আমরা যারা মহামারির মধ্যেও বেঁচে আছি, তাদের মধ্যে হাতে গোনা কিছু লোক পাওয়া যাবে, যঁারা প্রযুক্তির আশীর্বাদকে অস্বীকার করতে পারবেন। জুম, ই-মেইল, কানেকটেড ওয়ার্কপ্লেস এবং সলিড ইন্টারনেট সংযোগ আমাদের ব্যবসাপাতি, পড়াশোনাসহ সব ধরনের কাজকে চালিয়ে রেখেছে। আজ থেকে ২০ বছর আগে যদি এই মহামারি হানা দিত, তাহলে এভাবে কাজ চালিয়ে যাওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব হতো না।
আবার এ তথ্যপ্রযুক্তিই আমাদের বড় বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ প্রযুক্তির অপব্যবহারে অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। শুধু ভালো দিকটা থাকবে, মন্দটা থাকবে না, এভাবে প্রযুক্তির ব্যবহার সম্ভব নয়—এমন একটি ধারণা অনেকের মধ্যেই আছে। আমি তাদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করি। আমি মনে করি, ক্ষতির দিক বাদ দিয়ে শুধু ভালো দিকগুলো গ্রহণ করা ইচ্ছা করলেই সম্ভব হতে পারে। কিন্তু সেটি করতে হলে প্রযুক্তি ব্যবস্থা যারা নিয়ন্ত্রণ করে, সেই বিগ টেক (অ্যামাজন, অ্যাপল, গুগল, ফেসবুক ও মাইক্রোসফট—তথ্যপ্রযুক্তি খাতের সবচেয়ে বড় এই মার্কিন কোম্পানিগুলোকে ‘বিগ টেক’ বলা হয়)-এর কাঠামোয় বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে হবে।
প্রথমেই মেনে নিতে হবে, বিগ টেক আসলে ভেতরে-ভেতরে খুবই দুর্বল বা নাজুক। হ্যাঁ, আমি ভেবেচিন্তেই বলছি, বিগ টেক-এর ভেতরটা দুর্বল। দ্বিতীয়ত আমাদের মাথায় রাখতে হবে, এই প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো শুধু তখনই শক্তিধর হতে পেরেছে, যখনই আমরা তাদের সুযোগ দিয়েছি। ‘বিগ টেক’ বলতে আমি এখানে ফেসবুক ও গুগল এবং ইনস্টাগ্রাম ও ইউটিউবের (এগুলো ফেসবুক ও গুগলেরই মালিকানাধীন) মতো সংশ্লিষ্ট কোম্পানির কথা বলছি।
এই প্রতিষ্ঠানগুলো খুব দুর্বল অবস্থান থেকে উঠে এসেছে—কথাটা আমি এই অর্থে বলছি যে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো নিশ্চিত ভবিষ্যৎ ছিল না। নেটস্কেপ, মাইস্পেস, এমএসএন এবং অন্য আরও কোম্পানিগুলোর কথা ভাবুন, যারা এখন স্মৃতিচিহ্ন হয়ে গেছে অথচ তাদের সম্পর্কে আমাদের একসময় বলা হতো কোম্পানিগুলো প্রাকৃতিকভাবে একদিন একচেটিয়া হয়ে উঠবে।
ফেসবুকের তথ্য ফাঁসকারী ফ্রান্সেস হাউগেন গত মাসে ফেসবুকের আচরণসংক্রান্ত যেসব তথ্য জনসমক্ষে এনেছেন তাতে মনে হচ্ছে, ফেসবুক তার অবস্থান হারিয়ে ফেলার আতঙ্কে আছে। হাউগেনের বরাতে জানা যাচ্ছে, ফেসবুক মূলধারার নিউজ প্রচার–প্রসারের বদলে ব্যক্তির পোস্ট শেয়ারিংয়ে বেশি আগ্রহী হয়, যা ব্যবহারকারীদের স্বাস্থ্যের ওপর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এবং এটি ২০১৮ সালে ব্যবহারকারীদের ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ করেছিল।
ফেসবুক অনেক আগে থেকেই জানত, ইনস্টাগ্রামে (ইনস্টাগ্রাম ফেসবুকেরই প্রতিষ্ঠান) ছবি শেয়ারিং কিশোর-কিশোরীদের জন্য ভীষণ ক্ষতিকর। তাদের একটি অভ্যন্তরীণ দাপ্তরিক নথিতে ‘আমরা বডি ইমেজ (মানুষের শারীরিক ছবি) ইস্যুকে অনেক খারাপ পর্যায়ে নিয়ে গেছি’ বলে উল্লেখও করা হয়েছে। এ কথা নিজেরা নিজেদের পরিমণ্ডলে স্বীকার করলেও ইনস্টাগ্রাম আগে যেভাবে কাজ করত, তা থেকে এখন খুব একটা পরিবর্তন আনা হয়নি। ইনস্টাগ্রামে ছবি পোস্ট করা এবং তাতে আসক্ত হওয়ায় তরুণ প্রজন্ম ক্ষতির মুখে পড়ছে, এটি স্বীকার করে নেওয়ার পর ইনস্টাগ্রামের পরিচালন পদ্ধতিতে পরিবর্তন না আনার প্রধান কারণ হলো কিশোর–কিশোরীরা ফেসবুকের চেয়ে ৫০ শতাংশের বেশি ইনস্টাগ্রাম ব্যবহার করে থাকে। ইনস্টাগ্রামেই ফেসবুক তার ভবিষ্যৎ দেখছে।
ইনস্টাগ্রামে মানুষের যুক্ত হওয়ার প্রবণতা যখন নিম্নগামী হওয়া শুরু করেছিল, তখন ফেসবুক কিশোর-কিশোরীর চেয়ে কম বয়সী শিশুদের সম্ভাব্য গ্রাহক হিসেবে মাথায় নিয়ে ‘ইনস্টাগ্রাম কিডস’ নামের নতুন একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করার পরিকল্পনা করেছিল। পরে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পরিকল্পনাটি স্থগিত করা হয়। ফেসবুক ২০১২ সালে ইনস্টাগ্রাম কিনে নেওয়ার আগে কোম্পানিটির যে নীতি ও মূল্যবোধ মেনে চলছিল, এখন সেখান থেকে ফেসবুক সেটিকে অনেক দূরে সরিয়ে এনেছে।
বিগ টেক আসলে ভেতরে-ভেতরে খুবই দুর্বল বা নাজুক। প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো শুধু তখনই শক্তিধর হতে পেরেছে, যখনই আমরা তাদের সুযোগ দিয়েছি। ‘বিগ টেক’ বলতে আমি এখানে ফেসবুক ও গুগল এবং ইনস্টাগ্রাম ও ইউটিউবের (এগুলো ফেসবুক ও গুগলেরই মালিকানাধীন) মতো সংশ্লিষ্ট কোম্পানির কথা বলছি।
ফেসবুকের নিজের মেসেজিং প্ল্যাটফর্ম মেসেঞ্জার যখন পড়তির দিকে যেতে থাকল, তখন ২০১৪ সালে তারা হোয়াটসঅ্যাপ কিনে নেয়। ডাবলক্লিক (বিজ্ঞাপন বিক্রির একটি প্ল্যাটফর্ম যা গুগলের আয়ের একটি বড় উৎস) এবং অ্যান্ড্রয়েড, ইউটিউব, ওয়েজ এবং কুইকোফিসের মতো উদীয়মান প্ল্যাটফর্মগুলো কিনে নেওয়ার পর গুগল আরও বড় হয়েছে। মুনাফার জন্য মরিয়া হওয়া কোম্পানির জন্য এগুলো স্বাভাবিক কাজ কিন্তু এসব নীতি অনুসরণ সব সময় শীর্ষে থাকার নিশ্চয়তা দিতে পারে না।
অস্ট্রেলিয়ার প্রোডাকটিভিটি কমিশনের অন্যতম কমিশনার স্টিফেন কিং বলেছেন, গুগল ও ফেসবুক যেভাবে উদীয়মান প্ল্যাটফর্মগুলো অধিগ্রহণ করে নেয়, তা ঠেকাতে কঠোর আইন প্রয়োগ করা দরকার। ইনস্টাগ্রাম এবং হোয়াটসঅ্যাপ যখন অধিগ্রহণ করা হয়, তখন তারা খুব ছোট পরিসরের প্ল্যাটফর্ম ছিল। ফেসবুক ইনস্টাগ্রামকে কিনে নেওয়ার আগে প্রতিষ্ঠানটির পূর্ণকালীন কর্মীর সংখ্যা ছিল মাত্র ১৩ জন। আর হোয়াটসঅ্যাপের ছিল ৫৫ জন। এরপরও এই দুটি প্ল্যাটফর্ম কিনতে ফেসবুক কয়েক শ ডলার ব্যয় করেছে। ১০০ কোটি ডলার দিয়ে ফেসবুক ইনস্টাগ্রাম কিনেছিল। সেই ইনস্টাগ্রাম থেকে এখন ফেসবুকের বার্ষিক আয় হয় দুই হাজার কোটি ডলার।
যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র উভয় দেশেই এই অধিগ্রহণে ফেসবুক ছাড় পেয়েছিল। বিগ টেক কোম্পানিগুলো ছোট প্ল্যাটফর্মগুলো অধিগ্রহণ করে যেভাবে ব্যবসা করতে পারে, অন্যরা তা পারে না। এই অধিগ্রহণের মাধ্যমে তারা আগে থেকে তৈরি থাকা বিশালসংখ্যক ইউজার ও উপাত্ত পেয়ে সেগুলোর সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারে। স্টিফেন কিং বলছেন, ইনস্টাগ্রাম বড়, তার কারণ এই নয় যে এটি নিজ গুণে সবার দৃষ্টি কেড়েছে, বরং এটি বড় তার কারণ এটি ফেসবুকের অধিগ্রহণ করা প্ল্যাটফর্ম।
ইউরোপে কর্তৃপক্ষ ফেসবুককে এই শর্তে হোয়াটসঅ্যাপ অধিগ্রহণের অনুমতি দিয়েছিল যে ফেসবুক ব্যবহারকারীর অ্যাকাউন্ট ও হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহারকারীর অ্যাকাউন্ট স্বয়ংক্রিয়ভাবে ম্যাচ করবে না। কিন্তু ফেসবুকের এই প্রতিশ্রুতি ছিল মিথ্যা। আদতে তারা হোয়াটসঅ্যাপ অধিগ্রহণ করেই হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহারকারীদের সব তথ্য ফেসবুকের সঙ্গে একীভূত করে ফেলেছে। এই মিথ্যা তথ্য দেওয়ায় ইউরোপিয়ান কমিশনকে ফেসবুকের ১১ কোটি ইউরো জরিমানা দিতে হয়েছে।
যদি অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপিয়ান কমিশন সমন্বিতভাবে কঠোর অবস্থানে যেত, তাহলে ফেসবুক ও গুগল অন্য প্ল্যাটফর্মগুলো অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে এতটা বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারত না। একের পর এক উদীয়মান প্ল্যাটফর্মগুলো তারা গিলে ফেলায় ভার্চু্যয়াল জগতে তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। প্রয়োজনে আইন করে এটি অবিলম্বে ঠেকাতে হবে।
নতুন প্রজন্ম প্রযুক্তিকে প্রতিনিয়ত বদলে দিচ্ছে। নতুন নতুন প্রযুক্তি আনছে। ফেসবুক ও গুগল তা জানে। এ কারণে কোনো প্ল্যাটফর্ম একটু বিকশিত হলেই তারা তা গিলে ফেলছে।
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
● পিটার মার্টিন অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ভিজিটিং ফেলো