বদলের হাওয়ায় সৌদি নারীরা
সত্যিই খেল দেখিয়ে চলেছেন সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান। নারীদের গাড়ি চালানোর অনুমতি, ফুটবল মাঠে বসে খেলা দেখার অধিকার—এরপর সরাসরি সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার সুযোগ! বছর খানেক আগেও সৌদি নারীদের এসব অধিকারের কথা ভাবা ছিল স্বপ্নেরই নামান্তর।
সৌদি বাদশাহ সালমান গত জুনে ভাতিজা মোহাম্মদ বিন নায়েফকে সরিয়ে সিংহাসনের উত্তরসূরি করেন ছেলে মোহাম্মদ বিন সালমানকে। এরপর থেকে বদলের হাওয়া বইতে শুরু করেছে ‘রক্ষণশীল’ দেশ বলে পরিচিত সৌদি আরবে। দেশটি অর্থনৈতিক সংস্কারের নামে তেলভিত্তিক অর্থনীতির ওপর নির্ভরতা কমানো, পর্যটন ও শিল্পায়নে গুরুত্ব দেওয়া, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ, আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতি আর নারীদের অধিকারের বিষয়ে ধাপে ধাপে অনেকটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা হচ্ছে, যার মূল কৃতিত্ব দেওয়া হচ্ছে তরুণ ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানকে। বাবা বাদশাহ সালমান সিংহাসনে থাকলেও কার্যত অনেকে ক্ষেত্রেই মূল ভূমিকা পালন করছেন এই যুবরাজ।
ধাপে ধাপে অধিকার পাওয়া সৌদি নারীরা এবার দেশটির সৌদি সেনাবাহিনীতেও যোগ দিতে যাচ্ছেন। এই নিয়োগপ্রক্রিয়া ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। নারীরা তাতে আবেদন করছেন। আপাতত মক্কা, মদিনা, রিয়াদ ও আল-কাসিম প্রদেশেই শুধু নারী ‘সৈনিক’ পদে তাঁরা নিয়োগ পাবেন। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লিখিত ১২টি যোগ্যতার মধ্যে রয়েছে আবেদনকারীকে অবশ্যই সৌদি নাগরিক হতে হবে, বয়স হতে হবে ২৫ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে, হাইস্কুল ডিপ্লোমাধারী হতে হবে। আর যে প্রদেশে চাকরি করতে চান, সেই প্রদেশে অবশ্যই আবেদনকারী ও তাঁর অভিভাবকের (স্বামী, বাবা, ভাই কিংবা ছেলে) থাকার জায়গা থাকতে হবে।
মাত্র বছর তিনেক আগে ভোটাধিকার ও নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অধিকার পান সৌদি নারীরা। এরপর নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে গত সেপ্টেম্বরে গাড়ি চালানোর অধিকার পান নারীরা। চলতি বছরের জুন থেকে তা আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকর হওয়ার কথা। ওই সেপ্টেম্বরেই নারীদের ফতোয়া জারির অধিকার দেওয়া হয়। একই সঙ্গে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া সৌদি ছাত্রীদের মোবাইল ফোন ব্যবহারের অনুমতিও দেওয়া হয়। আর গত মাসে প্রথমবারের মতো মাঠে বসে ফুটবল খেলা দেখার অধিকার দেওয়া হয় তাঁদের। এসব বিষয় বিবেচনায় সৌদি সেনাবাহিনীতে নারীদের যোগ দেওয়ার অধিকারটা দ্রুতই পাওয়া গেলে বলা যায়।
সৌদি নারীদের এই অধিকার পাওয়ার তালিকার চেয়ে আটকে থাকার তালিকাটা কিন্তু এখনো দীর্ঘ। এখনো পাসপোর্ট করা, বিদেশ ভ্রমণ, বিয়ে, ব্যাংক হিসাব খোলা, কোনো ব্যবসা শুরু করা, কোনো ধরনের সার্জারি—এমনকি সাজা শেষ হওয়ার পর কারাগার ছেড়ে যাওয়ার জন্যও সৌদি নারীকে অবশ্যই তাঁর পুরুষ অভিভাবকের অনুমতি নিতে হয়, যেটা দেশটিতে ‘অভিভাবকত্ব ব্যবস্থা’ বলে পরিচিত। মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, এই অভিভাবকত্ব ব্যবস্থার কারণে সৌদি নারীরা ব্যাপক বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। সরকার এই ব্যবস্থা তুলে দেওয়ার কথা বললে তা বাস্তবায়ন করছে না। বিষয়টি নিয়ে সৌদি নারী অধিকার কর্মীরা সোচ্চার হয়ে উঠছেন। সৌদি নারীদের গাড়ি চালানোর অধিকার আদায়ের আন্দোলনের অগ্রদূত মানাল আল শরিফ সম্প্রতি চলমান ‘অভিভাবকত্ব ব্যবস্থার’ বিরুদ্ধে টুইট করেছেন। লিখেছেন, ‘এগিয়ে যাওয়ার পথে আমিই আমার অভিভাবক’।
তবে ৩২ বছর বয়সী ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান এই বিষয়গুলোতেও সংস্কার আনবেন কি না, তা সময় বলে দেবে। প্রায় নয় দশক ধরে সৌদি আরবের ক্ষমতায় থাকা বর্তমান রাজবংশের কেউই এই বিষয়গুলো নিয়ে ভাবেননি। শুধু নারী অধিকারের বিষয়েই নয়, অন্য কোনো বিষয়েও সংস্কারের পথে হাঁটেননি তাঁরা। এর কারণ হয়তো দেশটির ‘রক্ষণশীল সমাজের’ বিরুদ্ধে যেতে চাননি কেউই। সেখানে মোহাম্মদ বিন সালমান অনেকটা নিজের মতো করে বদলের হাওয়া বইয়ে দিচ্ছেন। বলা হয়ে থাকে, তেলভিত্তিক অর্থনীতি আর ধর্মীয় নেতাদের পরামর্শের ওপর ভর করে দেশ পরিচালনা সৌদি আরবের পুরোনো মডেল। তাহলে তো বর্তমান ক্রাউন প্রিন্স তা ভেঙে বেরিয়ে নতুন মডেল প্রবর্তনের চেষ্টা করছেন। যে মডেলের মূলমন্ত্র জাতীয়তাবাদ ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন। যা ‘ভিশন ২০৩০’ শিরোনামে একটি মহাপরিকল্পনায় প্রকাশ করেছেন তিনি। তবে এই মহাপরিকল্পনার সফলতা নির্ভর করছে নানা হিসাব-নিকাশের ওপর।
মাহফুজার রহমান: সাংবাদিক
[email protected]