সেপ্টেম্বর মাসের আলাদা তাৎপর্য আছে। ইহুদি বর্ষপঞ্জিতে এ মাসে নতুন বছর শুরু হয়। সারা দুনিয়ার স্কুলগুলোতে এ মাসে নতুন সেমিস্টারের ক্লাস শুরু হয়। কূটনীতির জগতেও এ মাসের গুরুত্ব অনেক। কারণ, নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন এ মাসেই শুরু হয়।
নতুন বছরে ব্যক্তি থেকে সংগঠন, এমনকি জাতিরাষ্ট্র পর্যায়েও নতুন হিসাব–নিকাশ শুরু হয়।
যুক্তরাষ্ট্রও যে তার কূটনীতিতে নতুন পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে, তা গত ২১ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের দেওয়া ভাষণে স্পষ্ট। বাইডেন তাঁর ভাষণে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র কূটনীতিতে এখন নতুন যুগের সূচনা করছে। বিশ্বের সবখানের পিছিয়ে পড়া জনপদকে তুলে ধরার জন্য তাঁর উন্নয়ন শক্তিকে নিয়োজিত করছে। গণতন্ত্রের সুরক্ষায় সর্বাত্মক ভূমিকা পালন করছে। বাইডেন বলেন, উন্নয়ন, অগ্রগতি, স্বাধীনতা, সাম্য—এসব মূল্যবোধ জাতিসংঘ ও আমেরিকার ‘ডিএনএ–তে প্রোথিত’ আছে। তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র মানবতা, মানবিক মর্যাদা ও ব্যক্তির স্বাধীনতার প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শন করে বলেই আমেরিকানরা একতাবদ্ধ হয়ে বিশ্বসভায় থাকতে পারছে।
বাইডেনের ভাষণে আমেরিকার বৈশ্বিক নেতৃত্ব নবায়নের একটা স্পষ্ট আভাস পরিলক্ষিত হয়েছে। বিশেষ করে, তিনি বৈশ্বিক পরিসরের স্বাস্থ্য, জলবায়ু পরিবর্তন, পরমাণু অস্ত্রবিস্তার রোধ, সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা, সংঘাত রোধ, উন্নয়নশীল দেশের অবকাঠামো, খাদ্যনিরাপত্তা, সাম্য ও দুর্নীতি দমন নিয়ে যেভাবে ভাষণ দিয়েছেন, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক নেতৃত্বদানের প্রত্যয়কে সামনে এনেছেন। বাইডেন স্পষ্ট করেন, সর্বজনীনতা এবং বহুপাক্ষিকতার একটি কাঠামোর মধ্যে থেকে এ লক্ষ্যগুলো অর্জনের চেষ্টা করা হবে।
তবে বাইডেনের ভাষণে কিছু বিষয় বাদ পড়েছে। জাতিসংঘে কোনো প্রস্তাব পাশের ক্ষেত্রে তাদের শুধু ভবিষ্যতের রূপকল্পের দিকে তাকালেই হয় না, তাদের অবশ্যই সততার সঙ্গে অতীতকেও বিশ্লেষণ করতে হয়।
বিশ্ব এখন যে বড় বড় সমস্যার মুখে পড়েছে, সে সম্পর্কে বাইডেন সম্যকভাবে অবগত আছেন। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে দেশটির মিত্ররা এসব সমস্যা মোকাবিলায় নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করবে বলেও তিনি ঘোষণা করেন। তবে আমেরিকার নিজের সাম্প্রতিক ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে বাইডেন প্রশাসন তাদের নিকট অতীতের বিতর্কিত অবস্থান থেকে সরে আসবে—এমন ঘোষণা প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের দেওয়া উচিত ছিল। যুক্তরাষ্ট্র যেসব ভুল নিকট অতীতে করেছে, তা তিনি স্বীকার করতে পারতেন।
যেমন বাইডেন তাঁর ভাষণে বলেন, বৈশ্বিক মহামারি মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্র দেড় হাজার কোটি ডলার সহায়তা দিয়েছে। পাশাপাশি ১৬ কোটি ডোজ টিকা তারা বিশ্বজুড়ে সরবরাহ করেছে। কিন্তু এ বক্তব্য রাখার সময় বাইডেনের এটিও স্বীকার করা উচিত ছিল যে বিশ্বে এ পর্যন্ত ৪৭ লাখ লোক কোভিড–১৯ মহামারিতে মারা গেছেন এবং তাঁদের সাত ভাগের এক ভাগই আমেরিকার বাসিন্দা। এ বিশালসংখ্যক মৃত্যুহার প্রমাণ করে আমেরিকা নিজেই করোনা মোকাবিলার সক্ষমতা রাখে না। সেখানকার অনেক জায়গায় স্বাস্থ্যবিধি না মানার কারণে এ ভাইরাসের নতুন নতুন ধরনের উদ্ভব হয়েছে।
বাইডেন যখন জলবায়ু পরিবর্তনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশংসনীয় ভূমিকার কথা বলেন, তখন যুক্তরাষ্ট্র নিজেই যে এ সমস্যার জন্য অন্যতম দায়ী দেশ তা তিনি স্বীকার করতে পারতেন। যুক্তরাষ্ট্র যে একেবারের প্রথম সারির গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণকারী দেশ, সে কথা স্বীকার করার সৎ সাহস তাঁর থাকা উচিত ছিল।
জো বাইডেন তাঁর ভাষণে যখন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আমেরিকার ‘অনন্তকালের যুদ্ধের’ কথা উল্লেখ করেন, তখন তাঁর স্বীকার করে নেওয়া উচিত ছিল যে ইরাক ও আফগানিস্তানে তারা অভিযান চালানোর পর যতসংখ্যক সেনা নিহত হয়েছেন, তার বহুগুণ বেশি সাধারণ নিরীহ মানুষ এ সময় মারা গেছেন। এমনকি আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা সরিয়ে নেওয়ার পর আমেরিকান ড্রোন থেকে ছোড়া গোলার আঘাতে সাতজন নিরীহ শিশু ও একজন চিকিৎসাকর্মী নিহত হন।
বাইডেন যখন বলছিলেন দুর্নীতি জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি, তখন তাঁর একথাও স্বীকার করা উচিত ছিল ২০১১ সালেই যুক্তরাষ্ট্র জানতে পেরেছিল আফগান সরকারের দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তারা মার্কিন সহায়তার অর্থ লুটপাট করে খাচ্ছিলেন এবং সব জেনেও মার্কিন সরকার সেই দুর্নীতিবাজ সরকারকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছিল।
এসব সমস্যা স্বীকার করার মধ্যে গ্লানি নয়, বরং সততা আছে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
অ্যান ম্যারি স্লটার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগের সাবেক পলিসি প্ল্যানিং পরিচালক ও দ্য থিঙ্কট্যাংক নিউ আমেরিকার প্রধান নির্বাহী