২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

প্রতিবন্ধী শিশু, যৌন নির্যাতন ও বিচারের সংকট

গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের ওপর ভিত্তি করে ন্যাশনাল গার্ল চাইল্ড অ্যাডভোকেসি ফোরাম বাংলাদেশের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালের প্রথম ৮ মাসে ৭৯ প্রতিবন্ধী মেয়েশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। যৌন নির্যাতনের ঘটনায় ন্যায়বিচার পাওয়া খুব কঠিন। প্রতিবন্ধী শিশুদের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত বাধা আছে, বিশেষ করে যদি তাদের বুদ্ধি, বাক, শ্রবণ ও মনঃসামাজিক প্রতিবন্ধিতা থাকে। নানাভাবে শিশু যৌন নির্যাতন ঘটে—অনুপযুক্ত স্পর্শ থেকে শুরু করে ধর্ষণ তার অন্তর্ভুক্ত। বাড়ি, স্কুল, খেলার মাঠ, কর্মক্ষেত্র, প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি স্থানে শিশুরা নির্যাতিত হয়।

যৌন নির্যাতন শিশু অধিকারের গুরুতর লঙ্ঘন এবং তাদের জীবনে দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। শিশু যৌন নির্যাতনের বেশির ভাগ ঘটনা পরিবার গোপন করে; প্রতিবন্ধী শিশুদের ক্ষেত্রে এ হার আরও বেশি। আইনি ব্যবস্থায় প্রতিবন্ধী শিশুরা কাঠামোগত বৈষম্যের শিকার হয়। এ জন্য নির্যাতনের শিকার শিশুর পরিবার এ নিয়ে কোনো কথা বলতে বা পদক্ষেপ নিতে চায় না। এতে প্রতিবন্ধী শিশুদের যৌন নির্যাতনের ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই লেখার শুরুতে ধর্ষণের যে সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে, প্রকৃত পরিস্থিতি তার চেয়ে ভয়াবহ।

সেভ দ্য চিলড্রেন এবং হ্যান্ডিক্যাপ ইন্টারন্যাশনালের যৌথ প্রতিবেদন ‘আউট ফ্রম দ্য শ্যাডোস: সেক্সুয়াল ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট চিলড্রেন উইথ ডিজঅ্যাবিলিটিস’ থেকে জানা যায় যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অন্য শিশুদের তুলনায় প্রতিবন্ধী শিশুদের শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়ার আশঙ্কা বেশি। সামাজিক কলঙ্ক ও বৈষম্যের কারণে পরিবার তাদের লুকিয়ে রাখতে পারে। অনেক প্রতিবন্ধী শিশু বিদ্যালয়ে গিয়ে লেখাপড়ার সুযোগ পায় না। ফলে তারা যেন অদৃশ্য হয়ে পড়ে। প্রতিবন্ধী কিশোর-কিশোরীরা, বিশেষ করে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধীরা এমন সব কার্যক্রম এবং সমবয়সীদের নেটওয়ার্ক থেকে বঞ্চিত, যা তাদের সচেতনতা বাড়িয়ে যৌন নির্যাতন থেকে সুরক্ষায় ভূমিকা রাখতে পারত। ব্যক্তিগত কাজের জন্য অনেক প্রতিবন্ধী শিশু অন্যের ওপর নির্ভরশীল। এই সব কারণে তারা অতিরিক্ত ঝুঁকিতে থাকে।

সামাজিক বিচ্ছিন্নতার ফলে প্রতিবন্ধী শিশুরা যৌন নির্যাতনের সহজ লক্ষ্যে পরিণত হয়। তাদের মা–বাবারা সাধারণত অতিরিক্ত ঝুঁকি সম্পর্কে জানেন না এবং সুরক্ষায় পদক্ষেপ নিতে পারেন না। অনেক ক্ষেত্রেই অপরাধী পরিবারের সদস্য অথবা শিশুর যত্ন ও দেখাশোনার দায়িত্বে নিয়োজিত কেউ। যার ফলে সমস্যাটির সমাধান করা খুব কঠিন হয়ে যায়। প্রতিবন্ধী শিশুরা ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি থেকে দূরে সরে গিয়ে সাহায্য চাইতে পারে না। অনেকে নির্যাতনের ঘটনা বুঝতেও অপারগ। বাংলাদেশে বাক এবং শ্রবণপ্রতিবন্ধীরা আদালতে সরাসরি সাক্ষ্য দিতে পারেন না। কারণ, এমন কোনো আইনজীবী এবং বিচারক নেই, যাঁরা ইশারা ভাষা জানেন। এ ক্ষেত্রে আদালতে দোভাষীর প্রয়োজন। তবে দেশে এ দক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তি আছেন মাত্র ১০ জন এবং তাঁরা ঢাকায় বাস করেন। মনঃসামাজিক প্রতিবন্ধীদের মামলা নিতে পুলিশ অনিচ্ছুক। কারণ, ভুক্তভোগী অপরাধ প্রমাণ করতে পারবে না। যাদের মাল্টি-সেন্সরি প্রতিবন্ধিতা আছে, তারা কোনো ধরনের সাক্ষ্যই দিতে পারে না।

