কোভিড-১৯ মহামারি হলো সদ্য উত্থিত সংক্রামক রোগগুলোর বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জের একটি পূর্বাভাস। যেগুলো আগে কখনো স্বীকৃত হয়নি কিন্তু অস্তিত্ব রয়েছে কয়েক দশক বা শতাব্দী ধরে এবং প্রতিবার ভিন্ন ভিন্ন রূপে আবর্তিত হচ্ছে (অ্যান্টনি ফাউসি, ইউএস ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যালার্জি এবং সংক্রামক রোগ)।
১৯০০–এর শুরুর দিক থেকে, নির্দিষ্ট সময় পরপর ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দিচ্ছে। প্যান্ডামিক প্যাথোজনের( pandemic pathogen) কারণে, পাঁচটি ভাইরাস পরিবার ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হয়েছে। এই প্রাদুর্ভাবের মধ্যে দুটি কোভিড-১৯ থেকেও বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটিয়েছে। এর একটি স্প্যনিশ ফ্লু—১৯১৮ ও ১৯১৯ সালে—এর মারাত্মক প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছিল। আরেকটি হলো ‘এইচআইভি মহামারি’, যার প্রাদুর্ভাব প্রায় ৪০ বছর ধরে রয়েছে। এ ছাড়া সাম্প্রতিক দশকগুলোতে আরও অনেক নতুন ভাইরাস উত্থিত হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে গুরুতর তীব্র শ্বাসযন্ত্রের সিনড্রোম (সার্স), মানুষের মধ্যে এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা, ইবোলা, মারবার্গ হেমোরেজিক ফিভার, নিপা ভাইরাস এবং বর্তমান কোভিড-১৯ মহামারি। এই প্রাদুর্ভাবের ব্যাপকতা আন্তর্জাতিক উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে, বিজ্ঞানকে রীতিমতো চ্যালেঞ্জ করেছে, বড় ধরনের মানবিক দুর্ভোগ ও মৃত্যু ঘটিয়েছে এবং ব্যাপক অর্থনৈতিক ক্ষতি করেছে।
কোভিড-১৯ মহামারিটির সম্পূর্ণ প্রভাব রিপোর্টগুলোতে প্রকাশিত মৃত্যুর সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি। যদিও মহামারির শুরু থেকে নিশ্চিত করা হয় যে, মৃত্যুর সংখ্যা ৬ দশমিক ২ মিলিয়ন কিন্তু একটি সাম্প্রতিক গবেষণাপত্রে অনুমান করা হয়েছে যে মহামারিটির কারণে বিশ্বব্যাপী ১৮ দশমিক ২ মিলিয়ন মানুষ মারা গেছে।
প্রকৃত সমস্যা
যেহেতু আমরা কোভিড-১৯ মহামারি থেকে বেরিয়ে এসেছি। তাই এখন এটা অপরিহার্য যে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার প্রস্তুতি এবং প্রতিক্রিয়ার ক্ষমতা সক্ষমতা তৈরিতে নতুন নীতি গ্রহণ করা।
আজকের এই ‘প্রাণী এবং মানুষের মধ্যে সংক্রামক রোগের ব্যাপকতা’, আমাদের অসহায়ত্বকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। সংক্রামক রোগের প্রকটটা এবং ক্ষেত্রবিশেষ মহামারির জন্য দায়ী আধুনিক জীবনব্যবস্থার বেশ কিছু দিক। যেমন, মানুষ এবং প্রাণীদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান মিথস্ক্রিয়া, জীববৈচিত্র্যের ক্ষয়, বাস্তুতন্ত্রের পরিবর্তন, দ্রুত নগরায়ণ এবং মৌলিক পরিষেবাগুলোতে সীমাবদ্ধতা, জলবায়ু পরিবর্তন ইত্যাদি।
উত্থিত সংক্রামক রোগের ৭০ শতাংশের বেশির উৎস, পশু। অপর দিকে প্রাণীর বৃদ্ধির জন্য অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালের অবাধ ব্যবহার অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স (এএমআর) তৈরি করছে এবং ‘সুপারবাগ’ সৃষ্টি করছে। পরে এটি, ভাইরাস প্রতিহত করার জন্য তৈরি করা ওষুধগুলোকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলছে। এমনকি আমাদের কৃষি উৎপাদন এবং বিপণনব্যবস্থাও ভাইরাসের উত্থানের জন্য অনেকাংশে দায়ী।
প্রতিরোধের উপায়
