মার খাওয়ায় নতুন রেকর্ড গড়লেন নুরুল হক। সব মিলিয়ে তিনি কুড়িবার হামলার শিকার হওয়ার ‘গৌরব’ অর্জন করেছেন গতকালই। আগের বেশ কয়েক দফার হামলায় গুরুতর আহত হলেও গতকাল অবশ্য তিনি নিজে জখম হননি। তবে তাঁর সদ্যোজাত রাজনৈতিক দল গণ–অধিকার পরিষদের আহ্বায়ক রেজা কিবরিয়ার মাথায় ইটের আঘাত লেগেছে। এতে তিনি ‘ভালোই’ জখম হয়েছেন। এ ছাড়া আহত হয়েছেন নুরুল হকের অনেক সহযোগী।
খবর থেকে জানা যাচ্ছে, টাঙ্গাইলের সন্তোষে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর কবরে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়েছিলেন রেজা কিবরিয়া ও নুরুল হকসহ গণ–অধিকার পরিষদের নেতারা। প্রতিবারই ‘কে বা কারা’ টাইপের কিছু লোক যেভাবে উড়ে এসে নুরুল হককে জুড়ে বসে মারধর করে থাকেন, গতকালও সেই কায়দায় ‘তাঁরা’ এসেছিলেন। মারধর পর্ব শেষ হওয়ার পর নুরুল হকের লোকজন বরাবরের মতো এ হামলার জন্য ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দায়ী করেন।
ছাত্রলীগের নেতারাও বরাবরের মতো বলেন, এগুলো ছারাছার মিথ্যা কথা। নুরুল হকের লোকজনই ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা করেছেন। কোনো উপায় না পেয়ে বাধ্য হয়ে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের সেই হামলা প্রতিহত করতে হয়েছে। নুরুল হক ও তাঁর লোকজন কেন এই কাজ করেছেন, সে বিষয়ে ছাত্রলীগের এক নেতার ব্যাখ্যা হলো, আলোচনায় আসার জন্য নুরুল হক পরিকল্পিতভাবে এই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও বিভিন্ন মূলধারার সংবাদমাধ্যমের পোর্টালে যে ভিডিও চিত্র দেখা গেছে, তার সঙ্গে অবশ্য ছাত্রলীগের বক্তব্যের বিশেষ মিল পাওয়া যায়নি। সেখানে পরিষ্কার দেখা গেছে, জনা ত্রিশেক ‘কে বা কারা’ লাঠি আর ইট নিয়ে নুরুল বাহিনীকে দাবড়ানি দিয়েছেন। পুলিশ নুরুল আর তাঁর লোকজনকে গাড়িতে উঠিয়ে পাহারা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। সেই অবস্থায়ও মারধর চলছিল।
লক্ষ্য করার মতো ঘটনা হলো, নুরুলকে যখন পুলিশ পাহারায় ঘটনাস্থল থেকে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছিল, তখন তিনি চলন্ত গাড়িতে ফেসবুকে লাইভে এসে একটি নাতিদীর্ঘ বক্তব্য দেন। সেই বক্তব্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ‘যারা মারে তারা ভুলে যায়, যারা মার খায় তারা চিরকাল মনে রাখে’—এই দার্শনিক ভাব সংবলিত সেই ভাষণে তিনি হামলার জন্য শুধু সরকারকে দায়ী করেননি। তিনি বলেছেন, ভারতের এজেন্টরাও সেখানে ছিল বলে তিনি মনে করছেন। তাঁর বক্তব্যের একটি বড় অংশ জুড়েই ছিল বাংলাদেশে ভারতের প্রভাব বিস্তারের সমালোচনা। তিনি একাধিকবার ক্ষমতাসীন সরকারকে ‘ভারতের পুতুল সরকার’ বলে উল্লেখ করছিলেন।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমনের বিরোধিতা করার সময় যখন নুরুল হক ও তাঁর সাথিদের ওপর হামলা হয়েছিল, তখন তিনি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ভারতের ক্ষমতাসীন সরকারের তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। কিন্তু তিনি গতকাল যখন সন্তোষে যান তখন মোদি বা ভারত সরকারের কোনো ইস্যুই ছিল না। তারপরও নুরুল হকের লাইভ বক্তৃতার তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল ভারত।
নূরুল হক যখন লাইভে কথাগুলো বলছিলেন, তাঁর পাশেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ছিলেন। তাতে তাঁরা কোনো বাধা দেননি। সন্তোষে একটা ছোট্ট জনসভায় দাঁড়িয়ে নুরুল হক এই কথাগুলো বললে তাতে বড়জোর কয়েক শ লোক শুনতে পেতেন। কিন্তু দেখা গেল তিনি আক্রান্ত হওয়ার পর ফেসবুকে যে ঝাঁঝালো বক্তব্য দিলেন, তা ঘণ্টাখানেকের মধ্যে লাখ লাখ মানুষের কানে পৌঁছে গেল এবং এ ক্ষেত্রে তিনি কোনো বাধার মুখে পড়লেন না। এ দৃশ্য দেখে মনে হতে পারে, নুরুল হককে এসব বক্তব্য দেওয়ার ক্ষেত্রে বাধা দেওয়ার কোনো ইচ্ছাই হয়তো কর্তৃপক্ষের ছিল না। কেন ছিল না—এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে নানাজনের মনে নানা প্রশ্ন আসতে পারে।
গতকাল আক্রান্ত হওয়ার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় নুরুল হকের প্রধানত ক্ষমতাসীন সরকার ও স্থানীয় ছাত্রলীগের সমালোচনা করার কথা ছিল। সেটাই স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তিনি অনেকটা অপ্রাসঙ্গিকভাবে ভারত প্রসঙ্গ টানলেন এবং পুরো হামলার জন্য মূলত ভারতকে দায়ী করলেন। তিনি বারবার বর্তমান সরকারকে ‘ভারতের তাঁবেদার সরকার’ বললেও তিন ফুট দূরে থাকা পুলিশ তাঁকে বাধা দেয়নি।
সরকার কি তবে নিজেই চায় ভারতের সঙ্গে সরকারের অতিঘনিষ্ঠতার একটা জোরালো সমালোচনা আসুক? অথবা এ অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে চীন-ভারতের প্রতিযোগিতার প্রভাব সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকার যেন আরেকটু বাছবিচারি হয়, সেজন্য জনগণের দিক থেকেই সরকারের ওপর চাপ আসুক।
নুরুল হকের বিংশতিতম হামলার শিকার হওয়া এবং তার জের ধরে পুলিশি পাহারায় ‘ভারতের তাঁবেদার’ সরকারের বিরুদ্ধে রাখা এই কড়া বক্তব্যের কোনো যোগসূত্র আছে কি না, সেটা এক গুরুতর প্রশ্ন।
সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
[email protected]