প্রতিবন্ধী শিশুদের অতিরিক্ত ঝুঁকির কারণে যৌন নির্যাতন থেকে তাদের রক্ষায় আমাদের দায়িত্ব বেশি। তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সরকার, বেসরকারি সংস্থা, সেবা প্রদানকারী, গণমাধ্যম, মা-বাবাসহ সমাজের সবাইকে সঠিকভাবে নিজস্ব ভূমিকা পালন করতে হবে।

যৌন নির্যাতনকারীদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে হবে। সামাজিক এবং কাঠামোগত বৈষম্য, যা শিশুদের সেবা পেতে বাধা দেয়, তা দূর করা উচিত। প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষার ও অন্যান্য সুযোগ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এতে তাদের বিচ্ছিন্নতা ও নির্যাতনের ঝুঁকি হ্রাস পাবে। প্রতিবন্ধিতা নিয়ে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। এমন একটি পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যেখানে প্রতিবন্ধীরা অন্তর্ভুক্ত বোধ করে। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যম ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। চিকিৎসা, আইন, সমাজসেবাসহ যেকোনো সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা হতে পারে, এমন সব বৈষম্যের অবসান ঘটানো গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ, যেসব আইনি বিধানের কারণে নির্দিষ্ট ধরনের প্রতিবন্ধীরা সাক্ষ্য দিতে পারেন না, তার পরিবর্তন প্রয়োজন। যদি অপরাধ প্রমাণের দায় ভুক্তভোগীর না হয়ে অপরাধীর হয়, তবে ন্যায়বিচার পাওয়া সম্ভব হতে পারে।

যৌন নির্যাতনের শিকার প্রতিবন্ধী শিশুরা যাতে প্রয়োজনীয় সেবা পায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। এর মধ্যে আছে চিকিৎসা, নিরাপত্তা, তথ্য বুঝতে এবং ইশারা ভাষা ব্যবহারে সহায়তা, বিনা মূল্যে একজন আইনজীবীর ব্যবস্থা, আদালতে এমনভাবে নিজেকে প্রকাশ করতে পারা, যা তাদের জন্য নিরাপদ। এই সব সেবার জন্য পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করা দরকার।

পুলিশ, বিচারক, সমাজকর্মী, চিকিৎসক, নার্সসহ সংশ্লিষ্ট সবার দক্ষতা এবং সংবেদনশীলতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন, যাতে তাঁরা যথাযথভাবে প্রতিবন্ধী শিশুদের সেবা দিতে পারেন। ইশারা ভাষায় দক্ষ ব্যক্তির সংখ্যা বাড়াতে হবে। এর ফলে দেশের বিভিন্ন স্থানে বাক ও শ্রবণপ্রতিবন্ধী শিশুরা সাক্ষ্য দেওয়ার সময় প্রয়োজনীয় সহায়তা পাবে। বিভিন্ন অবকাঠামো এবং সেবার পরিকল্পনা এমন হতে হবে, যাতে সেসব প্রতিবন্ধী শিশু সহজে ব্যবহার করতে পারে এবং তাদের জন্য উপযুক্ত হয়। এ জন্য শিশুদের মতামত জেনে তা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা দরকার।

প্রতিবন্ধী শিশুদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করতে হবে, যা তাদের নির্যাতন প্রতিরোধে এবং প্রয়োজনে ব্যবস্থা নিতে সহায়তা করবে। যৌন নির্যাতন এবং প্রতিবন্ধীদের অধিকারসম্পর্কিত আইনগুলো ব্রেইল, ইশারা ভাষা ইত্যাদির মাধ্যমে তাদের জানাতে হবে। মা-বাবা ও অভিভাবকদের সচেতনতা বৃদ্ধি করা উচিত, যাতে তাঁরা শিশুদের যৌন নির্যাতন থেকে রক্ষা করতে পারেন এবং নির্যাতনের লক্ষণ প্রাথমিক অবস্থাতেই শনাক্ত করে দ্রুত সহায়তার ব্যবস্থা করতে সক্ষম হন।

‘যখন আমার ১৩ বছর বয়সী প্রতিবন্ধী মেয়ের ধর্ষণকারী আশপাশেই ঘুরে বেড়ায় এবং বলে, “একজন প্রতিবন্ধীকে ধর্ষণ করায় সমস্যা কী? সে তো এমনিতেই পরিত্যক্ত,” তখন আমি ভীষণ ক্ষুব্ধ হই’—একজন বুদ্ধি ও শারীরিক প্রতিবন্ধী কিশোরীর বাবার মন্তব্য এ-সংক্রান্ত বাস্তবতা তুলে ধরে। প্রতিবন্ধী শিশুদের অতিরিক্ত ঝুঁকির কারণে যৌন নির্যাতন থেকে তাদের রক্ষায় আমাদের দায়িত্ব বেশি। তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সরকার, বেসরকারি সংস্থা, সেবা প্রদানকারী, গণমাধ্যম, মা-বাবাসহ সমাজের সবাইকে সঠিকভাবে নিজস্ব ভূমিকা পালন করতে হবে। প্রতিবন্ধী শিশুদের অগ্রাধিকার দিয়ে তাদের স্বার্থ রক্ষায় আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করা উচিত। আমরা কি তা করছি?

লায়লা খন্দকার উন্নয়নকর্মী