ঠিক এক বছর আগে, এই ফেব্রুয়ারি মাসে মিয়ানমারে সেনাবাহিনী অভ্যুত্থান করে এবং আমার দেশের ইতিহাসে তারা আরেকটি রক্তাক্ত অধ্যায়ের সূচনা করে। তারপর থেকে তারা রাষ্ট্রকে পতনের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে এবং ব্যাপক নৃশংসতা চালিয়ে যাচ্ছে। ক্ষমতার অপব্যবহারকারীদের এ চক্র ভাঙার এখন একটিই পথ আছে। সেটি হলো: আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচারের প্রক্রিয়া অনুসরণ করে দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনা।
১২ মাস ধরে মিয়ানমার থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে ভয়ংকর সব সংবাদ আসছে। এ সময়ের মধ্যে প্রতিবাদ দমন করতে গিয়ে জান্তা বাহিনী গণহত্যা চালিয়ে দেড় হাজারের বেশি নাগরিককে মেরে ফেলেছে। অর্থনীতি মারাত্মক পতনের মুখে পড়েছে। স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষা পরিষেবাগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা সংখ্যালঘুরা একটি চলমান গণহত্যার মুখোমুখি হচ্ছে এবং তারা একটি উন্মুক্ত কারাগারে বসবাস করছে। জান্তা বাহিনী বাংলাদেশে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা রোহিঙ্গাদের গ্রেপ্তার করেছে এবং তাদের চলাফেরার স্বাধীনতার ওপর আরও কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। সামরিক বাহিনী এবং আরাকান আর্মি সশস্ত্র গোষ্ঠীর ক্রমবর্ধমান সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে অনেকে মারা যাচ্ছে।
একজন রোহিঙ্গা হিসেবে অতীতে সেনাবাহিনীর অপরাধ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করার সময় আমি প্রায়ই আক্রমণের শিকার হতাম। আর এখন তাঁদের কাছ থেকেও আমি সমর্থন, এমনকি ক্ষমাও পাচ্ছি, যাঁরা রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা ছড়াতেন। সামরিক বাহিনী আমাদের অভিন্ন শত্রু—এটি এখন জনগণ বুঝতে পেরেছে। তাতমাদা হিসেবে পরিচিতি পাওয়া দেশটির সেনাবাহিনী কয়েক দশক ধরে মিয়ানমারের জনগণকে আতঙ্কিত করেছে। গণহত্যা চালিয়েছে। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং যুদ্ধাপরাধ করেছে। তাদের অপরাধের কোনো সাজা হবে না জেনে তারা সম্পূর্ণ দায়মুক্তির সঙ্গে এসব করে আসছে। এ কারণে আমাদের আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে পদক্ষেপ নিতে হবে এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। সৌভাগ্যের বিষয়, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ ক্ষেত্রে বেশ অগ্রগতি হয়েছে।
২০১৯ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) ঘোষণা করেছেন, তাঁরা রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত শুরু করছেন। একই সময়ে, গাম্বিয়া আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যার মামলা নিয়ে আসে। উভয় প্রক্রিয়াই চলমান। এগুলো সামরিক বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হওয়া মানুষদের মনে আশা জাগিয়েছে।
গত বছর আর্জেন্টিনার বিচার বিভাগও মিয়ানমারের সামরিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে একটি যুগান্তকারী গণহত্যা মামলা নিতে সম্মত হয়েছে। এই মামলা গ্রহণের জন্য আমার নিজের সংস্থা বার্মিজ রোহিঙ্গা অর্গানাইজেশন ইউকে (ব্রুক) প্রথম আবেদন করেছিল। একটি সর্বজনীন বিচারব্যবস্থার আইনি নীতির ওপর ভিত্তি করে মামলাটি হয়েছে। এ নীতি অনুসারে কিছু অপরাধ এতটাই ভয়ংকর যে সেগুলো যেখানেই সংঘটিত হোক না কেন বিশ্বের যেকোনো জায়গায় সেগুলোর বিচার করা যেতে পারে। প্রক্রিয়াটি সবে শুরু হয়েছে। কিন্তু আমরা আশা করি শেষ পর্যন্ত মিন অং হ্লাইং এবং তাঁর সহচরেরা তাঁদের অপরাধের জন্য আইনের আদালতে জবাব দিতে বাধ্য হবেন।
মিয়ানমারের অনেক বেসামরিক নেতা, যারা আগে সামরিক অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার যেকোনো চেষ্টাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, এখন তাঁরাও তাতমাদাকে জবাবদিহির আওতায় আনার প্রয়োজন দেখছে। অভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠিত জাতীয় ঐক্যের সরকার বলেছে, এ ইস্যুতে তারা আন্তর্জাতিক বিচারব্যবস্থাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে। মিয়ানমারের মানুষ এ নির্যাতনকারীদের এখন কারাগারে দেখতে চায়।
এটাও উৎসাহব্যঞ্জক যে মিয়ানমারের অনেক বেসামরিক নেতা, যারা আগে সামরিক অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার যেকোনো চেষ্টাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, এখন তাঁরাও তাতমাদাকে জবাবদিহির আওতায় আনার প্রয়োজন দেখছে। অভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠিত জাতীয় ঐক্যের সরকার বলেছে, এ ইস্যুতে তারা আন্তর্জাতিক বিচারব্যবস্থাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে। মিয়ানমারের মানুষ এ নির্যাতনকারীদের এখন কারাগারে দেখতে চায়।
এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, চারপাশের জাল গুটিয়ে আসছে দেখে তাতমাদা নেতৃত্বও ক্রমে চিন্তায় পড়ে গেছে। গত ডিসেম্বরে, জান্তা সরকারের একটি আদেশ গণমাধ্যমে ফাঁস হয়েছিল। ওই আদেশে সামরিক নেতৃত্ব আন্তর্জাতিক বিচার সংস্থা কিংবা আর্জেন্টিনার ফেডারেল আদালতের চিঠির জবাব দেওয়া যাবে না বলে তাদের কর্মীদের জানিয়ে দিয়েছিল।
ন্যায়বিচার ক্রমে নাগালের মধ্যে আসছে বলে মনে হচ্ছে। এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আরও অনেক কিছু করার আছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ কয়েক বছর ধরে এ ইস্যুতে অচল হয়ে আছে কারণ চীন মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রস্তাবে ভেটো দিয়ে আসছে। তবে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের অবশ্যই রাজনীতিকে মানুষের জীবনের ঊর্ধ্বে রাখার চর্চা বন্ধ করতে হবে এবং আইসিসির কাছে মিয়ানমারের পরিস্থিতির সম্পূর্ণ চিত্র তুলে ধরার বিষয়টিকে অনুমোদন করতে হবে।
কানাডা এবং নেদারল্যান্ডস উভয়ই আইসিজেতে গাম্বিয়ার করা মামলায় সমর্থন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে, তা অন্য দেশগুলোরও অনুসরণ করা উচিত। পরিশেষে আর্জেন্টিনায় আমরা যে উদাহরণ সৃষ্টি করেছি, সেটিও অন্যদের অনুসরণ করা উচিত।
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
তুন খিন বার্মিজ রোহিঙ্গা অর্গানাইজেশন ইউকের প্রেসিডেন্ট