বার্ষিক মুদ্রানীতি ঘোষণাকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেছেন, ‘আমরা এমন একটা সময় অতিক্রম করছি, যখন করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ অর্থনীতিতে একটি আতঙ্কময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। সম্প্রসারণমূলক রাজস্ব ও মুদ্রানীতির আওতায় গৃহীত নীতিসহায়তার ফলে ব্যাংক খাতে উদ্বৃত্ত তারল্য ও তরল সম্পদের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। যদিও মহামারির প্রভাবে সামষ্টিক অর্থনীতি এখনো প্রয়োজনীয় মাত্রায় ঘুরে দাঁড়ায়নি। …করোনা মহামারির ক্ষতিকর প্রভাব কাটিয়ে দেশীয় অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পাশাপাশি মানসম্মত নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহায়তা করতে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গেই সম্প্রসারণমূলক ও সংকুলানমুখী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এই মুদ্রানীতি প্রণয়ন করা হয়েছে।’
দেখা দরকার, অর্থনীতির চলমান প্রেক্ষাপটে ও তথ্য-উপাত্তের আলোকে মুদ্রানীতি প্রণয়ন করা হয়েছে কি না।
বিদ্যমান অবস্থা
করোনার অভিঘাতে বিনিয়োগ ও ভোগ উভয়ই কমেছে। বেশি হারে কমেছে ভোগ। অধিকাংশ মানুষের আয় কমেছে। ফলে ভোগ-ব্যয় অনেক কমে যাওয়ায় অর্থনীতিতে ঋণাত্মক অভিঘাত পড়েছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ভোগ মূল চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। জাতিসংঘের বিশ্ব অর্থনৈতিক অবস্থা ও অগ্রগতি ২০২১ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, করোনা অভিঘাতে ২০১৯ থেকে ২০২০ সালে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হার কমেছে ৩ দশমিক ৯ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের এক সমীক্ষা বলছে, লকডাউনের কারণে ২০২০ সালের জুন থেকে জুলাই পর্যন্ত সময়ে জনসংখ্যার ৬১ দশমিক ৫৭ শতাংশ চাকরি হারায় এবং শ্রমিকদের গড় মজুরি স্বাভাবিক আয়ের তুলনায় প্রায় ৩৭ শতাংশ হ্রাস পায়।
ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ প্রাক্-করোনাকাল থেকেই স্থবির। সংকোচন ঘটেছে এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে বিনিয়োগ বাড়বে না। কাজ বন্ধ হয়ে ও আয় কমে যাওয়ায় নতুন দারিদ্র্য তৈরি হয়েছে। বিদ্যমান সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি নতুন দারিদ্র্য মোকাবিলায় যথেষ্ট নয়। প্রচলিত কর্মসূচিগুলো সর্বজনীন নয়; নয় অধিকারভিত্তিক নিরাপত্তামূলক। জীবনচক্রভিত্তিকও নয়। ত্রাণমূলক বা কিছু নির্দিষ্ট পিছিয়ে পড়া মানুষকে লক্ষ্য করে নেওয়া। সমন্বয়হীনতায় খণ্ড সুবিধাভোগী। নেই দরিদ্র জনসংখ্যার প্রকৃত তথ্যভিত্তিক তথ্যভান্ডার বা ডেটাবেইস। বাছাইয়ে রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ পুরোনো। ফলে, করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত সবাইকে সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় আনা যায়নি। আবার কর্মসূচিগুলো মূলত গ্রামকে কেন্দ্র করে সাজানো। করোনায় শহরে দারিদ্র্য অনেক বেড়ে গেলেও কর্মসূচির আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না।
করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত সবাইকে সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় আনা যায়নি। আবার কর্মসূচিগুলো মূলত গ্রামকে কেন্দ্র করে সাজানো। করোনায় শহরে দারিদ্র্য অনেক বেড়ে গেলেও কর্মসূচির আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না।
অভিঘাত মোকাবিলায় বিশ্বব্যাপী সরকারি ব্যয় বাড়ানোর কৌশলের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। তবে বাজেটে প্রদত্ত হিসেব অনুযায়ী সরকারি ব্যয় বরং কমেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯ অর্থবছরে সরকারি ব্যয়-জিডিপি অনুপাত ছিল ১৫ দশমিক ৪ শতাংশ। ২০২০ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়ায় ১৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে জুলাই-এপ্রিল সময়ে এ অনুপাত ৯ দশমিক ৬ শতাংশ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৫ শতাংশ। একই সময়ে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির বাস্তবায়ন জিডিপির ২ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক ২ শতাংশ।
ব্যাংকিং খাতে অত্যধিক তারল্য থাকলেও ব্যক্তি খাতে ঋণপ্রবাহ বৃদ্ধি পাচ্ছে না। আইএমএফের হিসাব বলছে, গত মার্চে ব্যাংকিং খাতে অতিরিক্ত তরল সম্পদ দাঁড়িয়েছে ১৫ দশমিক ২ শতাংশ। গত বছর একই সময়ে তা ছিল ৭ দশমিক ২ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকিং ব্যবস্থার মাধ্যমে নতুন অর্থের সরবরাহ বাড়িয়েছে। একই সঙ্গে দেশে অধিক পরিমাণ অভিবাসী আয় ও বিদেশি সাহায্য আসায় তারল্যের অভাব নেই। তবু ঋণপ্রবাহ বাড়ছে না। গত মুদ্রানীতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণপ্রবাহের লক্ষ্যমাত্রা ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ ঘোষণা করলেও অর্জন হয়েছে মাত্রা ৮ দশমিক ৪ শতাংশ।
প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতা
করোনার অভিঘাত মোকাবিলায় সরকার ১ লাখ ২৪ হাজার ৫৩ কোটি টাকার ২৩টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের গত মার্চ অবধি হিসাব অনুযায়ী সর্বমোট বাস্তবায়নের অগ্রগতির হার ৬০ দশমিক ৩ শতাংশ। প্রণোদনার ৮০ দশমিক ৭ শতাংশই ঋণভিত্তিক। মাত্র ১৯ দশমিক ৩ শতাংশ রাজস্ব প্রণোদনা। বিশ্বব্যাপী সম্প্রসারণশীল রাজস্বনীতির আশ্রয় নেওয়া হলেও বাংলাদেশ মুদ্রানীতির ওপরই বেশি জোর দিচ্ছে।
বড় বড় রপ্তানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠান প্রণোদনার অর্থ পেলেও খুদে উদ্যোক্তাদের কাছে ঋণ সমতালে পৌঁছেনি। রপ্তানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার বিশেষ তহবিলের পুরোটাই তারা পেয়েছে। এসএমই খাতের জন্য ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম দুই হাজার কোটি টাকা, বয়স্ক ভাতা ও বিধবা ভাতা ১৫০টি উপজেলায় সম্প্রসারণে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে লক্ষ্যভিত্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে নগদ অর্থ বিতরণে ৯৩০ কোটি টাকার বরাদ্দের মধ্যে এক টাকাও সরবরাহ করা হয়নি। নতুন প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে।
জনসংখ্যার প্রকৃত তথ্য-উপাত্তভিত্তিক ডেটাবেইস না থাকায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর কাছে প্রণোদনার অর্থ পৌঁছাতে পারেনি। এ কারণে তাদের দুর্ভোগ কমানো যায়নি। দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে আটকে যাচ্ছে। অর্থ বণ্টনে অসমতার কারণে অধিকাংশ মানুষ নিয়োজিত খাত, তথা—অনানুষ্ঠানিক খাত, কুটির, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাত (সিএমএসএমই) আর কৃষি খাতে আশানুরূপ অর্থ পৌঁছায়নি। আবার অনেকে যথাসময়ে পায়নি।
উত্তরণের পথনকশা
বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে ত্রাণ ও পুনর্বাসন এবং পুনরুদ্ধার ও পুনর্গঠনের কর্মসূচি নির্ধারণে কতগুলো বিষয়ের ওপর জোর দেওয়া জরুরি। এখানে একটি কাঠামো ও কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া হলো। কাঠামোটিতে দরকার রাজস্বনীতি ও মুদ্রানীতির সমন্বয়। রাজস্বনীতির প্রাধান্য ও টিকা প্রদানের মাধ্যমে অর্থনীতির গতিশীলতা আনা। এ সমন্বিত কর্মসূচির কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতে হবে দুটো ইউনিট—খানা বা গৃহস্থালি এবং কারবার বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান।
রাজস্বনীতির মাধ্যমে দ্রুত সরাসরি নগদ অর্থ পৌঁছানো অপরিহার্য। শুধু দরিদ্র নয়; নিম্নমধ্যবিত্ত, ব্যক্তি খাতের চাকরিজীবীসহ প্রান্তিকতার পথে ধাবমান প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে টিকে থাকা ও ভোগ-ব্যয় বাড়ানোর জন্য নগদ সহায়তা প্রদান। এ জন্য জনসংখ্যার প্রকৃত তথ্য-উপাত্তভিত্তিক ডেটাবেইস তৈরি করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে সর্বজনীন স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। এর মাধ্যমে যেকোনো অভিঘাতে খানাগুলোর ঝুঁকি প্রশমনের সক্ষমতা বাড়বে।
জনসংখ্যার প্রকৃত তথ্য-উপাত্তভিত্তিক ডেটাবেইস না থাকায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর কাছে প্রণোদনার অর্থ পৌঁছাতে পারেনি। এ কারণে তাদের দুর্ভোগ কমানো যায়নি। দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে আটকে যাচ্ছে।
নীতি-কৌশল ও বরাদ্দে সবচেয়ে বেশি মানুষ নিয়োজিত খাতগুলোয় অধিক প্রাধান্য দেওয়া জরুরি। কুটির, ক্ষুদ্র, অতিক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে সহায়তা বাড়ানো অত্যাবশ্যক। মুদ্রানীতিতে বড়-ছোটনির্বিশেষে সবার জন্য ঋণের সুদ একই হারে নির্ধারণ করে দেওয়ায় ব্যাংকগুলো অনানুষ্ঠানিক খাতে ঋণ দিতে উৎসাহ পায় না। ভিন্ন ভিন্ন খাতের জন্য ভিন্ন ভিন্ন সুদহার নির্ধারণ করে দেওয়া দরকার। ঋণ নিতে প্রমাণাদি ও নিরাপত্তার জন্য বিভিন্ন কাগজপত্র-দলিল, জামানত বা বন্ধকের প্রয়োজন হয়। অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিতদের এসব থাকে না বিধায় ঋণ নিতে পারে না। ঋণ পাওয়ার প্রক্রিয়াকে সহজ করা জরুরি। বাজার থেকে অলস তারল্য তুলে না নিয়ে উৎপাদনশীল খাতে ঋণপ্রবাহের প্রক্রিয়া সহজতর ও ব্যাংকগুলোকে অনানুষ্ঠানিক খাতে ঋণ দিতে উৎসাহী করা গেলে ভোগ-ব্যয় ও বিনিয়োগ উভয়ই বাড়বে। ঋণ পরিশোধের অনিশ্চয়তা কাটাতে কুটির, ক্ষুদ্র, অতিক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে ঋণের গ্যারান্টি স্কিমের ব্যবস্থা প্রয়োজন। সাধারণের বিনিয়োগ বাড়াতে ইক্যুইটি অর্থায়ন ব্যবস্থার ওপরও জোর দেওয়া জরুরি।
দরকার গণটিকা কর্মসূচির আরও ব্যাপক সম্প্রসারণ এবং দ্রুত বাস্তবায়ন। করোনা পরিস্থিতি কাটিয়ে ব্যবসায় আস্থা বাড়ালে বিনিয়োগ বাড়বে। নতুন কর্মসংস্থানের মাধ্যমে ভোগ-ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। বাড়বে সরকারের রাজস্ব আয়। এ পুণ্যচক্র বজায় রাখতে সবাইকে টিকার আওতায় আনা গেলেই বাঁচবে জীবন ও জীবিকা।
ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ ও বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ‘উন্নয়ন অন্বেষণ’-এর চেয়ারপারসন।