গত মাসে আমি ব্রিকসভুক্ত দেশগুলোর (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা) নেতাদের উদ্দেশে অরণ্যে রোদন করেছিলাম। আমি বলেছিলাম, তাঁরা এমন একটা সমন্বিত নীতি নিতে ব্যর্থ হয়েছেন, যেটা তাঁদের ও বিশ্ব অর্থনীতির জন্য উপকারী হয়। এ লেখায় আমি ব্রিকসের ভূমিকা যাতে বাড়ানো যায়, সে জন্য সুনির্দিষ্ট একটা পরামর্শ দেব।
গত বছর এ সময়ে আমি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বাধীন সংস্থা প্যান-ইউরোপিয়ান কমিশনের স্বাস্থ্য ও টেকসই উন্নয়নবিষয়ক কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলাম। ইতালির সাবেক প্রধানমন্ত্রী মারিও মন্টি এর সভাপতি ছিলেন। আমাদের করা চূড়ান্ত প্রতিবেদনটি গত মাসে প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনটির কেন্দ্রীয় ও গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবনা হচ্ছে জি-২০-ভুক্ত দেশগুলোকে নতুন একটা বৈশ্বিক স্বাস্থ্য বোর্ড (জিএইচবি) গঠন করা দরকার। বিশ্ব অর্থনীতির সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৮ সালে ফিন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি বোর্ড (এফএসবি) গঠন করা হয়েছিল। এটা একটা সফল মডেল। এটার আদলেই জিএইচবি গঠন করা যেতে পারে।
১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠার পর জি-২০ জোট অনেকটাই ঝিমিয়ে পড়েছিল। কিন্তু ২০০৮-০৯ সালে জোটটি গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় তারা একটা আদর্শ ভূমিকা পালন করে। ব্রিকসভুক্ত দেশগুলো এবং আর্জেন্টিনা, মেক্সিকো, সৌদি আরব, তুরস্কসহ উদীয়মান অর্থনীতির সব কটি গুরুত্বপূর্ণ দেশকেও এ উদ্যোগে সম্পৃক্ত করা হয়েছিল।
২০০৮ সালে জি-২০ জোটের সভায় সদস্যদেশগুলো এফএসবি গঠনে সম্মত হয়েছিল। জি-২০-এর সদস্যদেশগুলোর অর্থমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিনিধিরা এতে অন্তর্ভুক্ত হন। এফএসবি বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে এমনভাবে সক্ষম করে তোলে, যাতে ২০০৮ সালের মতো সংকট যেন আর না ঘটে। ব্যাংকের পুঁজি নিয়ে তারা একটি নীতি গ্রহণ করে। ব্যাংকের পুঁজি থেকে শুধু ভোক্তাদের সহযোগিতা করা হবে, সেই পুঁজি দিয়ে ব্যাংককে সহায়তা করা যাবে না।
অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিট্যান্স নিয়ে একটি স্বাধীন গবেষণা হয়েছে। সেখানে সতর্ক করা হয়েছে, ২০৫০ সাল নাগাদ এএমআর মহামারি বছরে এক কোটি মানুষের মৃত্যুর কারণ হবে। এর কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে ১০০ ট্রিলিয়ন ডলার। আমার কাছে স্পষ্ট যে বিদ্যমান জনস্বাস্থ্য ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বৈশ্বিক স্বাস্থ্যের যে বড় ঝুঁকি, সেটা মোকাবিলা করতে পারবে না।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এফএসবি গঠনে নতুন কোনো সংগঠন কিংবা কাঠামো তৈরি করতে হয়নি। আগে থেকেই সংস্থাটিতে থাকা দেশগুলো একটা সুনির্দিষ্ট ক্ষেত্রে শুধু ভূমিকা পালন করেছে। এটি শুধু জি-২০ দেশগুলোর প্রয়োজনে তৈরি করা হয়নি; অন্যান্য উদীয়মান অর্থনীতির দেশকেও শিগগিরই এফএসবি অন্তর্ভুক্ত করে নেয়।
