পরের জায়গা পরের জমিন
ঘর বানাইয়া আমি রই
আমি তো সেই ঘরের মালিক নই॥...
আমি খাজনাপাতি সবই দিলাম
তবু জমিন আমার হয় যে নিলাম
আমি চলি যে তার মন জোগাইয়া
দাখিলায় মেলে না সই॥
আবদুল আলীমের গান। মারফতি লাইনের গান। কেউবা বলবেন দেহতত্ত্বের গান। এই জমি আমাদের ইহকালের জীবনও হতে পারে, আবার আমাদের দেহখাঁচাও হতে পারে। লালন যেমনটা বলেন: খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কমনে আসে যায়! আর আবদুর রহমান বয়াতির গান: আমার দেহঘড়ি সন্ধান করি কোন মিস্তরি বানাইয়াছে!
আমাদের এই দেশ আউল-বাউল, সাধক-ফকিরের দেশ। এই কথা যেমন সত্য, তেমনি সত্য এই দেশের মতো ইহজাগতিক স্বার্থপরতা আর কোথাও নেই। প্রায় সবাই নিজের গাট্টি বাঁধতে ব্যস্ত। চারদিকে শোঁ শোঁ শব্দ হচ্ছে। শুষছে! যে যেভাবে পারে শুষে নিচ্ছে, চুষে নিচ্ছে। নেকড়ে চুষছে মেষের রক্ত, নেকড়ের গায়ে বসে পোকা চুষছে তার রক্ত, আর নেকড়ের গায়ে বসে পাখি খুঁটে খাচ্ছে আস্ত পোকাটাকেই। লুৎফর রহমান রিটনের ছড়াটার মতো:
আবদুল হাই করে খাই খাই,
এক্ষুনি খেয়ে বলে কিছু খাই নাই।
...
আম খায়
জাম খায়
টিভি প্রোগ্রাম খায়।
...
খায় সে সব খায়,
আ স ম রব খায়... (এটা এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময়ের সংযোজন)।
আমরা সবাই আবদুল হাই, শুধু খাই খাই করি, এবং এক্ষুনি খাওয়া সেরেই বলি, কিচ্ছু খাই নাই। এই দেশে আছে বনখেকো, নদীখেকো, ভূমিখেকো, ব্যাংকখেকো, ভোটখেকো...কী খেকো নাই! বলবেন, সর্বনাশ! মুনতাসীর ফ্যান্টাসি নাটকের সংলাপ, আমি সর্বনাশপাতি খাব!
মানে এই দেশের নাগরিকেরা একই সঙ্গে উদাস বাউল, দুনিয়া এদের কাছে দুই দিনের, আবার একই সঙ্গে এরা সর্বভুক, দুনিয়াটাকেই পারলে সাদ্দাদের বেহেশত বানানোর চেষ্টা এই দেশেই চলে!
এই দুই বিপরীতের সংঘর্ষে এই দেশটা হয়ে উঠেছে একটা হীরক রাজার দেশ!
আচ্ছা, কোন প্রসঙ্গে এত কথা বলছি, সেটা তো বলে নেওয়া দরকার। বাংলাদেশের সংবিধানের প্রথম ভাগ ৭-এ বর্ণিত আছে: প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ। জনগণের পক্ষে এই ক্ষমতার প্রয়োগ শুধু এই সংবিধানের কর্তৃত্বে ও অধীনে প্রয়োগ করা যাইবে।
ভূমিহীনেরা আন্দোলন করল, ভূমিহীনেরা সংগ্রাম করল, ভূমিহীনেরা ’৬৬-এর আন্দোলন করল, হাড্ডিখিজিরেরা ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান করল, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ তাদের বস্তিগুলোতেই কামান–গানপাউডার বর্ষণ করে আগুন দেওয়া হলো সবার আগে, ওরা দলে দলে গিয়ে যুদ্ধ করল, দেশ বানাল, ওদের রক্তে লেখা হলো সংবিধান, শুধু দাখিলায় তাদের সইটা মিলল না! আর কত দিন? এবার রাষ্ট্রের মালিকদের কাছে রাষ্ট্রের মালিকানা বুঝিয়ে দিন!
