২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

বঙ্গবন্ধুর কার্যালয়ে কয়েক মাস

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
ছবি: সংগৃহীত

প্রায় আড়াই মাস অননুমোদিত ছুটি কাটানোর পর একাত্তরের ডিসেম্বরের শেষের দিকে আমি সরকারি চাকরিতে ফিরে আসি। এর আগে আমি ছিলাম মানিকগঞ্জ মহকুমার প্রশাসক। ছুটি অননুমোদিত না বলে বলা উচিত, মহকুমা থেকে আমাকে একরকম পালিয়ে যেতে হয়েছিল সেখানকার সামরিক প্রশাসনের বিরাগভাজন হয়েছিলাম বলে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমাকে নিযুক্তি দেওয়া হয়েছিল নতুন সরকারের সেক্রেটারি জেনারেল রুহুল কুদ্দুস সাহেবের বিশেষ সহকারী হিসেবে। সেক্রেটারি জেনারেল ছিলেন সরকারের প্রধান সচিব, যিনি প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবও ছিলেন। (আমি যখন এ কাজে যোগ দিই, তখন তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী)।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর যে বড় ঘটনা ঘটে তা হচ্ছে, ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তন। আমি ঢাকায় থেকেও সেদিন সেই মানুষের ঢেউ ভেঙে বিমানবন্দর বা এরপর রমনা রেসকোর্সে তাঁকে দেখতে যেতে পারিনি। আমি তাঁকে দেখলাম পর দিন। সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিংয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে তিনি এসেছিলেন। আমি ভবনের তিনতলায় প্রথম তাঁকে কাছ থেকে দেখলাম। এর আগে শুধু তাঁর ছবি দেখেছিলাম খবরের কাগজে, টিভিতে। ৭ মার্চে তাঁর রমনা মাঠের বক্তৃতা শুনতে গিয়েছিলাম। সেই মানুষের সমুদ্রে তাঁর ভাষণ শুনেছি, তাঁকে দেখতে পাইনি। জানুয়ারির ১১ তারিখ তাঁকে এই প্রথম দেখলাম।

ছবিতে তাঁকে যেমন দেখেছি, তেমনি সামনাসামনি দেখলাম। লম্বা ঋজু দেহ, মুখে হাসি। দেখে মনে হলো না, এই মানুষ কিছুদিন আগেও মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
সেদিন থেকে আমার উর্ধ্বকর্তা রুহুল কুদ্দুসেরই বস বদল হলো না, আমিও প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কার্যালয়ে কাজ শুরু করলাম। আমি সেই কার্যালয়ে চার মাস ছিলাম। জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত।

আমার উর্ধ্বকর্তা রুহুল কুদ্দুস ছিলেন স্বল্পভাষী, ভারি অমায়িক, কিন্তু কঠোর পরিশ্রমী। সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশে তখনো কীভাবে একটি সার্বভৌম দেশ চালাতে হবে, তার জন্য অভিজ্ঞ কর্মচারী ছিলেন যত্সামান্য। প্রায় সব কর্মচারী ছিলেন প্রাদেশিক সরকারের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। এর মধ্যে যাঁরা ওপারে অন্তর্বর্তী সরকারে ছিলেন, তাঁরা যখন ঢাকায় ফিরে এসে আগের নিজ নিজ পদে স্থান নিলেন, তাঁদের চেয়ে চাকরিতে জ্যেষ্ঠ এবং বয়সেও বড় কর্মচারীরা হীনম্মন্য হলেন।

এ সময় চাকরিতে যথেষ্ট জ্যেষ্ঠ এবং অভিজ্ঞ রুহুল কুদ্দুস এ নাজুক পরিস্থিতি বিচক্ষণতার সঙ্গে সামলান এবং বঙ্গবন্ধু তাঁর পরামর্শ দ্বিধাহীনভাবে গ্রহণ করেন। তাঁর অভিজ্ঞতা ছাড়াও রুহুল কুদ্দুস ছিলেন বঙ্গবন্ধুর পুরোনো বন্ধু এবং বিশ্বস্ত ব্যক্তি। রাজনৈতিক পরামর্শ ছাড়া নতুন সরকারের সব প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত বঙ্গবন্ধু তাঁর পরামর্শ অনুযায়ী নিতেন।

