রাঙামাটিতে কাপ্তাই হ্রদের পানি এখন বছরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় কম। জ্যৈষ্ঠের দাবদাহে এটাই স্বাভাবিক। রোদে পুড়ে বেড়ানোটা ক্লান্তিকর এ সময়, ফলে পর্যটকের ভিড় কম। কিন্তু নিরিবিলিতে প্রকৃতিকে উপভোগ করতে এই দাবদাহ উপেক্ষা করতে পারলে অন্য এক রাঙামাটিকে চেনা যায়। কেননা, এই জ্যৈষ্ঠেই তো প্রকৃতি তার যা কিছু ঐশ্বর্য, ফুলে-ফলে সবকিছু উজাড় করে দেয়। কয়েক দিন আগে এমনই এক গরমে রাঙামাটিতে গিয়ে চারদিকে মৌসুমি ফলের ঘ্রাণ, ‘বিজু এজো’ পাখির ডাক আর নানা রঙের ফুলের বৈচিত্র্যে মনটাকে রাঙিয়ে এলাম।
বোটে ওঠার আগে সদ্য খেত থেকে তুলে আনা রসাল আনারস খেতে খেতে দেখছিলাম যেন অতিকায় ক্যানভাসে আঁকা এক মহাকাব্যিক ছবি। হ্রদের তীরে অনন্ত সবুজের দিকে চোখ রেখে মনে হলো, কারা যেন বাংলাদেশের পতাকা সাজিয়ে রেখেছে। আসলে ওখানে ফুটেছে কৃষ্ণচূড়া। হ্রদের পাড় ধরে এগোতে এগোতে দেখেছি পারিজাত, কাঠগোলাপ, বিজু, শ্বেতকাঞ্চন, মোরগফুল, ঝুমকোলতা, বনজুঁই, কেতকীসহ নাম না জানা ফুলের বাহার। গ্রীষ্মের তাপের মধ্যেও প্রকৃতির এমন শোভা শীতে কিংবা অন্য সময় বিরল।
বর্ষায় রাঙামাটির আরেক রূপ। বর্ষাপ্রেমী কিছু লোক তখন বৃষ্টিভেজা পাহাড় আর হ্রদ দেখতে ছুটে আসবে। বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন ছাড়াও এখানে আবাসিক হোটেল ও মোটেল রয়েছে ৫৫টি। কাপ্তাই হ্রদের দ্বীপ ও পাড়ে আছে এক ডজন পর্যটন স্পট ও রিসোর্ট। রাঙামাটিতে প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ হাজার পর্যটক ঘুরতে আসেন। ভরা মৌসুমে সেই সংখ্যা ১৫ থেকে ৩০ হাজার।
ডিয়ার পার্কে পর্যটন হলিডে কমপ্লেক্সে গিয়ে দেখা হয় সেখানকার ব্যবস্থাপক সৃজন বড়ুয়ার সঙ্গে। তাঁকে বললাম, ঝুলন্ত সেতু আর হ্রদে কিছুক্ষণ বোটে চড়া ছাড়া আর কিছুই তো নেই। পর্যটকদের আকর্ষণ করে এমন সুযোগ-সুবিধা আর বাড়ছে না কেন? তিনি বললেন, ‘এখানে সুযোগ-সুবিধা আমরা বাড়াতে চাই। তার জন্য বিনিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন। প্রথমত, সৌন্দর্য বাড়ানো দরকার। ঝুলন্ত সেতুর দক্ষিণে চার একর খালি জমিতে শিশুপার্ক করে সেখানে বিনোদনমূলক বিভিন্ন রাইড স্থাপন করা যাবে। এতে পর্যটকদের দারুণ সময় কাটবে। তাতে পর্যটন করপোরেশনেরও আয় বাড়বে।’
পরিবেশবাদীরা বলেন, রাঙামাটি তার আপন সৌন্দর্যে ঐশ্বর্যময়। প্রকৃতি, জীব ও উদ্ভিদবৈচিত্র্যের চুল পরিমাণ ক্ষতি না করে সুষ্ঠু পরিকল্পনা করে এখানকার পর্যটনকে এক অনন্য মাত্রায় নিয়ে যাওয়া যায়। হ্রদ থেকে অনেক ওপরে, পাহাড়ের চূড়ায় চূড়ায় সংযুক্ত কেব্ল কারে চড়ে হ্রদ আর পাহাড়ের বিপুল নান্দনিক বিস্তার যদি একবার পাখির চোখে দেখতে পেতাম!
