব ভূমধ্যসাগরের দেশগুলোর গ্যাস ইউরোপের বাজারে নিয়ে যেত। এই চুক্তি বাতিল করতে তাই উঠেপড়ে লেগেছ ইসরায়েল-ফরাসি-ইতালি গং। এই বলয়ের বলি হয়েছে গ্রিস। মূলত ইসরায়েল-ফরাসি-ইতালি গং লিবিয়া-তুরস্ক সমুদ্রসীমা চুক্তি বাতিল করে গ্রিস-লিবিয়া সমুদ্রসীমা চুক্তি বাস্তবায়ন করতে চায়। লিবিয়া-তুরস্ক চুক্তি বাতিল করতে সম্প্রতি ত্রিপোলি গিয়েছিলেন গ্রিক প্রধানমন্ত্রী কিরিয়াকোস মিৎসোতাকিস। কিন্তু মিৎসোতাকিসের মুখের ওপর না করে দিয়েছেন মানফি। আদতে ইউরোপের প্রায় দেউলিয়া হয়ে যাওয়া দেশ গ্রিসের তেল-গ্যাস উত্তোলনের ক্ষমতা নেই। গ্রিসের নামে এই তেল-গ্যাস উত্তোলন করবে ফরাসি ‘টোটাল’ আর ইতালির ‘এনা’। বিলিয়ন ডলারের এই বাণিজ্য কোনোভাবেই হাতছাড়া করতে চায় না ফরাসিরা।
দ্বিতীয়ত, মুসলিম ব্রাদারহুড। মুরসির মৃত্যুর পর যে ব্রাদারহুড কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল, সেই ব্রাদারহুডই আজ উত্তর আফ্রিকায় ধীরে ধীরে আবার সংঘবদ্ধ হচ্ছে। বিশেষ করে তিউনিসিয়ায় ডিসেম্বরে যদি ব্রাদারহুড প্রার্থী জয়ী হন, তাহলে আবার লিবিয়ায় রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হবে। তিউনিসিয়ার পাশাপাশি লিবিয়ায় ব্রাদারহুডের উপস্থিতি মানবেন না সিসি। তাই আসন্ন নির্বাচনে ব্রাদারহুডের প্রার্থীর শক্ত অবস্থান লিবিয়াকে আবার যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে পারে।
তৃতীয়ত, হাফতার ও আগিলা সালেহ। ব্রাদারহুডের রাজনীতির ওপর অনেকটাই নির্ভর করছে হাফতার ও আগিলা সালেহের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, যদি ব্রাদারহুড তিউনিসিয়ার সরাসরি প্রার্থী না দিয়ে পর্দার আড়ালে থেকে কোনো লিবারেল প্রার্থীকে সমর্থন দেয়, তাহলে আগিলা-হাফতার জুটির রাজনৈতিক প্রভাব হ্রাস পাবে। আগিলা-হাফতার জুটির প্রস্থান আমিরাত-সৌদি-মিসর বলয়কেও নতুন করে রাজনৈতিক ছক কাটতে বাধ্য করবে। তবে ব্রাদারহুড ২০১৩ সালে মিসরে যে ভুল করেছিল, সেই একই ভুল যদি ২০২১ সালে লিবিয়ায় করে, তাহলে আগিলা-হাফতার জুটির ভবিষ্যৎ সিসির মতোই উজ্জ্বল।
আমিরাত-সৌদি-মিসর বলয় যেকোনো মূল্যে আগিলা-হাফতার জুটিকে টিকিয়ে রাখতে চায়। সম্ভবত আসন্ন নির্বাচনে আগিলা কিংবা আগিলার সমর্থিত কেউ হবেন সৌদি বলয়ের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী। আগিলা জয়লাভ করলে সমস্যা নেই; সবাই মেনে নিতে বাধ্য থাকবে। কিন্তু ব্রাদারহুড কিংবা আঙ্কারা-সমর্থিত প্রার্থী জয়লাভ করলে সৌদি ও পশ্চিমারা, বিশেষ করে ফরাসিরা নতুন করে হাঙ্গামা উসকে দেবে, ঠিক যেমনটা ২০০৭ সালে হামাস আর ২০১৩ সালে মুরসির ক্ষেত্রে ঘটেছিল। তাই লিবিয়ার শান্তি নিয়ে এখনই আশাবাদী হওয়ার সুযোগ নেই।
রাহুল আনজুম মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক গবেষক