সে সময় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ছিল সেক্রেটারিয়েট ভবনের তিনতলায়, যা পাকিস্তান আমলে ছিল পূর্ব পাকিস্তানের চিফ সেক্রেটারির অফিস। সে তলায় অবস্থিত ছিল সেক্রেটারি জেনারেলের (পরে যে পদটিকে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব করা হয়) এবং প্রধানমন্ত্রীর সচিবের কার্যালয়ও ছিল। স্বাধীনতা-পরবর্তী কয়েক মাস সচিবালয় এক বিশৃঙ্খল স্থানে পরিণত হতো প্রচুর অনাহূত ব্যক্তিদের আগমনে। তাঁদের অনেকে ছিলেন মন্ত্রীদের দর্শনার্থী, অনেকে আওয়ামী লীগের কর্মী। অনেকে নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিয়ে ঢুকে পড়তেন। অনেকে আসতেন বঙ্গবন্ধুকে একনজর দেখার জন্য।

এ ধরনের বাঞ্ছিত বা অবাঞ্ছিত লোক ঠেকাতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে দুটি বলয়ের আশ্রয় নেওয়া হয়েছিল। একটি ছিল পুলিশি প্রহরা, আরেকটি ছিল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রবেশদ্বার সচিবের অফিস দিয়ে আটকানো। এতে এই হলো যে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে প্রথমে পুলিশ কক্ষ এবং পরে সচিবের অফিস পার করে আসতে হতো।

প্রধানমন্ত্রীর কাছে নথি আনা–নেওয়া ছিল এক পরিশ্রমের ব্যাপার। তখনকার দিনে সরকারি প্রায় সব কাজে সিদ্ধান্তের জন্য নথি পাঠানো হতো সব মন্ত্রীর কাছ থেকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে। কোনো কোনো জরুরি সিদ্ধান্তের জন্য নথি সে মন্ত্রণালয়ের সচিব নিজে মুখ্য সচিবের কাছে নিয়ে যেতেন।

আমি যদিও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে নিযুক্ত ছিলাম, আমার কাজ ছিল মুখ্য সচিবের সঙ্গে, এবং প্রধানত তাঁর কাছে দৈনিক নথি নিয়ে যাওয়া যাতে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন প্রয়োজন। এ ছাড়া রুহুল কুদ্দুস সাহেব আমাকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে লেখা বিভিন্ন লোকের পত্র পড়ে খসড়া উত্তর তৈরি করতে বলতেন। এই দ্বিতীয় কাজটি বেশ আকর্ষণীয় ছিল। কারণ, এ পত্রলেখকদের মধ্যে সাধারণ লোক ছাড়াও বাংলাদেশ ও ভারতের অনেক বিখ্যাত লোক ছিলেন। তাঁদের মধ্যে দুজনের নাম নিতে পারি, যেমন মাওলানা ভাসানী এবং পশ্চিমবঙ্গের মৈত্রেয়ী দেবী।

প্রধানমন্ত্রীর কাছে নথি আনা–নেওয়া ছিল এক পরিশ্রমের ব্যাপার। তখনকার দিনে সরকারি প্রায় সব কাজে সিদ্ধান্তের জন্য নথি পাঠানো হতো সব মন্ত্রীর কাছ থেকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে। কোনো কোনো জরুরি সিদ্ধান্তের জন্য নথি সে মন্ত্রণালয়ের সচিব নিজে মুখ্য সচিবের কাছে নিয়ে যেতেন।

বাকি সব সিদ্ধান্তের জন্য নথি রুহুল কুদ্দুস সাহেব আমার হাতে দিয়ে বলতেন, এটা পড়ে আমি যেন তাঁর জন্য একটি ছোট সারমর্ম লিখে নিয়ে যাই। ভাবতে এখন অবাক লাগে, তখনকার দিনে বড় বড় চুক্তি বা কন্ট্রাক্টের সিদ্ধান্ত ছাড়াও মন্ত্রণালয় বা কোনো অধিদপ্তরের কর্মচারী নিয়োগ, তাঁদের পদোন্নতি, এমনকি তাঁদের বিদেশ ভ্রমণের জন্যও প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন প্রয়োজন ছিল। আমি প্রতিদিন অন্তত ৪০ থেকে ৫০টি নথি নিয়ে যেতাম রুহুল কুদ্দুস সাহেবের কাছে। তিনি সেগুলো তাঁর টেবিলে রাখতে বলতেন। বিকেলে প্রায়ই সেই নথিগুলো অদেখা অবস্থায় ফেরত নিয়ে আসতাম। কারণ, সেই নথিগুলো তাঁর দেখার সময় হয়নি। এর কারণ, তিনি বঙ্গবন্ধু কিংবা অন্য মন্ত্রী বা সচিবদের সঙ্গে মিটিংয়ে ব্যস্ত থাকতেন। বলা বাহুল্য, প্রধানমন্ত্রীর কাছে নথি পৌঁছানোর আমার কোনো সুযোগ ছিল না।