স্বাধীনতার পর থেকে পর্যটন করপোরেশন রাঙামাটিতে কাজ করছে। এর আগে ১৯৬৪ সালে পর্যটনের জন্য বর্তমানের জায়গাটি চিহ্নিত করেছিল তৎকালীন পাকিস্তান ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্ট। ১৯৭২ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সরকারের সময় বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন গঠিত হয়। ১৯৭৩-৭৪ সালে বোট ক্লাব নাম নিয়ে সীমিত আকারে কার্যক্রম আরম্ভ হয়। বর্তমানে পর্যটন করপোরেশন হোটেল-মোটেল, রেস্তোরাঁ, বার, ড্রিংকস কর্নার, নৌযান ভাড়া, গাড়ি পার্কিং, ট্যুর গাইড সার্ভিস, পর্যটনবিষয়ক ট্রেনিং প্রোগ্রাম, স্যুভেনির শপ, ঝুলন্ত সেতু তত্ত্বাবধান করে। নানা রকমের ইজারা ও ভাড়া দিয়ে এই কমপ্লেক্সের আয়ের খাত আছে ১৩টি।
এরপরও বলতে হয়, স্বাধীনতার পর থেকে এই দীর্ঘ পথচলায় খুব একটা উল্লেখযোগ্য দৃশ্যমান কিছু করতে পারেনি পর্যটন করপোরেশন। তবে ইদানীং অন্যান্য বেসরকারি উদ্যোক্তাদের নানা প্রকল্পের প্রতিযোগিতার মধ্যে সরকারি প্রতিষ্ঠানটির সেবার মান কিছুটা বেড়েছে, এ কথা পর্যটকেরাই বলেন। রাঙামাটিতে বেড়াতে আসা সাবেক মেরিনার প্রকৌশলী এস এম এ হান্নান বলেন, খাবারের মান আগের চেয়ে ভালো হয়েছে। হ্রদের ধারে কটেজগুলো সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন। তবে পাহাড় দেখে দেখে কতক্ষণ বসে থাকা যায়। আরও সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো দরকার। সময় কাটানোর উপকরণ চাই।
পর্যটনের বর্তমান সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে ব্যবস্থাপক বললেন, কমপ্লেক্সের ২৮ দশমিক ৫২ একর জমির মধ্যে ছোট-বড় ১৪টি ভবন আছে। আবাসিক কক্ষ ৮৮টি। তার মধ্যে ৪৪টি শীতাতপনিয়ন্ত্রিত। এ ছাড়া হানিমুন কটেজ, বার ভবন, লাক্সারি কটেজ, ড্রিংকস কর্নার, মিলনায়তনও রয়েছে। সব মিলিয়ে এখানে ১৭৬ জনের অবস্থানের সক্ষমতা রয়েছে। ভরা মৌসুমের জন্য এই সংখ্যা পর্যাপ্ত নয়। এই সুবিধাসহ পর্যটক-আকর্ষক সুবিধা বাড়াতে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পর্যটকদের আকর্ষণ করতে আমাদের কিছু পরিকল্পনা আছে। কিছু স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা, যেমন শিশুপার্ক স্থাপন, যেখানে ছোট-বড় রাইড, টয়ট্রেন, ওয়াটার রাইড থাকবে। বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের কাছে প্রস্তাব প্রেরণ করেছি। পার্কিং স্থানের উন্নয়ন, প্রচারণার ব্যবস্থা করার কথাও বলেছি।’
কিছু মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার কথাও জানালেন সৃজন। এগুলোর মধ্যে ঝুলন্ত সেতু ও মিলনায়তনকে যুগোপযোগী করা, সুইমিংপুল স্থাপন, ফোয়ারা স্থাপন, কেব্ল কার স্থাপন অন্যতম। এসব বাস্তবায়ন করা না গেলে পর্যটক যেমন বাড়বে না, তেমনি করপোরেশনের আয়ও বাড়বে না। বর্তমানে রাঙামাটি পর্যটন হলিডে কমপ্লেক্স বছরে তিন থেকে পৌনে চার কোটি টাকা আয় করে। এগুলোর উৎস হোটেল, রেস্তোরাঁ, ঝুলন্ত সেতুর দর্শনার্থীর ফি। সুবিধা বাড়লে এই আয়ও বাড়বে।
পরিবেশবাদীরা বলেন, রাঙামাটি তার আপন সৌন্দর্যে ঐশ্বর্যময়। প্রকৃতি, জীব ও উদ্ভিদবৈচিত্র্যের চুল পরিমাণ ক্ষতি না করে সুষ্ঠু পরিকল্পনা করে এখানকার পর্যটনকে এক অনন্য মাত্রায় নিয়ে যাওয়া যায়। হ্রদ থেকে অনেক ওপরে, পাহাড়ের চূড়ায় চূড়ায় সংযুক্ত কেব্ল কারে চড়ে হ্রদ আর পাহাড়ের বিপুল নান্দনিক বিস্তার যদি একবার পাখির চোখে দেখতে পেতাম!
● ওমর কায়সারপ্রথম আলোর চট্টগ্রাম কার্যালয়ের বার্তা সম্পাদক