ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ব্যর্থ ‘ব্রোমাঞ্চের’ (দুই পুরুষের মধ্যে যৌনতাহীন উষ্ণ ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক) তিন বছর পর উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং–উন আবার যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছেন বলে মনে হচ্ছে। উত্তর কোরিয়া সম্প্রতি উচ্চ প্রযুক্তির নতুন একটি ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে এবং এর মাধ্যমে তারা দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে আলোচনা পুনরায় শুরু হতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছে। অন্য দিকে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জে–ইন উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে আলোচনা শুরু করতে নিজ দেশের অভ্যন্তর থেকে চাপে রয়েছেন। তাঁর নিজের দলের কর্মী-সমর্থকেরা দুই কোরিয়ার বিবাদ মেটানোর পক্ষে রয়েছেন। ফলে রাজনৈতিক কারণে তিনি উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার মরণাপন্ন কূটনৈতিক সম্পর্ককে পুনরুজ্জীবিত করতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। তবে জো বাইডেনের দিক থেকে এ বিষয়ে তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না।
কিম জং–উন যদি দুই কোরিয়ার আলোচনার বিষয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের দিক থেকে কোনো ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া আশা করে থাকেন, তাহলে এখানেই তাঁকে থেমে থাকলে চলবে না। বাইডেন যদি তাঁর করণীয় বিষয়গুলোর মধ্যে চীন ইস্যু এবং মার্কিন মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্ক ধরে রাখার বিষয়কে উত্তর কোরিয়া ইস্যুর চেয়ে বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকেন, তাহলে তাঁর পক্ষে কিমকে গুরুত্ব দেওয়ার সময় হবে বলে মনে হয় না। নিজের লক্ষ্য পূরণে কিমকে তাঁর পুরোনো নাটকই নতুন করে মঞ্চস্থ করতে হচ্ছে। তাঁর সর্বশেষ নাটকের প্রথম অঙ্কে তাঁর বোন ও দুই কোরিয়াবিষয়ক মুখপাত্র কিম ইয়ো জংকে বলতে দেখলাম, দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জে–ইন গত সেপ্টেম্বর মাসে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে শান্তিচুক্তি করতে আলোচনা শুরুর যে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তাতে উত্তর কোরিয়া আগ্রহী। তবে তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, এর জন্য উত্তর কোরিয়াকে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের যে প্রস্তাব যুক্তরাষ্ট্র দিয়ে রেখেছে, তা থেকে দক্ষিণ কোরিয়াকে দূরত্ব বজায় রাখতে হবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যৌথ সামরিক মহড়া দেওয়া থেকেও বিরত থাকতে হবে।
কিমের জন্য অসুবিধার বিষয় হলো, ট্রাম্প তাঁকে যতখানি ছাড় দিতে চেয়েছিলেন, বাইডেন তা দেবেন না। বাইডেন আমেরিকার মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ করাকে প্রাধান্য দিচ্ছেন। শান্তি আলোচনায় বসার বিনিময়ে উত্তর কোরিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা যদি কিছুটা শিথিল করা সম্ভব হয়, তাহলে কিম অনেকটা চাপমুক্ত হতে পারতেন।
কিম ইয়ো জংয়ের বক্তব্যের দিন কয়েক পরই নাটকের দ্বিতীয় অঙ্ক মঞ্চস্থ হলো। পূর্বধারণা মোতাবেক উত্তর কোরিয়া তাদের সমরসজ্জা প্রদর্শন করল। একটি নতুন হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রসহ আধডজন অন্য অস্ত্র পরীক্ষা করা হলো। এরপর কিম জং–উন যথারীতি তাঁর ভাষণের টেবিলে হাজির হলেন। তিনি উত্তর কোরিয়ার সামরিক শক্তিকে ‘বিশ্বমানের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা’ হিসেবে উল্লেখ করলেন। যদিও যুক্তরাষ্ট্র উত্তর কোরিয়ার প্রতি বিদ্বেষমূলক আচরণ করবে না বলে জানিয়েছে, তারপরও কিম বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেছেন, বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশগুলোকেও উত্তর কোরিয়া মোকাবিলা করার ক্ষমতা রাখে।
কিম একাই যে নাটকের পুরোনো পাণ্ডুলিপি ব্যবহার করছেন, তা নয়। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্টও আলোচনায় বসার উপক্রমণিকা হিসেবে আগের পথই অনুসরণ করছেন। কিম ইয়ো জংয়ের ঘোষণার পর মুনের গণতন্ত্রী পার্টির সমর্থকেরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যৌথ মহড়ায় যাওয়া স্থগিত রাখা এবং আলোচনার অন্যান্য পূর্বশর্ত মানতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। উত্তর কোরিয়ার লক্ষ্য একটাই। সেটি হলো পরমাণু কার্যক্রমসংক্রান্ত যেসব নিষেধাজ্ঞা দীর্ঘদিন দেশটিকে অচল করে রেখেছে, সেই নিষেধাজ্ঞাকে যথাসম্ভব শিথিল করা। পাঁচ বছর আগে থেকে কিম তাঁর অভ্যন্তরীণ নীতির মধ্যে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে আসছেন। তারপরও বন্যা, খাদ্যাভাব ও মহামারিজনিত লকডাউন তার দেশকে বিপর্যয়কর অবস্থায় নিয়ে গেছে। গত জানুয়ারিতেও কিম আত্মনির্ভরশীলতার ওপর জোর দিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন।
তবে হোয়াইট হাউস এখন কিমকে ছাড় দেবে বলে প্রতীয়মান হয় না। ২০১৮ সালে সিঙ্গাপুরে এবং ২০১৯ সালে হ্যানয়ে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প উত্তর কোরিয়ার নেতা উনের সঙ্গে বৈঠক করার সময় উত্তর কোরিয়ার ওপর আরোপিত অবরোধ কিছুটা হলেও শিথিল করা হতে পারে বলে আশা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বাইডেন প্রশাসন সেই অবস্থান থেকে সরে গেছে। গত এপ্রিলে জো বাইডেন কংগ্রেসে বলেছেন, আলোচনায় বসার শর্ত হিসেবে উত্তর কোরিয়াকে কোনো ধরনের ছাড় দেওয়া হবে না। কোনো ধরনের পূর্বশর্ত না থাকলে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র যেকোনো সময়ই বসতে রাজি আছে।
কিমের জন্য অসুবিধার বিষয় হলো, ট্রাম্প তাঁকে যতখানি ছাড় দিতে চেয়েছিলেন, বাইডেন তা দেবেন না। বাইডেন আমেরিকার মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ করাকে প্রাধান্য দিচ্ছেন। শান্তি আলোচনায় বসার বিনিময়ে উত্তর কোরিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা যদি কিছুটা শিথিল করা সম্ভব হয়, তাহলে কিম অনেকটা চাপমুক্ত হতে পারতেন। এখন যেহেতু বাইডেন সে সুযোগ দিতে চান না, সেহেতু কিম জং–উনের সামনে আবার পরমাণু কার্যক্রমকে গতিশীল করে তথা যুক্তরাষ্ট্রকে চাপে রেখে ওয়াশিংটনকে আলোচনায় আগ্রহী করার চেষ্টা করা ছাড়া আর কোনো পথ নেই।
ইংরেজি থেকে অনূদিত, সত্ত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
● কেন্ট হ্যারিংটন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর সাবেক বিশ্লেষক