এ ধরনের জনস্বাস্থ্য সংকটগুলো নতুন কিছু নয়। তবে আমরা কি এই সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম? সমাধান কি আদৌ সম্ভব? বিগত মহামারিগুলোর দিকে তাকালেই, ভবিষ্যৎ সংকটের ব্যাপারে আঁচ করা যায়। কিন্তু আমরা সেসবে গুরুত্ব দিইনি। অতঃপর ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব সময়ের সঙ্গে বৃদ্ধি পেয়েছে, যার ফলে ব্যাপকভাবে স্বাস্থ্য, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে। প্রতিবার যখন এ ধরনের কোনো প্রাদুর্ভাব বা মহামারি দেখা দেয়, সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে সংকট মোকাবিলা করা হয়। কিন্তু পরিস্থিতির উন্নতি ঘটলে এবং জনমানুষের ভয় কেটে গেলে, দেখা যায় যে স্বাস্থ্যব্যবস্থা আগের অবস্থায় চলছে। এ অবস্থায় যে পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা যেতে পারে, দ্রুত ভাইরাস নির্ণয় এবং নিশ্চিতকরণ, নতুন ভাইরাসের জীবনাচার বোঝার জন্য শক্তিশালী গবেষণা, নতুন ভাইরাস নিয়ন্ত্রণের জন্য কার্যকর এবং নিরাপদ প্রতিরোধব্যবস্থা গড়ে তোলা, ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ।
ঝুঁকির কারণ এবং অন্যান্য
ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের ক্ষেত্রে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, ভাইরাসটি নির্ণয় এবং পর্যবেক্ষণ। কিন্তু কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে দেখা গেছে যে এই ব্যাপারটিতে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। ভবিষ্যতে আমাদের উচিত হবে জনস্বাস্থ্য এবং ভাইরাস–সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ এবং বিশ্লেষণ। এরপর আসন্ন প্রাদুর্ভাবের জন্য একটি প্রাথমিক সতর্কতা ব্যবস্থা।
এ ধরনের ব্যবস্থাগুলো নতুন ভাইরাসের মৌলিক জীববিদ্যা বোঝার জন্য, সেই সঙ্গে তাদের নিয়ন্ত্রণ এবং কার্যকরী প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সহায়তা করবে। এ ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে আরও যা অন্তর্ভুক্ত থাকবে—
১. ভাইরাস নিরীক্ষণ এবং পর্যবেক্ষণ করা।
২. অভীষ্ট লক্ষ্যের সাপেক্ষে অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করা।
৩. স্বাস্থ্য সমস্যা বা মহামারিবিদ্যা নিরীক্ষণ।
৪. অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে জনস্বাস্থ্য নীতি বাস্তবায়ন।
৬. একটি ‘সর্বদা-চালু’ প্রাথমিক সতর্কতা ব্যবস্থা গ্রহণ।
মানুষ, পরিবেশ এবং বন্য প্রাণীর একটি ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। আবার পরিবেশে রয়েছে বিপুলসংখ্যক ভাইরাস, যার মধ্যে অনেকগুলো এখনো মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েনি। তাই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে যা গ্রহণ করা যায়। যেমন, প্যাথোজেন স্পিলওভারের আরও ভালো নজরদারি, ভাইরাল জিনোমিক্স এবং সেরোলজির বৈশ্বিক ডেটাবেজগুলোর বিকাশের ব্যবস্থা, বন্য প্রাণীগুলোর আরও ভালো ব্যবস্থাপনা, বাণিজ্য, পশুস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা এবং বন উজাড় হ্রাস করা।
মহামারির ঝুঁকি মোকাবিলায় পশুচিকিৎসা পরিষেবাগুলো একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। পশুস্বাস্থ্য উন্নতির মাধ্যমে, তারা জনগণকে পশুর রোগ থেকে রক্ষা করার দায়িত্বটি পালন করতে পারে।
‘যেন, কোনো ক্ষেত্র বাদ না থাকে, তা নিশ্চিত করার জন্য স্ট্যান্ডার্ড পদ্ধতি এবং রিপোর্টিং সিস্টেম প্রয়োজন’—ফাউসি