সেই সুযোগ এল অপ্রত্যাশিতভাবে একদিন সকালে, আমার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে কাজ করার প্রায় তিন মাস পর। আমার হাতে এল তৎকালীন ত্রাণমন্ত্রী কামারুজ্জামান সাহেবের অফিস থেকে একটি জরুরি নথি, যাতে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন প্রয়োজন। এটি ছিল বিদেশি একটি সংস্থার মোটা একটি কার্যক্রমের অনুমোদন। আমি যথারীতি নথিটি নিয়ে রুহুল কুদ্দুস সাহেবের অফিসে গেলাম। গিয়ে দেখি তিনি অন্য কাজে সচিবালয়ের বাইরে। অগত্যা আমি সচিব রফিকুল্লাহ চৌধুরীর কাছে গিয়ে তাঁকে নথিতে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন নেওয়ার জন্য অনুরোধ করি। রফিকুল্লাহ চৌধুরী বললেন, ‘তুমি নিজেই নিয়ে যাও না কেন?’ আমি যখন তাঁকে বললাম, আমি কখনো প্রধানমন্ত্রীর সামনে যাইনি, তিনি বললেন, ‘চলো আমার সঙ্গে’।

বঙ্গবন্ধু আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘জিয়া, জিয়াউদ্দিন? আমি তো তোকে চিনি। এই তুই মুন্সিগঞ্জের এসডিও ছিলি না?’ বঙ্গবন্ধুর কথা শুনে আমার তো মাটিতে পড়ার অবস্থা! বলেন কী, তিনি শুধু আমার নামই জানেন না, আমি কোথায় কাজ করেছি সব জানেন! (আমি ১৯৭১ মার্চ মাসে মুন্সিগঞ্জে ছিলাম)।

এই প্রথম আমি প্রধানমন্ত্রীর অফিসের ভেতর ঢুকি। অফিস ছিল খুব অপরিসর, একটি বড় টেবিল, আর সামনে চার পাঁচটি চেয়ার। টেবিলে ছিল বেশ কয়েকটি নথি। বঙ্গবন্ধু একটি নথি পড়ছিলেন। আমরা ঢুকতেই তিনি তাকালেন রফিকুল্লাহ চৌধুরীর দিকে, পরে আমার দিকে। জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী কাজ?’ রফিকুল্লাহ তখন আমার দিকে দেখিয়ে বললেন, ‘স্যার, এ জিয়া, আমাদের সহকারী। ত্রাণমন্ত্রী একটি জরুরি বিষয় নিয়ে আপনার অনুমোদন চাচ্ছেন।’

বঙ্গবন্ধু আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘জিয়া, জিয়াউদ্দিন? আমি তো তোকে চিনি। এই তুই মুন্সিগঞ্জের এসডিও ছিলি না?’ বঙ্গবন্ধুর কথা শুনে আমার তো মাটিতে পড়ার অবস্থা! বলেন কী, তিনি শুধু আমার নামই জানেন না, আমি কোথায় কাজ করেছি সব জানেন! (আমি ১৯৭১ মার্চ মাসে মুন্সিগঞ্জে ছিলাম)।

আমার অবাক হওয়ার পালা শেষে আমাকে তিনি শুধু বললেন একটু অপেক্ষা করতে। আমি ফাইল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে, রফিকুল্লাহ আমাকে রেখে ঘর ছেড়ে চলে গেলেন। ঘরে শুধু বঙ্গবন্ধু আর আমি। আমাকে অপেক্ষা করতে বলে ফোন উঠিয়ে বললেন, তাঁকে শিক্ষামন্ত্রী ইউসুফ আলীর সঙ্গে মিলিয়ে দিতে। ওপাশে আওয়াজ আমি শুনলাম না, তবে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বঙ্গবন্ধু বলে উঠলেন, ‘ইউসুফ, তোমার অনুরোধ আমি দেখলাম। তুমি ভারত সফরে যাচ্ছ ভালো কথা, তবে এ সফরে তোমার ঘটা করে ভারতীয় মন্ত্রীদের নৈশভোজ দিয়ে আপ্যায়ন করার কোনো প্রয়োজন নাই। আমরা সদ্য স্বাধীন একটি দরিদ্র দেশ, মাননীয় ইন্দিরা গান্ধী থেকে শুরু করে ভারতের সব মন্ত্রী আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা জানেন। আমার সামনে পোলাপান (অর্থাৎ আমি) দাঁড়িয়ে আছে, তার সামনে কটু কথা বললাম না।’

এই বলে তিনি ফোন রেখে সামনে রাখা একটি নথি টেনে তার ওপর লিখতে শুরু করলেন, আর জোরে জোরে তা নিজে বলতে থাকলেন। ‘শিক্ষামন্ত্রীর ভারত সফর জরুরি সরকারি কাজে। সে জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে নৈশভোজে আমন্ত্রণ করার কোনো দরকার নাই। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎকার যথেষ্ট। ভারতের প্রধানমন্ত্রী এবং অন্যান্য মন্ত্রীদের বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ভালোভাবে জানা। শিক্ষামন্ত্রীর এ অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করা হইল।’এই বলে নথিটি একপাশে রেখে আমার উদ্দেশে বললেন, ‘বুঝলি, এত কথা কেন লিখলাম? লিখলাম কারণ, ভবিষ্যতে এ ধরনের অপচয় আর কেউ যেন না করে।’এর পর তিনি আমার হাতের ফাইলটি নিয়ে দেখে, তাতে সই করে ফেরত দিলেন। আমি সালাম দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলাম। বের হওয়ার সময় শুধু ভাবলাম, তাঁর এই চিন্তার প্রতিফলন বাংলাদেশের অন্য মন্ত্রী বা আমলাদের কাজে লাগবে। দুঃখের বিষয়, তা হয়নি।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ওই পদে আমি মে মাস অবধি ছিলাম। সে ঘটনার পর তাঁর কাছে আমাকে যেতে হয়নি। তবে আরেকবার তলব এসেছিল তাঁর অফিস থেকে মাওলানা ভাসানীর প্রেরিত এক চিঠির উত্তর প্রসঙ্গে, যদিও মুখোমুখি হতে হয়নি। ভাসানী অনেক বিষয়ই বঙ্গবন্ধুকে চিঠি লিখতেন সন্তোষ থেকে।

এটা-সেটা অনুরোধ থাকত, যা আমরা পাঠিয়ে দিতাম প্রাসঙ্গিক মন্ত্রণালয়ে। একবার একটি চিঠি এল তাঁর কাছ থেকে, ভাসানীর পৃষ্ঠপোষকতায় প্রস্তাবিত ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক অনুদান চেয়ে। ভাসানী আরও চাইলেন, এ ব্যাপারে সাহায্য করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক ইতিহাস বিভাগের কোনো এক অধ্যাপকের (আমার নাম ঠিক মনে নেই) প্রেষণে প্রস্তাবিত ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্প পরিচালক হিসেবে। আমাকে রুহুল কুদ্দুস সাহেব চিঠির একটি খসড়া উত্তর তৈরি করতে বলেন, কী লিখব তা না বলে।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ওই পদে আমি মে মাস অবধি ছিলাম। সে ঘটনার পর তাঁর কাছে আমাকে যেতে হয়নি। তবে আরেকবার তলব এসেছিল তাঁর অফিস থেকে মাওলানা ভাসানীর প্রেরিত এক চিঠির উত্তর প্রসঙ্গে, যদিও মুখোমুখি হতে হয়নি। ভাসানী অনেক বিষয়ই বঙ্গবন্ধুকে চিঠি লিখতেন সন্তোষ থেকে।

আমি ভাসানীর এ প্রস্তাবের কী উত্তর দেব তা ভেবে পেলাম না, কারণ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর কী প্রতিক্রিয়া হবে, তা আমার জানা ছিল না। আমি ভাবলাম, বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা একটি মূল স্তম্ভ। তাই কোনো এক ধর্মভিত্তিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে সরকারি সাহায্যে নির্মাণ করা সম্ভব নয়। আর সরকার যেখানে জড়িত নয়, সেখানে একজন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে প্রেষণে পাঠানোর প্রশ্ন ওঠে না।