বিশ্বের চলমান স্বাস্থ্য সংকটের সঙ্গে এ ঘটনার সরাসরি মিল রয়েছে। আরেকটি আসন্ন মহামারির ক্ষয়ক্ষতি কমাতে কার্যকর স্বাস্থ্য নজরদারির ব্যবস্থা গড়ে তোলা বিশ্বের জন্য অনিবার্য হয়ে পড়েছে। ভাইরাস ও অন্যান্য জীবাণুর হাত থেকে বিশ্বকে বাঁচানোর জন্য সংকটকালে একটা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলাও সমান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিট্যান্স নিয়ে একটি স্বাধীন গবেষণা হয়েছে। সেখানে সতর্ক করা হয়েছে, ২০৫০ সাল নাগাদ এএমআর মহামারি বছরে এক কোটি মানুষের মৃত্যুর কারণ হবে। এর কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে ১০০ ট্রিলিয়ন ডলার। আমার কাছে স্পষ্ট যে বিদ্যমান জনস্বাস্থ্য ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বৈশ্বিক স্বাস্থ্যের যে বড় ঝুঁকি, সেটা মোকাবিলা করতে পারবে না। স্বাস্থ্য বিষয়ে পূর্ণ মনোযোগ দিতে পারে—এমন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা মোটেই খুব কঠিন কিছু নয়।
এফএসবির মতো জিএইচবির ক্ষেত্রেও নতুন কোনো সংস্থা তৈরির দরকার নেই। বিভিন্ন দেশে স্বাস্থ্য ও অর্থ মন্ত্রণালয়সংশ্লিষ্ট যে কর্মকর্তারা এ ইস্যুতে কাজ করছেন, তাঁদের নিয়েই এ সংস্থার লোকবল পূরণ হতে পারে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, বিশ্বব্যাংক, জাতিসংঘ খাদ্য ও কৃষি সংস্থা, জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি এবং গ্লোবাল ফান্ডের মতো গুরুত্বপূর্ণ এনজিওগুলোর প্রতিনিধিদের এতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
আমরা খুবই আনন্দিত যে জিএইচবি নিয়ে আমাদের প্রস্তাবে জি-২০ জোটের অনেক দেশ বেশ আগ্রহ দেখিয়েছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাপানও রয়েছে। আমাদের ধারণাটি পরীক্ষামূলকভাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গ্রহণ করেছে। প্রকৃতপক্ষে, জিএইচবির প্রস্তাবের বিশেষ উদ্দেশ্য হচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার শক্তি বৃদ্ধি করা। স্বেচ্ছাসেবামূলক অনুদানের মাধ্যমে সংস্থাটির আর্থিক সামর্থ্য বাড়ানো।
জিএইচবি গঠনের প্রস্তাবে যথেষ্ট সমর্থন থাকা সত্ত্বেও ব্রিকস এটার বিরোধিতা করছে। এ বিরোধিতার সূত্রপাত করেছে চীন। করোনাভাইরাসের উৎস নিয়ে প্রশ্নে চীনের সংবেদনশীলতা রয়েছে। আবার বিশ্বের দেশে দেশে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোয় যে বিশাল পার্থক্য রয়েছে, সেটা ঘোচানো সহজ কাজ নয়। তবে চীন কেন জিএইচবির বিরোধিতা করছে, তা বোধগম্য নয়।
সংকটে পশ্চিমাদের মুখাপেক্ষী না হয়ে, জিএইচবির মতো সংস্থা বিশ্বকে, বিশেষ করে উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোকে, একটা পথ দেখাতে পারে। এই আকাঙ্ক্ষার প্রতি চীন যদি সম্মান দেখায়, তাহলে বিশ্বের ৭৯০ কোটি মানুষের স্বার্থসংশ্লিষ্ট এ বিষয়ে গঠনমূলক আলোচনা শুরু হতে পারে। এটার সীমাবদ্ধতা নিয়ে যত বেশি কচকচানি হবে, মানুষের জন্য ততই খারাপ হবে। সে ক্ষেত্রে নেতারাও প্রশ্নের মুখে পড়বেন।
ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
জিম ও’নিল যুক্তরাজ্য সরকারের সাবেক অর্থমন্ত্রী