তদুপরি মহামারি চলাকালে প্রতিটি ক্ষেত্র একটি জরুরি ক্ষেত্র হিসেবে গণ্য করা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে ভাইরাস সংক্রমণের চেইনটি, জনগণকে সংক্রমিত করছে। তাই বর্ধিত পরীক্ষাগার ভাইরাস বা রোগ নিশ্চিতকরণে সাহায্য করে। তবে লক্ষ রাখতে হবে যে নমুনা সংগ্রহ এবং ক্ষেত্র থেকে পরীক্ষাগারে পরিবহনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থায় যেন ত্রুটি না থাকে। ল্যাবরেটরি সাপোর্ট নেটওয়ার্কগুলো দ্রুত নমুনা বিশ্লেষণ করতে সাহায্য করতে পারে এবং রেফারেন্স ল্যাবরেটরিগুলো ভাইরাস আইসোলেটগুলোর জেনেটিক বৈশিষ্ট্যসহ আরও পরিশীলিত পরীক্ষা প্রদান করতে পারে। অতএব এর যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
উল্লেখ্য, যেকোনো ধরনের রোগের প্রাদুর্ভাবের ক্ষেত্রে সময়মতো সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি সরবরাহ করতে তথ্য ও যোগাযোগকৌশল প্রয়োজন। যাতে সংশ্লিষ্টদের পরামর্শ জারি করা যায় এবং পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা যায়।
এসব কাজের জন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের একটি শক্তিশালী, সুপ্রশিক্ষিত এবং অনুপ্রাণিত দল প্রয়োজন। যারা নতুন প্যাথোজেনগুলো শনাক্ত করতে, নিশ্চিত করতে এবং তা নিয়ন্ত্রণের জন্য কার্যকর এবং নিরাপদ প্রতিরোধব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম হবে।
ফার্মাকোভিজিল্যান্সের ভূমিকা
ফার্মাকোভিজিল্যান্সের মাধ্যমে নতুন অনুমোদিত ওষুধের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিয়ে সব ওষুধ এবং ভ্যাকসিনের ব্যবহারের ওপর নজরদারি নিশ্চিত করা, ওষুধগুলো সঠিকভাবে কাজ করে কি না এবং তাদের স্বাস্থ্যসুবিধাগুলো নিশ্চিত করার জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগ করা, ওষুধ ব্যবহারের পর প্রতিকূল প্রভাব এবং প্রতিক্রিয়ার রিপোর্ট করা একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
এ পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে,
১. স্বাস্থ্যব্যবস্থায় সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়ে অবহিত করা;
২. স্বাস্থ্য প্রদানকারীদের শিক্ষিত এবং নির্দেশনা প্রদান;
৩. নতুন ওষুধ এবং ভ্যাকসিন সম্পর্কে জনসাধারণের নিরাপত্তার উদ্বেগের সমাধানে সহায়তা করা;
৪. তাৎক্ষণিক নীতি এবং নিয়ন্ত্রক পদক্ষেপগুলো উন্নত করা;
এই কাজটি করার সামগ্রিক লক্ষ্য হলো যেকোনো ধরনের ওষুধ ব্যবহারের সঙ্গে রোগীর যত্ন এবং সুরক্ষা উন্নত করা, ওষুধ ব্যবহারের ক্ষেত্রে জনস্বাস্থ্য এবং সুরক্ষার উন্নতি করা, ওষুধের সুবিধা, ক্ষতি, কার্যকারিতা এবং ঝুঁকিগুলোর মূল্যায়নে অবদান রাখা এবং দেশগুলোয় ওষুধের নিরাপদ, যুক্তিসংগত আরও কার্যকর এবং সাশ্রয়ী ব্যবহারকে উৎসাহিত করা। ক্লিনিক্যাল অনুশীলনের সঙ্গে ফার্মাকোভিজিল্যান্সের একীকরণ এবং এর আরও বিকাশ এবং শক্তিশালীকরণ স্বাস্থ্যব্যবস্থায় স্থিতিস্থাপকতা তৈরিতে অবদান রাখতে এগিয়ে যাওয়া প্রয়োজন।
অগ্রবর্তী পদক্ষেপ
যেহেতু আমরা কোভিড-১৯ মহামারি থেকে বেরিয়ে এসেছি। তাই এখন এটা অপরিহার্য যে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার প্রস্তুতি এবং প্রতিক্রিয়ার ক্ষমতা সক্ষমতা তৈরিতে নতুন নীতি গ্রহণ করা। আমাদের মধ্যে যেহেতু জনস্বাস্থ্য এবং পশুস্বাস্থ্য পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল এবং যেহেতু একই বাস্তুতন্ত্রে তারা বাস করে তাই সবকিছু পারস্পরিকভাবে সম্পৃক্ত। অতএব এটা মেনে নেওয়ার সময় এসেছে যে ‘প্ল্যানেটারি হেলথ’ শুধু একটি মার্জিত তাত্ত্বিক গঠন নয়, বরং একটি শক্তিশালী পদ্ধতি। ঝুঁকি পরিচালনা করতে এর চেয়ে ভালো পন্থা, স্পষ্টতই স্বাস্থ্যব্যবস্থায় আর নেই।
ড. জিয়াউদ্দিন হায়দার বিশ্ব ব্যাংকের সিনিয়র স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