বর্তমানে পদ্মা নদী পার হতে ফেরিতে যানবাহনভেদে ভাড়া দিতে হয় ৭০ থেকে ৩ হাজার ৯৪০ টাকা। প্রস্তাব অনুসারে, পদ্মা সেতুতে যানবাহনভেদে টোল দিতে হবে ১০০ থেকে সাড়ে ৫ হাজার টাকা। টোল বৃদ্ধির হার ৪২ শতাংশ থেকে সাড়ে ৫১ শতাংশ। ফেরির তুলনায় অতি উচ্চ হারে টোল নির্ধারণ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
পদ্মা সেতুর উচ্চ টোল দক্ষিণাঞ্চলের শিল্প বিকাশের অন্তরায়
পদ্মা সেতুতে ফেরির তুলনায় পৌনে দুই গুণ টোল প্রস্তাব করা হয়েছে, এতে কিছু সমস্যা তৈরি হতে পারে। উচ্চ টোলের কারণে পদ্মা সেতু থেকে মানুষ যেসব আর্থিক সুবিধা এবং সাশ্রয়ের উপযোগ পাওয়ার কথা ছিল, সেটা পুরোপুরি না-ও আসতে পারে। বরং উচ্চ হারের টোলের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত সুবিধা জনগণকে না দিয়ে বরং সরকার মহাশয়ই তা রাজস্ব আদায়ের নামে খেয়ে ফেলার আয়োজন করেছে।
অর্থাৎ পদ্মা বহুমুখী সেতু (সড়ক ও রেল মিলে) জিডিপিতে ১ দশমিক ২৩ ভাগ বাড়তি প্রবৃদ্ধি যোগ করবে বলে যে প্রাক্কলন করা হয়েছে, সেটা হবে না হয়তো। সেতুকে সংযোগকারী জেলা থেকে দেশের অন্য প্রান্তে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন খরচ বাড়লে দক্ষিণের জেলাগুলোর উৎপাদিত কৃষিশিল্প পণ্য কিংবা সেবা দেশের অন্য অঞ্চলের সঙ্গে মূল্য সক্ষমতায় পাল্লা দিতে পারবে না। সেতু উদ্বোধনের পরও মানুষ যদি নৌকা বা ট্রলারে পণ্য নিয়ে পদ্মা পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করে অবাক হব না।
যেহেতু ছোট, মাঝারি, বড় ট্রাক ও লরিতে টোলের হার অসহনীয়, তাই নিশ্চিত যে এই উচ্চ পরিবহনভাড়ায় দক্ষিণাঞ্চলের শিল্প বিকাশ বিঘ্নিত হবে। এমনিতেই দক্ষিণাঞ্চল ঝড় ও দুর্যোগপ্রবণ বলে সেখানে শিল্পবিস্তারের হার কম। এদিকে সরকার জুলাই ২০২২ থেকে ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়েতেও টোল নেবে। ভূমি অধিগ্রহণে ব্যাপক দুর্নীতিসহ নানা কারণে এ সড়ক নির্মাণে প্রতি কিলোমিটারে প্রতি বিশ্ব রেকর্ড পরিমাণ খরচ হয়ে গেছে (কিলোমিটারপ্রতি ২০০ কোটি টাকা)।
ফলে সেখানেও উচ্চ টোল হার পড়বে বলে ধারণা করি। ঢাকা থেকে দক্ষিণের উপকূলীয় জেলা পর্যন্ত সড়কে রয়েছে আরও অন্তত দুটি টোল সেতু ও ফেরি। এতগুলো সেতু ও সড়কে উচ্চ হারে টোল দিলে, সেটা দক্ষিণাঞ্চলের কৃষিশিল্প পণ্য ও সেবার মূল্য বেশি হবে, এতে এই অঞ্চলের শিল্প বিকাশ বিঘ্নিত হবে নিশ্চিত। দিন শেষে দক্ষিণের মানুষের পকেট কাটার উপকরণ হয়ে উঠবে সড়ক ও সেতুর টোল।
উচ্চ টোলের আরেকটি সমস্যা আছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে, জ্যামে পড়লে, ফেরিতে কারিগরি সমস্যা, কুয়াশা কিংবা ঝড়ে পাটুরিয়া-গোয়ালন্দ রুটে ফেরি চলাচলে সমস্যা হলে সেখানকার যানবাহনের কিছু অংশ বিকল্প পথ হিসেবে বেশি দূরত্ব পাড়ি দিয়েও পদ্মা সেতু ব্যবহার করার চেষ্টা করবে। এতেও অর্থনৈতিক উপযোগ আসবে। কিন্তু টোল বেশি হলে এটা সম্ভব হবে না, একদিকে বেশি দূরত্বের কারণে জ্বালানি খরচ বেশি হবে, অন্যদিকে কয়েক হাজার টাকা টোল বেশি দিতে হবে। পদ্মা সেতুর প্রস্তাবিত টোলে দূরত্ব, জ্বালানি খরচ এবং অর্থনৈতিক উপযোগ তৈরির ত্রিপক্ষীয় সমন্বয় নেই।
গতানুগতিক বেশি রাজস্ব আয়ের ধান্দায় তৈরি হয়েছে পদ্মা সেতুর এই টোল হার। অর্থনৈতিক বিকাশে গতি আনার জন্য বুদ্ধিদীপ্ত কোনো চিন্তাতাড়িত নয়, বরং এ যেন জাতীয় বাজেটের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ঘাটতির পরিপ্রেক্ষিতে ঋণগ্রস্ত সরকারের বাড়তি অর্থ আয়ের যেনতেন কৌশল। মোটরযান চলাচলের জন্য সারা দেশে উপযোগী রাস্তা করতে সরকার অতি উচ্চহারে বাৎসরিক রুট-ফি নেয়, বিগত দশকে যা বাড়াতে বাড়াতে প্রায় তিন গুণ হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, নিজস্ব অর্থায়নে তৈরি সেতুতেও এত উচ্চ হারে টোল দিতে হবে কেন?
বিদেশি ঋণের কথা বলে টোল আদায় শুরু হলেও বাংলাদেশের বড় ও মাঝারি সেতুতে টোল ওঠানো থামে না কখনোই। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হলেও ব্যয়ের টাকা ১ শতাংশ সুদে ঋণ হিসেবে সেতু কর্তৃপক্ষকে দিচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়। বাণিজ্যিক ব্যাংকের শিল্পঋণের সুদের এক-দশমাংশের মতো অতি নিম্ন সুদের বিপরীতে সাড়ে ৫১ শতাংশের মতো এত উচ্চ টোল বৃদ্ধির যৌক্তিকতা ঠিক কী?
অন্যদিকে টোলের অর্থ হারেও বৈষম্য দেখা যায়। সাধারণ গাড়ি, জিপ, মাইক্রোবাস সবার একই হার বিস্ময়কর। ১০ লাখ টাকার গাড়ি এবং কোটি টাকার গাড়ির টোল হার একই। নিম্নবিত্তের মুড়ির টিন মার্কা যাত্রী পরিবহনকারী বাসের টোল বিলাসবহুল বাসের টোলও প্রায় একই। এভাবে ধনী তোষণই দেশের উন্নয়ন-দর্শন হয়ে গেছে।
যানবাহনের প্রকারভেদ নয় বরং আধুনিক যুগে টোলের হার নির্ভর করে মোটরযানের লোড বা ভরের বিপরীতে। স্থির টোল হারের বদলে ডায়নামিক অর্থাৎ স্মার্ট টোল ব্যবস্থা করা দরকার ছিল পদ্মা সেতুতে। একটা স্থির ও গতানুগতিক টোল সংগ্রহের জন্যও বিদেশি ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া বিস্ময়কর। সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধির চেষ্টার পাশাপাশি বিদেশি কোম্পানির খরচও বর্ধিত টোল হারের জন্য দায়ী হতে পারে।
দক্ষিণাঞ্চলের কৃষি, মৎস্য, ক্ষুদ্র শিল্পসহ প্রান্তিক অর্থনীতি এবং সার্বিক শিল্প উৎপাদনকে মূল্য প্রতিযোগিতা এবং সক্ষমতায় এগিয়ে রাখার বিবেচনায় অর্থনীতিবান্ধব টোলব্যবস্থা সাজানো দরকার, যেখানে উচ্চবিত্ত বেশি টোল পরিশোধ করবে এবং নিম্নবিত্ত করবে নামমাত্র অথবা ভারী গাড়ি বেশি টোল দেবে, খালি কিংবা হালকা গাড়ি দেবে কম। পাশাপাশি কৃষিসেবা ও শিল্পের খাতভিত্তিক সাশ্রয়ী টোল হারের বিবেচনা দরকার। গতানুগতিক নয় বরং সাশ্রয়ী এবং বুদ্ধিদীপ্ত টোল হারই পদ্মা সেতুর কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক উপযোগিতা তৈরি করতে পারবে।
মেট্রোরেলের ভাড়া কি নগরবাসীর আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ?
উত্তরা-মতিঝিল মেট্রোরেলকে দুই ভাগে ভাগ করে মেট্রোরেলের ভাড়া প্রস্তাব করা হয়েছে সর্বনিম্ন ২০ টাকা, এতে উত্তরা থেকে মতিঝিলে ভাড়া পড়ে ১৭০ টাকা। মোটামুটি ১ কিলোমিটার দূরত্বে থাকা প্রতিটি স্টেশনে যেতে ১০ টাকা করে দিতে হবে। বিপরীতে কলকাতা মেট্রোতে সর্বনিম্ন ভাড়া ৫ রুপি। ২ কিলোমিটারে আনুমানিক ভাড়া ৫ রুপি। ১০ রুপি দিয়ে ২ থেকে ৫ কিলোমিটার, ১৫ রুপি দিয়ে ৫ থেকে ১০ কিলোমিটার, ২০ রুপি দিয়ে ১০ থেকে ২০ কিলোমিটার পর্যন্ত এবং ২০ কিলোমিটারের বেশি দূরত্বের জন্য সর্বোচ্চ ২৫ রুপি লাগে।
এশিয়া-ইউরোপের অনেক দেশে কিলোমিটারপ্রতি বা স্টেশনপ্রতি ভাড়া না নিয়ে বরং সর্বনিম্ন একটা ভাড়া রেখে এক বা দুই ঘণ্টার আনলিমিটেড ভ্রমণে সর্বোচ্চ ভাড়ার সিলিং দেওয়া থাকে, এতে গণপরিবহনের ভাড়া খুব সাশ্রয়ী হয়ে আসে বলে লোকে ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারে অনুৎসাহী হয়। গণপরিবহনের ভাড়া ব্যক্তিগত গাড়ির জ্বালানি খরচের অনুপাতে বেশ কম হলেই, বেশি যাত্রী নিশ্চিত করা যায়।
একজন শ্রমিক কিংবা অফিস এক্সিকিউটিভের উত্তরা-মতিঝিল পথে দিনে দুবার যাতায়াতে যদি ৩৪০ টাকা খরচ হয়, তাহলে মাসের ২২ কর্মদিবসে খরচ পড়ে প্রায় সাড়ে সাত হাজার টাকা। এখন যে কর্মী মাত্র ১৩ হাজার টাকা আয় করেন ওভারটাইমসহ, তিনি কীভাবে মেট্রোরেল ব্যবহার করবেন? কিংবা যে এক্সিকিউটিভের বেতনই ১৫ বা ১৮ হাজার টাকা, তাঁর পক্ষে বেতনের ৪০ শতাংশ যাতায়াতে ব্যয় করা তো অসম্ভব। মেট্রোরেলের ভাড়া ঢাকার সাধারণ বেসরকারি চাকরিজীবী, শ্রমজীবী মানুষ, রপ্তানিমুখী ও তৈরি পোশাকশিল্প শ্রমিক, ভাসমান শ্রমিক, নিম্ন এবং নিম্নমধ্যবিত্তের অর্থাৎ সাধারণ মানুষের দৈনিক উপার্জনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ না হলে মেট্রোরেলের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। মেট্রোরেল শুধু উচ্চমধ্যবিত্ত এবং অভিজাতের পরিবহন হিসেবে গড়ে উঠলে ঢাকার যানজট কিন্তু উল্লেখযোগ্য হারে কমবে না।
বহু স্তরের দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, দীর্ঘসূত্রতা, প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকার প্রশাসনের চরম অদক্ষতা, বহু স্তরের ব্যয় বৃদ্ধি এবং কারিগরি অক্ষমতায় বিদেশনির্ভরতার কারণে বাংলাদেশে রাস্তা, সেতু, মেট্রোরেল কিংবা পাতালরেল করতে বিশ্বের মধ্যেই সবচেয়ে বেশি রেকর্ড খরচ হচ্ছে। এতে টোলের হার বাড়ছে, ভাড়া অসহনীয় হচ্ছে। মোটকথা, উচ্চ সরকারি ব্যয় কিন্তু প্রতিশ্রুত অর্থনৈতিক সুবিধা তৈরি করছে না। ‘উন্নয়ন’ থেকে যে ‘সেবা’ জনগণের সামনে আসছে তা সাশ্রয়ী হচ্ছে না বলে সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকার উন্নতি ও কর্মসংস্থানে অপ্রতিরোধ্য ‘উন্নয়ন’-এর প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছি না আমরা।
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব, টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক। গ্রন্থকার: চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও বাংলাদেশ, বাংলাদেশ অর্থনীতির ৫০ বছর, অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নের অভাবিত কথামালা, উন্নয়ন প্রশ্নে বাংলাদেশের কিছু সংকট ও সম্ভাবনা। [email protected]