সংবিধানের তৃতীয় ভাগ: মৌলিক অধিকার।
২৯(১) প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সমান সুযোগ থাকিবে।
এখন দেখা যাচ্ছে, পুলিশে নিয়োগের ক্ষেত্রে, হয়তো আরও আরও সরকারি পদে নিয়োগের বেলায় ভূমিহীনের জায়গা নেই। স্থায়ী ঠিকানা থাকতে হবে। একই নিয়ম কি ভোটার তালিকায় নাম ওঠানোর বেলাতে এখনো প্রযোজ্য আছে? রাস্তার ধারের ছিন্নমূল মানুষদের আগে ভোটার তালিকায় জায়গা দেওয়া হতো না, এখন কি দেওয়া হয়! আমার ধারণা দেওয়া হয় না।
কেন দেওয়া হয় না? কারণ, তুমি জমির মালিক নও। কারণ, তুমি কোন নির্বাচনী এলাকার, সেটাই যদি স্থির না থাকে, তাহলে কে হবে তোমার সাংসদ, কে হবে তোমার কমিশনার!
কিন্তু আমি তো আরও বড় মালিকানা ধারণ করি।
কী সেটা?
আমি এই প্রজাতন্ত্রের মালিক!
রাখো মিয়া মারফতি কথা!
এইখানেই আসে সেই আবদুল আলীমের গান: পরের জায়গা পরের জমিন ঘর বানায়া আমি রই, আমি তো এই প্রজাতন্ত্রের মালিক নই।
এই পরিস্থিতির যদি উদ্ভব হয়, তাহলে আমাদের কী করতে হবে। সংবিধানে তাও বলা আছে। মৌলিক অধিকার: ১) এই অধ্যায়ের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ এমন সব আইনের যতটুকুন অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততটুকুন বাতিল হয়ে যাবে। ২) রাষ্ট্র এই বিধানের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ কোনো আইন তৈরি করতে পারবে না। তৈরি করলে যতটুকু অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততটুকু বাতিল হয়ে যাবে।
২১ ডিসেম্বর ২০২১ প্রথম আলো অনলাইনে নাহিদ হাসান লিখেছেন, ‘ভূমিহীনের চাকরি না পাওয়ার ব্রিটিশ আইন আর কত দিন?’ তার সঙ্গে যোগ করতে চাই, ভূমিহীনদের ভোটাধিকার বঞ্চিত রাখার ঐতিহ্য আর কত দিন? ছিন্নমূল মানুষেরা, যারা হয়তো নদীভাঙনের শিকার হয়ে ঢাকা শহরে এসে ফুটপাতে ঘুমায়, তাদের নাম ভোটার তালিকায় উঠবে না কেন?
আর কত দিন আমাদের এই গান গেয়ে যেতে হবে: আমি চলি যে তার মন জোগাইয়া তবুও দাখিলায় মেলে না সই।
ভূমিহীনেরা আন্দোলন করল, ভূমিহীনেরা সংগ্রাম করল, ভূমিহীনেরা ’৬৬-এর আন্দোলন করল, হাড্ডিখিজিরেরা ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান করল, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ তাদের বস্তিগুলোতেই কামান–গানপাউডার বর্ষণ করে আগুন দেওয়া হলো সবার আগে, ওরা দলে দলে গিয়ে যুদ্ধ করল, দেশ বানাল, ওদের রক্তে লেখা হলো সংবিধান, শুধু দাখিলায় তাদের সইটা মিলল না! আর কত দিন? এবার রাষ্ট্রের মালিকদের কাছে রাষ্ট্রের মালিকানা বুঝিয়ে দিন!
না। দেব না। কী হবে?
রবীন্দ্রনাথ উদ্ধৃত করে বলি: হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান, অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান!
জানি, এর জবাবে ওরা বলবে, ব্যাটা সাধুবেশে পাকা চোর।
আমরাও বলব:
আমি শুনে হাসি আঁখিজলে ভাসি, এই ছিল মোর ঘটে—
তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে!
যুদ্ধ করে সর্বস্ব খুইয়ে দেশ স্বাধীন করে এ-ই পেলাম! এ-ই কি প্রাপ্য ছিল এই দেশের গরিব–দুঃখী ভূমিহীন মানুষদের?
নির্মলেন্দু গুণের দিনমজুরের কাব্যে আছে:
‘খোদার জমিন ধনীর দখলে
গেছে আইনের জোরে,
আমাগো জমিন অইব যেদিন
আইনের চাকা ঘোরে।’
এবার একটু আইনের চাকাটা ঘোরান। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ পেরিয়ে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এইটা কি খুব বেশি চাওয়া!
● আনিসুল হক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক