কাজাখস্তানে রাশিয়ার হস্তক্ষেপ মঙ্গল নাকি অভিশাপ—এর উত্তর যাকে জিজ্ঞাসা করা হবে, তার ওপর নির্ভর করবে। মধ্য এশিয়ায় রাশিয়ার সামরিক অভিযান সমর্থন করা যায় না। পূর্ব ইউক্রেনের যে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি, কাজাখস্তানে ঘটনাপ্রবাহ তার থেকে ভিন্ন তাৎপর্য নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে সেখানে বড় ধরনের রাজনৈতিক অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে। এ প্রেক্ষাপটে রাশিয়া সেখানে সেনাবাহিনী মোতায়েন করেছে। পশ্চিমাদের বিভ্রান্ত চোখ এ ঘটনায় মনে করতে পারে, ইউক্রেন থেকে তাদের দৃষ্টি সরিয়ে নেওয়ার জন্য রাশিয়া এ ধরনের ছলনার আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত যতটা আঁচ করা যাচ্ছে, তাতে বলা যায়, কাজাখস্তানে ভিন্ন কিছু ঘটছে।
সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর রাশিয়ার ক্ষমতায় উদারপন্থী বরিস ইয়েলৎসিন কিংবা স্বৈরশাসক ভ্লাদিমির পুতিন যে-ই আসুক না কেন, রাশিয়া সীমান্তের সুরক্ষা নিয়ে তাঁদের মধ্যে ভীষণ উদ্বেগ দেখা গেছে। ১৯৯০-এর দশকে পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাবেক দেশগুলোতে ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের ‘জোড়া সম্প্রসারণ’ মস্কোকে ভীষণ উদ্বিগ্ন করে তোলে। মস্কোর আরও বড় উদ্বেগ মধ্য এশিয়া ঘিরে। নিজেদের প্রভাব হ্রাস পাবে কি না, সে শঙ্কা তাদের তাড়া করে ফেরে।
জ্বালানিসমৃদ্ধ কাজাখস্তানসহ মধ্য এশিয়ায় নিয়ন্ত্রণ হারানোর যে শঙ্কা, তা থেকেই দেশগুলোর সঙ্গে বেশ কয়েকটি বহুপক্ষীয় জোট গঠন করেছে রাশিয়া। এর মধ্যে কমনওয়েলথ অব ইনডিপেনডেন্ট স্টেট (সিআইএস), সেন্ট্রাল ট্রিয়েটি সিকিউরিটি অর্গানাইজেশন (সিএনটিও), ইউরেশিয়ান ইকোনমিক ইউনিয়ন (ইএইইউ) অন্যতম।
এত দিন ধরে রাশিয়ার মনোযোগের কেন্দ্র ছিল পূর্ব ইউক্রেন, কিন্তু হঠাৎ করেই কাজাখস্তানের শান্ত পরিবেশ বদলে পুরোপুরি বিশৃঙ্খল হয়ে উঠেছে। বৈশ্বিক ক্ষমতাকাঠামোর এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে নিজেদের যেকোনো দুর্বল অবস্থান রাশিয়ার জন্য বড় বিপর্যয়ের কারণ হয়ে উঠতে পারে। সে জন্য পুতিন ‘বহুজাতিক শান্তিরক্ষী’সেনাদের কাজাখস্তানের অসন্তোষ থামাতে ও শান্তি–শৃঙ্খলা ফেরাতে নিয়োগ করেছেন। রাশিয়ার সৈন্যদের কাজাখস্তান অভিযানের মধ্য দিয়ে বাকি বিশ্বকে পরিষ্কার একটা বার্তা দিচ্ছে মস্কো। সেটা হলো, অন্য কোনো বিদেশি শক্তি সেখানে প্রভাব বিস্তার করুক, সেটা রাশিয়া কোনোভাবেই চায় না।
কাজাখস্তানে রাশিয়ার সেনাবাহিনীর এই হস্তক্ষেপ চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বিবেচনায় খুবই জটিল একটি বিষয়। মৌলিক মতের মিল না থাকা সত্ত্বেও চীনের সঙ্গে রাশিয়ায় সবচেয়ে সেরা বন্ধুত্ব রয়েছে। আবার ইউরোপের বাজার ধরার জন্য চীন ব্যয়বহুল বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) যে মহাপ্রকল্প নিয়েছে, সেটার সেতুবন্ধ হচ্ছে মধ্য এশিয়া। নিজেদের বিআরআই প্রকল্প সফলতার সঙ্গে শেষ করতে হলে মধ্য এশিয়ায় রাশিয়া যাতে তাদের বাধা না হয়ে দাঁড়ায়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে চীনকে। ইউরোপ-সংলগ্ন সীমান্তে কোনো দেশে নিজেদের প্রভাব ক্ষুণ্ন হচ্ছে কি না, তা নিয়ে ভীষণ উৎকণ্ঠা রয়েছে পুতিনের।
বিশ্বমঞ্চে রাশিয়া কত খারাপ আচরণ করছে, সেটার আরেকটি নজির হিসেবে কাজাখস্তানে রাশিয়ার এ হস্তক্ষেপকে দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরবে পশ্চিমারা। যদিও এখন পর্যন্ত কাজাখস্তানে রাশিয়ার হস্তক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে ওঠেনি। আবার ইউরোপ ইউক্রেন ছেড়ে কাজাখস্তানের দিকে কতটা নজর দেবে, সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না।
চীনের বিআরআই-কে অবমূল্যায়ন
কাজাখস্তানে রাশিয়ার সেনাবাহিনীর এই হস্তক্ষেপ চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বিবেচনায় খুবই জটিল একটি বিষয়। মৌলিক মতের মিল না থাকা সত্ত্বেও চীনের সঙ্গে রাশিয়ায় সবচেয়ে সেরা বন্ধুত্ব রয়েছে। আবার ইউরোপের বাজার ধরার জন্য চীন ব্যয়বহুল বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) যে মহাপ্রকল্প নিয়েছে, সেটার সেতুবন্ধ হচ্ছে মধ্য এশিয়া। নিজেদের বিআরআই প্রকল্প সফলতার সঙ্গে শেষ করতে হলে মধ্য এশিয়ায় রাশিয়া যাতে তাদের বাধা না হয়ে দাঁড়ায়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে চীনকে। ইউরোপ-সংলগ্ন সীমান্তে কোনো দেশে নিজেদের প্রভাব ক্ষুণ্ন হচ্ছে কি না, তা নিয়ে ভীষণ উৎকণ্ঠা রয়েছে পুতিনের। একই সঙ্গে দক্ষিণ ও পূর্ব সীমান্তের দিকেও প্রখর দৃষ্টি রয়েছে তাঁর। মধ্য এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর ইসলামি চরমপন্থীদের উত্থান হচ্ছে কি না, তা নিয়েও উদ্বিগ্ন তিনি।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে মস্কো ও বেইজিংয়ের মধ্যে ভালো সম্পর্কের একটা স্বর্ণযুগ চলছে বলে বাইরে থেকে দেখলে মনে হয়। এ ক্ষেত্রে রাশিয়ার প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নীতি ধীরে ধীরে ইউরেশিয়ান দুই পরাশক্তির জোট অনিবার্য করে তুলেছে। অবশ্য এটার মানে এই নয় যে ওয়াশিংটন চীন ও রাশিয়ার মধ্যকার সম্পর্কের যে জটিলতা, সেটা উপেক্ষা করে থাকবে। ইউরেশিয়ান দুই পরাশক্তির মধ্যে বন্ধন এখনো সোজা পথে আছে কিংবা স্থিতিশীল অবস্থায় পৌঁছেছে, তা বলা যাবে না। কাজাখস্তানে রাশিয়ার সামরিক পদক্ষেপ ইউরেশিয়ান অঞ্চলে ভূ-অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক ক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় চীনের যে কৌশল, সেটাতে গুরুতর বাধা সৃষ্টি করবে। রাশিয়ার নেতারা চীনের এ উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাচ্ছেন না।
ইএইইউ ও পুতিনের রাশিয়ান সাম্রাজ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা
২০১৬ সালে ইউরেশিয়ান ইকোনমিক ইউনিয়ন (ইএইইউ) প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ভ্লাদিমির পুতিন মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করেছিলেন। মধ্য এশিয়ার সাবেক সোভিয়েতভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে বেলারুশকে যুক্ত করে ও ইউক্রেনকে ভবিষ্যতে যুক্ত করার পরিকল্পনা করে পুতিন একুশ শতকের চরিত্র অক্ষুণ্ন রেখে পুরোনো রাশিয়ান সাম্রাজ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখছেন।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের অপ্রত্যাশিত প্রভাব ঠেকাতে এ জোট গঠন করা হয়েছে। নিজেদের ঐতিহ্যবাহী ওই অঞ্চলে চীনের বিআরআই সম্প্রসারণের যে উদ্যোগ, তাতে ভারসাম্য আনার প্রচেষ্টাও রয়েছে ইএইইউ গড়ার পেছনে। মস্কো তার একসময়কার মুখাপেক্ষী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে যত বেশিসংখ্যক রাষ্ট্রকে নিজেদের বৃহত্তর জোটে রাখতে চায়। যাতে করে নিজেদের অধীন দেশগুলোতে বেইজিং ভূরাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করতে না পারে। অন্যদিকে বেইজিং মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর ওপর রাশিয়া বড় রাষ্ট্রসুলভ ভূমিকা পালন করে সেটার বিরোধিতা করে।
জ্বালানি সম্পদের কারণে কাজাখস্তান রাশিয়ার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। বিপুল পরিমাণ জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদক এ দেশকে মস্কো ইএইইউভুক্ত অন্য দেশগুলোর সঙ্গে দর-কষাকষির একটা ক্ষেত্র হিসেবে নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে কাজাখস্তানে পুরোনো শাসকদের পতন ঠেকিয়ে মস্কো তাদের কাছ থেকে দেশটির উৎপাদিত এলএনজির (তরলীকৃত প্রাকৃতির গ্যাস) আরও বড় ভাগটা বাগিয়ে নিতে পারে। সেটা হলে জ্বালানিসংকটে থাকা ইউরোপের এলএনজি বাজারে মস্কো আরও বেশি প্রভাব বিস্তারের সুযোগ পাবে। বেইজিংয়ের ক্ষেত্রেও তারা সেই সুযোগ পাবে। কেননা, রাশিয়ার জ্বালানির ওপরে চীন অনেক বেশি নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে।
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
ব্রান্ডন জে ওয়াইকার্ট লেখক ও ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষক