বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) ২০১০-এর তৃতীয় বর্ধিত মেয়াদ ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২১ শেষ হতে যাচ্ছে। সিপিডিসহ সিভিল সোসাইটি সংগঠনগুলো এই আইনের পরিসমাপ্তি টানা বিশেষভাবে প্রয়োজন বলে মনে করে। কিন্তু গত ৬ আগস্ট মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে এই আইন পুনরায় ৫ বছরের জন্য বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান জাতীয় সংসদ অধিবেশনে ১৫ সেপ্টেম্বর এই আইন উপস্থাপিত হয়েছে এবং অতি দ্রুত ১৬ সেপ্টেম্বর এটি পাস হয়েছে।
আমরা মনে করি, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের সার্বিক স্থিতিশীল পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে আইনটি পুনরায় সময় না বাড়ালেই যথার্থ হতো। এই আইনের বারবার সময় বৃদ্ধির ফলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে অদক্ষতা, অপচয় ও ক্ষেত্রবিশেষে অপব্যবহারের সুযোগ তৈরি হচ্ছে।
জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহের এ বিশেষ আইন প্রবর্তিত হয়েছিল এক বিশেষ প্রেক্ষাপটে। দেশে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ব্যাপক ঘাটতির (বিদ্যুৎ উৎপাদন মাত্র ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট, ২০০৯) প্রেক্ষাপটে দ্রুত স্বল্পমেয়াদি বিদ্যুৎকেন্দ্র (কুইক রেন্টাল/রেন্টাল) স্থাপন ও বাস্তবায়নকে সুযোগ দিতে ২০১০ সালে এই আইন পাস হয়। প্রচলিত টেন্ডার প্রক্রিয়ার সময়ক্ষেপণ ও অন্যান্য আইনি জটিলতা এড়াতে এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়, যা ছিল সাময়িক। শুরুতে মাত্র ২ বছরের জন্য বলবৎ হলেও ২০১২ সালে তা পুনরায় ২ বছর, ২০১৪ সালে ৪ বছর এবং ২০১৮ সালে ৩ বছর বর্ধিত করে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বলবৎ করা হয়। এ সময়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের অধিকাংশ সিদ্ধান্ত এই আইনের আলোকে গৃহীত হয়। এই আইনের আলোকে যদিও সিদ্ধান্ত গ্রহণ ত্বরান্বিত করা গেছে, কিন্তু বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রতিযোগিতার পরিবেশ অনুপস্থিত থাকার কারণে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অদক্ষতার অভিযোগ রয়েছে। এ কারণে বিদ্যুৎ খাতে ব্যয় বেড়েছে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) লোকসান বেড়েছে—প্রতি কিলোওয়াট বিদ্যুৎ ব্যয় যতটা কমে আসবে বলে প্রত্যাশিত ছিল ততটা কমেনি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাড়তি ব্যয়ের দায় ভোক্তার ওপর বর্তেছে। সরকারের কাছে বিপিডিবির আর্থিক দায় বেড়েছে। এই মুহূর্তে বিপিডিবি সরকারের ক্যাশ ঋণগ্রহীতার ক্ষেত্রে সবার ওপরে অবস্থান করছে। বিদ্যুৎ খাতে অপরিকল্পিতভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্র বাড়ানোয় অতিরিক্ত ৫৬ শতাংশ বিদ্যুৎ রয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বিভিন্ন সময় নানা সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যা থেকে অনুমান হয়, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ঘাটতি সুফল থেকে বিদ্যুৎ খাতকে বঞ্চিত করছে।
প্রথমত, কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র জরুরি প্রয়োজনে স্বল্পমেয়াদি ২ থেকে ৩ বছরের জন্য স্থাপিত হওয়া সত্ত্বেও বর্তমানে ১ হাজার ৩৬০ মেগাওয়াটের ২৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে অর্ধেক ২০১৯-এর মধ্যকার সময়ে বাড়তি সময়ে চালু রয়েছে। বাকি অর্ধেক ২০২৪-এর মধ্যে বর্ধিত সময় নিয়ে চালু রয়েছে। শোনা যাচ্ছে, এসব কেন্দ্রের কোনো কোনোটির নবায়নের ব্যাপারে আলোচনা চলছে। এ সময়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র চুক্তি নবায়নের বিষয়ে সরকারের পক্ষে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ ছিল। যেমন কম রেটে বিদ্যুৎ ক্রয়ের সুযোগ, ক্যাপাসিটি পেমেন্টের বাধ্যবাধকতার শর্ত শিথিল করা ইত্যাদি।
বর্তমানে এ রকম কিছু কেন্দ্রের সময় বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, ‘বিদ্যুৎ ব্যবহার হলে বিদ্যুৎ দাম প্রদান’ শর্তে এবং কোনো ক্যাপাসিটি পেমেন্ট ছাড়া বিদ্যুৎ গ্রহণ। অথচ এসব কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র সরকার নীতিগতভাবে বন্ধের ঘোষণা দিয়ে আসছে। এমনকি অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ২০২৪-এর মধ্যে এসব কেন্দ্র অবসায়নের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এ মুহূর্তে এসব কেন্দ্রের পুনরায় সময় বর্ধিত করা নীতিগত অবস্থানের ব্যত্যয় হিসেবে পরিলক্ষিত হবে।
দ্বিতীয়ত, এই আইনের আলোকে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র যতটা গুরুত্ব পেয়েছে, সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন সে তুলনায় পিছিয়ে পড়েছে। বিগত এক দশকে বৃহদাকার সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন শুরু করতে দেখা গেছে। কিন্তু বাস্তবায়ন শ্লথ হয়ে পড়ায় কম খরচে বিদ্যুৎপ্রাপ্তি থেকে ভোক্তা বঞ্চিত হয়েছেন। অথচ এ সময়ে বেসরকারি খাতে ব্যয়বহুল বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রাধিকার পেয়েছে। আশঙ্কা হয়, প্রতিযোগিতার পরিবেশের অনুপস্থিতি এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিভিন্নমুখী চাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে কিছু ক্ষেত্রে বৈষম্যের পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।
তৃতীয়ত, এ সময়ে প্রাথমিক জ্বালানির ক্ষেত্রে দেশীয় গ্যাস অনুসন্ধান যথার্থ গতি পায়নি। বিভিন্ন সময়ে গ্যাস অনুসন্ধানে সিসমিক সার্ভে, ২ডি সার্ভে, মডেল পিসিআর চুক্তি প্রস্তুত এবং স্থলভাগে ও সমুদ্রভাগে গ্যাস অনুসন্ধান ইত্যাদি বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়ার কথা শোনা যায়। কিন্তু অজানা কারণে এর অনেকগুলোই বাস্তবায়িত হয়নি। ২ডি সিসমিক সার্ভের জন্য প্রাথমিকভাবে কোম্পানি মনোনয়নের পরও চুক্তি না হওয়া এবং সর্বনিম্ন দরদাতা হওয়ার পরও বাপেক্সের কাজের সুযোগ না পাওয়া ইত্যাদি। মূলত এ বিশেষ আইনের সুযোগে বিভিন্ন ধরনের প্রতিযোগিতামূলক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে মনে হয়।
চতুর্থত, সমুদ্রে বা স্থলভাগে গ্যাস অনুসন্ধান গতি বৃদ্ধি না হওয়া এবং সরকারি–বেসরকারি উদ্যোগে এলএনজি আমদানির সিদ্ধান্ত বর্তমানে দেশীয় গ্যাসের সরবরাহ কমে আসায় এলএনজি বাড়ছে, যা মোট সরবরাহের ১০ শতাংশের চেয়ে বেশি। উত্তরোত্তর এলএনজি আমদানি বাড়ছে। দেশে গ্যাস সরবরাহের যে ঘাটতি দেখা যাচ্ছে, তাতে ঘাটতি পূরণের লক্ষ্যে সমুদ্রবক্ষের ব্লকগুলোতে গ্যাস অনুসন্ধান জরুরি হয়ে পড়েছে। সেই সময়ে এলএনজি আমদানি বাড়ানো, এফএসআরইউ স্থাপন ইত্যাদি ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভারসাম্য নিশ্চিতে যথাযথ হচ্ছে বলে মনে হয় না।
পঞ্চমত, এই আইনের আলোকে অব্যাহতভাবে জীবাশ্ম জ্বালানিকেন্দ্রিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকে অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানি বৃদ্ধির পরিবেশ সৃষ্টি ব্যাহত হচ্ছে। উপরন্তু বর্তমানে এই আইনের বর্ধিত সময়ে যদি জীবাশ্ম জ্বালানির প্রাধিকার অব্যাহত ও কুইক রেন্টাল এবং সরকারি–বেসরকারি জীবাশ্মভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র অব্যাহত থাকে, তবে সরকারঘোষিত নবায়নযোগ্য জ্বালানির কোনো লক্ষ্যই বাস্তবায়নের সুযোগ থাকবে না। সরকার নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে গুরুত্ব দিয়ে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে, অথচ বাস্তবে সে লক্ষ্যে তেমন উদ্যোগ দেখা যায় না। নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে গুরুত্ব দিতে জীবাশ্ম জ্বালানির নির্ভরতা কমিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ (সৌরবিদ্যুৎ, বায়ুবিদ্যুৎ) ইত্যাদিকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
একই সঙ্গে কুইক রেন্টাল বা ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পুরোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং উচ্চমূল্যের জ্বালানিনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে ধাপে ধাপে অবসায়ন দরকার।
আমরা মনে করি, জরুরি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ আইন, ২০১০-এর পুনরায় সময় না বাড়ানোর বিষয়টি সংসদ বিবেচনা করলে ভালো হতো; বরং প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে স্বচ্ছতার সঙ্গে জবাবদিহিমূলক পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের যাবতীয় চুক্তি গৃহীত হলে এ খাত দক্ষ ও গুণমানসম্পন্ন, কম ব্যয়বহুল বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং দেশি–বিদেশি বিনিয়োগকারী আগ্রহের কেন্দ্রে পরিণত হতো।
ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের(সিপিডি) গবেষণা পরিচালক।