আমি সেভাবে একটি খসড়া উত্তর তৈরি করি, আর তা পাঠিয়ে দেই রুহুল কুদ্দুস সাহেবের কাছে। সমস্যা হয়, যখন রুহুল কুদ্দুস সাহেব সেটা না দেখে বঙ্গবন্ধুর কাছে পাঠিয়ে দেন। এক দিন পর আমার তলব হয় প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে। আমি সঙ্গে সঙ্গে যাই রুহুল কুদ্দুস সাহেবের কাছে। কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, ‘তোমার খসড়া পরিবর্তন করতে হবে। তবে তোমাকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আর দেখা করতে হবে না। তিনি নিজেই তোমার খসড়াতে লিখে দিয়েছেন। তুমি সেটা তোমার খসড়া পরিবর্তন করে এনে দাও।’

আমি খসড়া হাতে আমার অফিসে ফিরে এলাম। ফাইল খুলে দেখি আমার উত্তরটি প্রথম লাইন থেকে শেষ পর্যন্ত কালি দিয়ে কাটা। নিচে গোটা গোটা অক্ষরে বঙ্গবন্ধুর নিজ হাতে লেখা উত্তর। আজ প্রায় পঞ্চাশ বছর পর উত্তরটি অক্ষরে অক্ষরে পুনরাবৃত্তি করতে পারব না, যা মনে আছে তাই বলছি, ‘জনাব মাওলানা সাহেব: আপনার প্রস্তাবটি পাইলাম এবং দেখিলাম। ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা সম্পর্কে আমি আপনার সঙ্গে সহমত। দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আপনার জানা আছে। সে জন্যে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে সরকারি সাহায্য করতে আমরা অপারগ। তবে আপনার অনুরোধে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে (অমুক) অধ্যাপককে আপনার কাজে সাহায্য করতে প্রেষণে পাঠানোর জন্য বলিতেছি।’

আমি আর দেরি না করে বঙ্গবন্ধুর সংশোধিত উত্তর তৈরি করে সঙ্গে সঙ্গে পাঠিয়ে দেই তার অফিসে। পাঠালাম আর ভাবলাম, বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শিতা আর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা সমকালীন আর কোনো রাজনৈতিক নেতার আছে কি না? স্মরণ করা যেতে পারে ভাসানী তখন হক কথা বলে একটি ছোট আকারের দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ করতেন, যা ছিল নতুন সরকারের ঘোরতর সমালোচক।

আমার বিশ্বাস, বঙ্গবন্ধু সেই পত্রিকা আর তার তীব্র সমালোচনা সম্পর্কে তিনি পুরোপুরি অবহিত ছিলেন। কিন্তু রাজনীতি এমনই যে তাতে কেউই চিরকাল মিত্র বা চিরকাল শত্রু নয়। সব রাজনৈতিক প্রজ্ঞা আর বিচক্ষণতার আলোকে দেখতে হয়। বঙ্গবন্ধু ছিলেন সে রকমেরই ব্যক্তি। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁর সঙ্গে আমি কিছুদিন হলেও কাজ করেছি, আমার চাকরিজীবনের শুরুর দিকে।

কামারুজ্জামান আমাকে ইঙ্গিত করে বললেন আমার হাতে রাখা তাঁর পদত্যাগপত্র বঙ্গবন্ধুর কাছে দিতে। আমি তা দিতেই বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘পদত্যাগপত্র?’ কামারুজ্জামান হেসে বললেন, তাই। হাতে নিয়ে বঙ্গবন্ধু আমাকে বললেন তৌফিক ইমামকে (তখন কেবিনেট সেক্রেটারি) ডেকে আনতে। আমি যেই বেরিয়ে যাচ্ছি, বঙ্গবন্ধু কামারুজ্জামানকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এ তোর প্রাইভেট সেক্রেটারি না? তাকে তুই কোথায় রেখে যাচ্ছিস?’

আমি বঙ্গবন্ধুর কার্যালয় থেকে মে মাসে চলে যাই ত্রাণমন্ত্রী কামরুজ্জামান সাহেবের একান্ত সচিব হিসেবে। তাঁর সঙ্গে একটানা দুবছর কাজ করি দুটি মন্ত্রণালয়ে। প্রথম ত্রাণ, এর পর বাণিজ্য। বঙ্গবন্ধুর কার্যালয়ে পুনর্বার কাজের সুযোগ হয়েও হয়নি। সেটার বর্ণনা একটু দেওয়া দরকার।

১৯৭৪–এর ফেব্রুয়ারিতে কামরুজ্জামান আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন, বঙ্গবন্ধু সে পদ পরিত্যাগ করলে। আমার তখন একান্ত সচিবের পদ ছেড়ে কোনো জেলায় চলে যাওয়ার কথা নিয়ম অনুযায়ী। আমি ঢাকা ছেড়ে তখন কোনো জেলায় যেতে চাইছিলাম না। কামারুজ্জামান সাহেবকে মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করে দলের সভাপতি হিসেবে যোগ দেওয়ার আগে তিনি আমাকে বললেন তাঁর পদত্যাগপত্র তৈরি করে তাঁর কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য।

আমি নিয়ে গেলে তিনি আমাকে বললেন, পদত্যাগপত্র প্রধানমন্ত্রীর হাতে তিনি নিজে দেবেন প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনের কার্যালয়ে। তিনি আমাকে বললেন তাঁর সঙ্গে যেতে। তখন সন্ধ্যা।

প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন তখন ছিল মিন্টো রোডে। আর মন্ত্রী কামরুজ্জামানের সরকারি বাড়ি ছিল হেয়ার রোডে। হাঁটাপথ, তবু আমরা গাড়িতে গেলাম। প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে গিয়ে সোজা আমরা বঙ্গবন্ধুর অফিসে। আমরা ঢুকতেই দেখি একটি উঁচু চেয়ারে বসে বঙ্গবন্ধু, সামনে আরও কয়েকজন মন্ত্রী। কামরুজ্জামানের দেখেই বঙ্গবন্ধু উঠে দাঁড়িয়ে রীতিমতো কুর্নিশ করে বললেন, ‘আসুন, মাননীয় সভাপতি।’

কামারুজ্জামান আমাকে ইঙ্গিত করে বললেন আমার হাতে রাখা তাঁর পদত্যাগপত্র বঙ্গবন্ধুর কাছে দিতে। আমি তা দিতেই বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘পদত্যাগপত্র?’ কামারুজ্জামান হেসে বললেন, তাই। হাতে নিয়ে বঙ্গবন্ধু আমাকে বললেন তৌফিক ইমামকে (তখন কেবিনেট সেক্রেটারি) ডেকে আনতে। আমি যেই বেরিয়ে যাচ্ছি, বঙ্গবন্ধু কামারুজ্জামানকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এ তোর প্রাইভেট সেক্রেটারি না? তাকে তুই কোথায় রেখে যাচ্ছিস?’

আমি আবার অবাক! কোথায় প্রধানমন্ত্রী তাঁর মন্ত্রীর পদত্যাগপত্র নিয়ে কথা বলবেন, আর তিনি কিনা আমি কোথায় যাব, সে নিয়ে চিন্তা করেছেন! কামারুজ্জামান বললেন, ‘সে তোমার অফিস থেকে গিয়েছিল, তাকে তোমার অফিসেই ফেরত দিতে এসেছি।’ কথা আর না বাড়িয়ে বলব যে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি ভবন থেকে ফেরার পথে কামারুজ্জামান আমাকে জানালেন যে আমি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আবার নিযুক্ত হচ্ছি। দুদিন পর আমি আমার নিযুক্তির আদেশ পেলাম বঙ্গবন্ধুর নিজস্ব সই করা কাগজে। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এমনি যে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ও সরকারি নিয়মে সরকারি বিজ্ঞপ্তি হিসেবে জারি করতে হয়। আর সে বিজ্ঞপ্তি প্রাতিষ্ঠানিক মন্ত্রণালয় করে থাকে। আমার এ নির্দেশে বাধ সাধলেন তৎকালীন প্রাতিষ্ঠানিক অতিরিক্ত সচিব, যিনি প্রকৃতপক্ষে ছিলেন সব সরকারি নিয়োগের হর্তাকর্তা। তিনি বঙ্গবন্ধুকে বোঝালেন, আমার জেলা প্রশাসনে ট্রেনিং দরকার। বঙ্গবন্ধু এ ব্যাপারে আর মাথা ঘোলাননি। আমারও দ্বিতীয়বার তাঁর কার্যালয়ে আর কাজ করা হয়নি।

জিয়াউদ্দিন চৌধুরী সাবেক সরকারি কর্মকর্তা (সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তান)