কত বিচিত্র ধরনের অপমৃত্যু হতে পারে, তার একটা চলমান ল্যাবরেটরি এখন বাংলাদেশ। ৫০ বছর বয়সী মাহবুবুর রহমান তালুকদারের কথাই ধরা যাক। গ্রামের বাড়ি বগুড়ায়। জীবিকার জন্য ঢাকার মিরপুর-১১–তে থাকতেন। মিরপুর-১০–এ একটি সোনার দোকানে কাজ করতেন। প্রতিদিনের মতো গত ৩১ মে সকালে বাসা থেকে বেরিয়ে কর্মস্থলে যাচ্ছিলেন। আক্ষরিক অর্থেই মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো মেট্রোরেলের নির্মাণাধীন দেয়ালের ইট মাহবুবুরের মাথায় ভেঙে পড়ে। উদ্ধার করে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। আরও চারজন পথচারী আহত হন।
দুর্ঘটনার কারণ সম্পর্কে জানা যাচ্ছে, মেট্রোরেল প্রকল্পের ভেঙে পড়া ওই অংশের দেয়াল গাঁথা হয়েছিল দু-তিন দিন আগে। শ্রমিকেরা একটি মিকশ্চার মেশিন এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সরানোর সময় সেটি দেয়ালের ওপর গিয়ে আঘাত করে। এ কারণে দেয়ালের একটি অংশ ভেঙে নিচের সেফটি নেট ছিঁড়ে পথচারীদের গায়ে-মাথায় গিয়ে আছড়ে পড়ে।
মাহবুবুর রহমানের ১০ বছরের একটি মেয়ে আছে। ঢাকা মাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড কর্তৃপক্ষ তাদের প্রাথমিক তদন্তে এ দুর্ঘটনাকে অস্বাভাবিক ও অপ্রত্যাশিত মনে করছে। কিন্তু সেটাই কি যথেষ্ট? এমন একটি দুর্ঘটনা কীভাবে ঘটতে পারে? মাহবুবুরের মেয়ে ও পরিজনের কাছে তাদের বাবার, প্রিয়জনের এ অপমৃত্যুর সান্ত্বনা কী? মেট্রোরেল প্রকল্প সরকারের সর্বাধুনিক ও অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রকল্প। হাজার হাজার কোটি টাকা সেখানে বিনিয়োগ করা হয়েছে, অথচ যথাযথ নিরাপত্তাব্যবস্থা কেন নিশ্চিত করা গেল না? এ মৃত্যুকে আমরা কী বলব? উন্নয়ন–অপমৃত্যু?
একটা ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, লাইভ করতে গিয়েই বিস্ফোরণে উড়ে যাচ্ছে। বিস্ফোরণের ভয়াবহতা এত বেশি ছিল যে আশপাশের এলাকায় ঘরবাড়ির জানালার কাচ ভেঙে পড়ে। বিস্ফোরণে আগুন ছড়িয়ে পড়ায় সেখানে রাখা পণ্যবাহী অনেকগুলো কনটেইনার পুড়ে যায়। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একের পর এক অ্যাম্বুলেন্স সাইরেন বাজিয়ে আসতে থাকে। অধিকাংশই মারাত্মকভাবে পোড়া রোগী। আবার অনেকের হাত–পা উড়ে গেছে। রোগী আর স্বজনদের আহাজারি ও আর্তনাদে ভরে উঠছে হাসপাতাল চত্বর। নিহত মানুষের সংখ্যা ২, ৪, ১৫, ৩২, ৪০...লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে।
এ রকম অপমৃত্যু অহরহ ঘটছে বাংলাদেশে। গত ২৪ এপ্রিল রাজধানীর গ্রিনরোডে নির্মাণাধীন ভবন থেকে ইট পড়ে মারা যান শফি উল্লাহ নামের এক ব্যবসায়ী। পাশের মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে ফেরার পথে একগুচ্ছ ইট শফিসহ আরও কয়েকজন পথচারীর ওপর পড়ে। অন্যরা ভাগ্যচক্রে বেঁচে গেলেও মারা যান শফি। এক মেয়ের বাবা ছিলেন তিনি। শফির মেয়ে ও স্বজনদের কাছে এই মৃত্যুর সান্ত্বনা কী?
গত বছরের নভেম্বরে রাজধানীর আজিমপুরে বাবার হাত ধরে স্কুলে যাওয়ার পথে দেয়ালচাপায় মারা যায় সাত বছরের শিশু জিহাদ। শিশুটির বাবা দুহাতে আগলে ধরতে চেষ্টা করলেও পারেননি আদরের সন্তানকে বাঁচাতে। আজিমপুর কলোনির যে দেয়াল চাপা পড়ে শিশু জিহাদের মৃত্যু হয়, সেটি যাতে পুনর্নির্মাণ করা হয়, সে জন্য চিঠি-চালাচালি করছিল সরকারি সংস্থা গণপূর্ত অধিদপ্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। দুই সংস্থাই জানত, দেয়ালটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। তবে কেউ মেরামতের উদ্যোগ নেয়নি। অবশেষে সেখানে নতুন দেয়াল হয়েছে, তবে শিশু জিহাদের মৃত্যুর পর।
এর আগে, ২০১৪ সালে ঢাকার শাহজাহানপুরে পানির পাম্পের খোলা মুখের পাইপের ভেতর পড়ে নিহত হয়েছিল জিহাদ নামের চার বছরের আরেক শিশু। সে সময় উন্নয়নকাজের নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য অনেক হইচই হলেও তাতে সরকারি–বেসরকারি কোনো কর্তৃপক্ষের যে নিরাপত্তার বিষয়ে কোনো বিকার নেই, সেটা বলাই চলে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) তথ্য অনুযায়ী ২০২১ সালে নির্মাণকাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দুর্ঘটনায় ১৫৪ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এ সংখ্যা আরও বেশি বলেই ধারণা করা হয়। এসব মৃত্যু কোনো স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। এর পেছনে সরকারি–বেসরকারি কর্তৃপক্ষসহ আমাদের সামষ্টিক অবহেলা ও দায়হীনতা দায়ী। উন্নয়নকাজের সময় যথাযথ নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হলে শ্রমিক কিংবা পথচারীর অপমৃত্যু ঠেকানো যেত।
এ লেখা যখন লিখছি, সে সময়ে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের খবর জানা গেল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, টেলিভিশন, অনলাইন গণমাধ্যমের স্ক্রিন ভরে উঠছে ওই ঘটনার খবর, ছবি ও ভিডিওতে। একটা ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, লাইভ করতে গিয়েই বিস্ফোরণে উড়ে যাচ্ছে। বিস্ফোরণের ভয়াবহতা এত বেশি ছিল যে আশপাশের এলাকায় ঘরবাড়ির জানালার কাচ ভেঙে পড়ে। বিস্ফোরণে আগুন ছড়িয়ে পড়ায় সেখানে রাখা পণ্যবাহী অনেকগুলো কনটেইনার পুড়ে যায়। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একের পর এক অ্যাম্বুলেন্স সাইরেন বাজিয়ে আসতে থাকে। অধিকাংশই মারাত্মকভাবে পোড়া রোগী। আবার অনেকের হাত–পা উড়ে গেছে। রোগী আর স্বজনদের আহাজারি ও আর্তনাদে ভরে উঠছে হাসপাতাল চত্বর। নিহত মানুষের সংখ্যা ২, ৪, ১৫, ৩২, ৪০...লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের কর্মী, ডিপোতে কাজ করতে যাওয়া শ্রমিক, উৎসুক জনতা—সবাই রয়েছেন। রাসায়নিক আছে সে রকম তথ্য আগে থেকে না পেয়েই আগুন নেভাতে গিয়ে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন ফায়ার সার্ভিসের আট সদস্য।
প্রাথমিক খবরে জানা যাচ্ছে, ডিপোতে হাইড্রোজেন পারক্সাইড নামে রাসায়নিক ছিল। নিজে দাহ্য না হলে অক্সিজেন জুগিয়ে আগুনের মাত্রা বাড়াতে এটি সহায়তা করেছে। বদ্ধ কনটেইনারে থাকা হাইড্রোজেন পার অক্সাইড অন্য কোনো দাহ্য রাসায়নিকের সংস্পর্শে আসায় একসময় বিস্ফোরণ ঘটেছে। এতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ও মানবিক বিপর্যয় ঘটেছে। প্রশ্ন হলো, এ ধরনের দাহ্য রাসায়নিক কেন অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে একই ডিপোতে পাশাপাশি রাখা হবে? সেটা দেখার কর্তৃপক্ষ কে? এত মানুষের মৃত্যু, এত মানুষের আহত হওয়ার কিংবা সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির দায় নেবে কে? নিমতলী ও চুড়িহাট্টার মতো ভয়াবহ বিপর্যয়ের পর সীতাকুণ্ডের এই বিপর্যয় কেন ঘটল? তাহলে অতীতের বিপর্যয় থেকে আমরা কি কিছুই শিক্ষা নেব না? সীতাকুণ্ডের অগ্নিকাণ্ডের পরও হয়তো কয়েকদিন তোড়জোড় চলবে। তারপর আমরা আবার আমাদের শামুকের খোলের মধ্যে চলে যাব। এরপর আবার কোনো বিপর্যয়ের জন্য সবাই বসে থাকব।
বাংলাদেশে আমরা দেড় দশক ধরে একমাত্রিক উন্নয়নজ্বরে আক্রান্ত। এ উন্নয়নের লক্ষ্য—মুনাফা বাড়ানো, জিডিপি বাড়ানো, মাথাপিছু আয় বাড়ানো। কিন্তু উন্নয়ন মানে তো মানুষের নিরাপদ জীবন নিশ্চিত করা, সে চিন্তা নীতিনির্ধারক থেকে শুরু করে ব্যক্তিপর্যায়ে কারও মধ্যে নেই। এসব উন্নয়ন–অপমৃত্যু ও দুর্ঘটনার দায় অবশ্যই সরকার, সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষ, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কিংবা ব্যক্তি—সবাইকে নিতে হবে। নিহত ব্যক্তিদের পরিবার ও আহত ব্যক্তিরা যাতে বড় অংকের ক্ষতিপূরণ পান, এর নীতিমালাও তৈরি করতে হবে। তাতে অন্তত ভুক্তভোগী পরিবারগুলো বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার কিছুটা অবলম্বন পাবে। দায়ীদের অবশ্যই কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, উন্নয়নদর্শনের কেন্দ্রে মানুষকে না আনা হলে এ বিপর্যয় থেকে আমাদের মুক্তি নেই।
মনোজ দে প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
[email protected]