নতুন প্রজন্মের তাজউদ্দীন অনুসন্ধান

একাত্তরে মুক্তাঞ্চল পাটগ্রামে তাজউদ্দীন আহমদ
ছবি: সংগৃহীত

এ প্রজন্ম যদি খুব নিবিড়ে কান পেতে শোনে, তবে এখনো আলোকিত বীরদের পবিত্র মিলনায়তনে তাজউদ্দীন আহমদের সবল পদধ্বনি আলাদা করে শুনতে পাবে। আমাদের দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী, যুদ্ধকালীন এবং প্রথম বাংলাদেশ সরকারের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তাজউদ্দীন, সেই সরকারের মন্ত্রিসভার অন্যান্য সদস্য সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে অন্যায়ভাবে বন্দী ও নির্দয়ভাবে হত্যা করা হয়। ৪৬ বছর আগে এ নির্মম ঘটনার সাক্ষী হয় দেশ। বর্তমানে আমরা এক মহামারির পটভূমিতে এবং ক্রমবর্ধমান অধঃপতনের কাদামাটির মধ্য দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি, যা দুর্নীতি, অনিয়ম, লুটপাট, ধর্ষণ ও জনসাধারণের আস্থার অপব্যবহারের মতো নানা অযৌক্তিক ঘটনা দ্বারা পরিবেষ্টিত। সমাজের সমষ্টিগত বিবেকের দৃশ্যমান সংকট যেকোনো মহামারির মতোই ধ্বংসাত্মক বা বিপজ্জনক হতে পারে, যা একটি জাতির জন্য দুঃখজনক। বাংলাদেশের এ সংকট উত্তরণের জন্য এই প্রজন্ম তাজউদ্দীনের জীবন থেকে কী কী আদর্শ গ্রহণ করতে পারে?

আমার মনে পড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বেড়ে ওঠার দিনগুলোর কথা। আমাদের বাড়ি ছিল বহু মানুষের আশ্রয়কেন্দ্র। আমার মা—তাজউদ্দীনের বড় মেয়ে শারমিন আহমদ—একবার ছয় সদস্যের একটি পরিবারকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, যাদের দুই মাস থাকার কথা থাকলেও সেটি গড়িয়ে কয়েক বছরে পরিণত হয়েছিল, যতক্ষণ পর্যন্ত না সেই অতিথিরা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারেন। আমার মা বলতেন তাঁর শৈশবকালের কথা। তাঁদের বাড়িতে প্রায়ই উঠতেন গ্রাম থেকে আসা বহু মানুষ, যাঁদের চিকিৎসা ও অন্যান্য সাহায্যের প্রয়োজন ছিল; তাঁদের জন্য তাঁর বাবা অর্থাৎ তাজউদ্দীন বাড়িটিকে একটি পথ–স্টেশন হিসেবে ব্যবহার করতেন। তাঁর স্ত্রী প্রয়াত জোহরা তাজউদ্দীন, এই ঐতিহ্যকে অব্যাহত রাখতে প্রায়ই আমাকে বলতেন যে আমার নানা, তাজউদ্দীন, শুধু তাঁর স্বামীই নন, তাঁর সবচেয়ে বড় পরামর্শদাতাও ছিলেন। তাজউদ্দীনের অদম্য প্রভাব তাঁর পরিবারের পরোপকারী আদর্শবাদে স্পষ্ট থেকে যায়।

তাজউদ্দীনের নেতৃত্বের চেতনা কোনো সুযোগ-সুবিধা অর্জন ও লোভ বা শোষণের উদ্দেশ্যে গড়ে ওঠেনি। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল জনকল্যাণ বিশেষত নিপীড়িত মানুষের জন্য। প্রকৃতপক্ষে, বর্তমান যুগে যেখানে জনপ্রতিনিধিদের ব্যক্তিত্ব এবং তাঁদের ব্যক্তিগত জীবনের প্রতিফলিত গুণাবলি খুঁজে বের করা কঠিন, এর বিপরীতে তাজউদ্দীন অসাধারণভাবে সংগতিপূর্ণ ছিলেন।

তাজউদ্দীনের নেতৃত্বের চেতনা কোনো সুযোগ-সুবিধা অর্জন ও লোভ বা শোষণের উদ্দেশ্যে গড়ে ওঠেনি। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল জনকল্যাণ বিশেষত নিপীড়িত মানুষের জন্য। প্রকৃতপক্ষে, বর্তমান যুগে যেখানে জনপ্রতিনিধিদের ব্যক্তিত্ব এবং তাঁদের ব্যক্তিগত জীবনের প্রতিফলিত গুণাবলি খুঁজে বের করা কঠিন, এর বিপরীতে তাজউদ্দীন অসাধারণভাবে সংগতিপূর্ণ ছিলেন। ব্রিটিশ ভারতের যুগে, তাঁর ছাত্রজীবনে লেখা ডায়েরিগুলো পড়লে বোঝা যায় যে তিনি কত সুশৃঙ্খল মানুষ ছিলেন। নিজেকে পরিশুদ্ধ করার সংগ্রামে যেমন সদা সচেষ্ট থেকেছেন, তেমনি নিজেকে নিবেদিত করেছেন নিরন্তর জনসেবায়।

অহংমুক্ত ও শুদ্ধ একটি হৃদয় থাকার ফলে সাধারণের প্রয়োজন ও চাহিদাকে তিনি অগ্রাধিকার দিতেন। তাঁর সেবাময় জীবনকে প্রায়ই ‘আত্মত্যাগ’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়। নিঃসন্দেহে তাঁর প্রতিফলন আমরা দেখি তাঁর সুদীর্ঘ কারাবাসে; জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের সঙ্গে দেশমুক্তির পণ নিয়ে উদ্দীপ্ত যাত্রায়; আর দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত তিনি পারিবারিক জীবন যাপন করবেন না—এমন ধনুর্ভঙ্গপণ অক্ষরে অক্ষরে পালন করার মধ্যে।

যা-ই হোক, আমি বিশ্বাস করি, তাজউদ্দীনের কাছে ব্যাপারটা ছিল তারও ঊর্ধ্বে। সেবা অবশ্যই তাঁর কাছে পবিত্র ছিল। তাঁর থেকেও গভীরতর ছিল সেবায় নিজেকে বিলীন করে দেওয়ার মধ্যে। ‘ত্যাগ’ মানে তো কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিলীন হয়েই যাওয়া। তাজউদ্দীন জনগণকে সঙ্গে নিয়ে অপ্রতিরোধ্য বাধা অতিক্রম করে বাংলাদেশের জন্য বিজয় ছিনিয়ে আনতে পেরেছিলেন আজীবন তিল তিল করে গড়া তাঁর সুদৃঢ় চারিত্রিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েই। এ যেন আধ্যাত্মিক পরিপূর্ণতা থেকে উৎসারিত এক মহৎ নেতৃত্ব উপমা, যেখানে তাঁর জীবনযাপনের মূলমন্ত্র সেবা ও ত্যাগ বিমূর্ত হয়েছিল দেশমাতৃকার মুক্তিতে-বিজয়ে।

কৈশোরে কতজনই–বা তাদের অবসর সময় কাটাতে বেছে নেবে চার কারাবন্দীর ব্যক্তিগত জীবনযাপন ও স্বদেশপ্রেম থেকে শিক্ষা নিতে? তাঁদের সঙ্গে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় ব্যস্ত থাকতে? করোনা মহামারিতে মানুষের পাশে দাঁড়াতে? শান্তিপ্রিয় হিসেবে তাঁর সমবয়সীদের মধ্যে জনপ্রিয়, তরুণ তাজউদ্দীন এমনকি নিজের পদমর্যাদা বা মঙ্গলের ঝুঁকি নিয়েও অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেন। তাঁর যৌবনের বড় বৈশিষ্ট্য ছিল তীব্র সংবেদনশীল হৃদয়। আমার মা প্রায়ই স্মরণ করেন যে একটি ভয়ানক ঝড়ের সময় মৃত একটি পাখির জন্য কীভাবে তিনি তাঁর বাবাকে নীরবে কাঁদতে দেখেছেন আর প্রথম প্রধানমন্ত্রীর মাটিতে বসে কাপড় কাচার স্মৃতি।

প্রথম বাংলাদেশ সরকারের রাজধানী মুজিবনগর, যার নামকরণ তিনি করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে, সেখানে দিবানিশি কাজের মধ্যে এক সকালে তিনি নিখোঁজ হয়ে যান। তাঁর সহকর্মীরা তাঁকে খুঁজে পান অফিসের পিয়নের কোয়ার্টারে। যেখানে তিনি একটি ভেজা তোয়ালে নিয়ে জ্বরে আক্রান্ত এক কর্মচারীর সেবা করছিলেন।

প্রথম বাংলাদেশ সরকারের রাজধানী মুজিবনগর, যার নামকরণ তিনি করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে, সেখানে দিবানিশি কাজের মধ্যে এক সকালে তিনি নিখোঁজ হয়ে যান। তাঁর সহকর্মীরা তাঁকে খুঁজে পান অফিসের পিয়নের কোয়ার্টারে। যেখানে তিনি একটি ভেজা তোয়ালে নিয়ে জ্বরে আক্রান্ত এক কর্মচারীর সেবা করছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের কঠিন সময় এক কোটি বাঙালি উদ্বাস্তুর ভরণপোষণের ব্যবস্থা, মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং তাঁকে হত্যার নানা প্রচেষ্টা ও নাশকতামূলক চক্রান্ত প্রতিহত করার সময়ও তিনি প্রতিমুহূর্ত মানবতার ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন।

তাজউদ্দীন অধস্তন ও সাধারণ ব্যক্তিদের সঙ্গে যেমন বিনম্র আচরণ করতেন, তেমনি বজ্রকঠোর ও আপসহীন থাকতেন সেই সব প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গে, যাঁরা অন্যায়কে সমর্থন করতেন। তাঁর এ দৃঢ়তার শক্তি ছিল জ্ঞান ও দূরদর্শিতার প্রতিফলন। তাঁর এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের জন্য জুলফিকার আলী ভুট্টো ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের ৬ দফা কর্মসূচি নিয়ে প্রকাশ্য বিতর্কে অংশ নেননি। লেখক ও কূটনীতিক এস এ করিম আওয়ামী লীগের অসহযোগ আন্দোলনকে সুসংগঠিত করার জন্য তাজউদ্দীনের পারদর্শিতাকে মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে তুলনা করেছেন।

বাঙালি রাজনীতির স্বর্ণযুগ সত্যিই আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে সেই প্রজন্মের অনেকেই কতটা অপার্থিবভাবে পরার্থপর ছিলেন। ক্ষমতা ভোগের ফাঁদে পড়ার মতো লোভ তাঁদের ছিল না। তাজউদ্দীনের জীবনের সবচেয়ে বড় কাজটি করার সুযোগ এসেছিল, প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতাযুদ্ধের রক্তাক্ত দিনগুলোতে, যেখানে জীবন বাজি রেখে তাঁকে বিক্ষিপ্ত নেতৃত্বকে পুনরায় একত্র ও পুনর্গঠন করতে হয়েছিল। বিজয় অর্জন তাঁকে কোনো গৌরব প্রদান না করলেও সেদিন পরাজয় হলে জাতির ভাগ্যে ঘটে যেত মহাবিপর্যয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান জেলে বন্দী থাকায় তাঁর অনুপস্থিতিতে তাজউদ্দীনের সুদক্ষ নেতৃত্বে মাত্র নয় মাসে বাংলাদেশের বিজয় অর্জন সম্ভবপর এবং গণহত্যা প্রতিরোধ হয়েছিল।

শুরুতেই তাজউদ্দীন বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকে ছাত্র, কৃষক ও শ্রমিকের বলে ঘোষণা করেছিলেন। সাধারণ ব্যক্তিরও নিজস্ব দেশ এবং ভবিষ্যতে সম–অংশীদারত্ব রয়েছে জানিয়েছিলেন। তিনি সহকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, ‘আসুন আমরা এমনভাবে কাজ করি যেন ইতিহাসের পাতায় আমাদের খুঁজে পাওয়া না যায়।’ একজন মহৎ ও খাঁটি নেতাই এমন উক্তি করতে পারেন। যিনি এবং যাঁরা কোনো কৃতিত্ব দাবি না করে নিঃস্বার্থ দেশ সেবার মধ্যে বিলীন হতে চেয়েছিলেন, তাঁদের খুঁজে তাঁদের জীবন ও কর্মের আলোক শিখা ছড়িয়ে দিতে হবে সমাজ ও রাষ্ট্রের সব কাতারে।

আমাদের নিজেদের স্বার্থেই আমাদের অজ্ঞাত এই বীরদের নতুন করে আবিষ্কার করতে হবে। যখন আমরা আমাদের সেরা মানুষদের ভুলে যেতে শুরু করি, তখন আমরা হারিয়ে ফেলি আমাদের অন্তরে বিদ্যমান সব সেরাকেই। ইতিহাসবিহীন মানুষ কোনো পরিচয় দাবি করতে পারে না। আর পরিচয়হীন মানুষ ভবিষ্যৎ দাবি করতে পারে না।

তাজ ইমান আহমদ ইবনে মুনির বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের নাতি এবং শান্তি ও ঐক্যর জন্য রূপান্তর সংগঠন জাগরণের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি
www.awakenbangladesh.org