দাসপ্রথা কি আবারও ফিরে আসছে?
নয়া উদারবাদের আড়ালে দাসপ্রথা কি আবারও ফিরে আসছে? ১৯ শতকের পর ধারণা করা হয়েছিল, অভিশপ্ত এই প্রথা আর ফিরে আসবে না। বর্তমানে আফ্রিকা থেকে জাহাজ ভরে দাস ধরে ধরে আনা হচ্ছে না। তবে আতঙ্কের বিষয় হচ্ছে, নতুন আঙ্গিকে, নতুন চেহারায় দাসপ্রথা আবারও যেন ফিরে আসছে। বা বলা যায়, এ প্রথা অব্যাহতই ছিল। এখন স্বরূপে পুনরুদ্ভাসিত হচ্ছে। নয়া উদারবাদ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো দাসপ্রথাকে এক নতুন রূপ দিয়েছে। এই নতুন রূপ হচ্ছে শ্রমবাজার ও দাসের পারস্পরিক নির্ভরশীলতার দাসপ্রথা। নব্য দাসরা যেমন বাজারের ওপর নির্ভরশীল। আবার বাজারও দাসদের ওপর নির্ভরশীল। সুবিধাবঞ্চিত নিম্ন আয়ের শ্রমিকেরা কর্মক্ষেত্রে নয়া উদারবাদ কাঠামোয় আধুনিক দাসে পরিণত হয়েছে।
শ্রমিকেরা মুক্ত বটে, তাঁরা অন্যের সম্পদও নন। এখন আর দাসের হাট বসে না। মনিব ও দাসের সেই প্রথাও নেই। কিন্তু সমাজের নীচু শ্রেণির মানুষদের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এতই খারাপ এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা এতটাই সীমিত, স্বল্প আয়ের বিনিময়েই শ্রমদান করে থাকেন। এ রকম পরিস্থিতি হঠাৎ করেই তৈরি হয়নি। বরং নয়া উদারবাদ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ধারণার ফল এই এই নয়া দাসত্ববাদ, যা এখন বিশ্ববাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। উদার অর্থনীতির নামে অবাধ ও মুক্ত বাজার, পাইকারি হারে বেসরকারিকরণ, অসমানুপাতিক সম্পদের মালিকানা ও বৈষম্য সমাজে দিন দিন বাড়ছেই। নয়া উদারবাদ এতটাই শক্তিশালী যে এর নাম ধরে সমালোচনা করাও মুশকিল। এখন সবাই প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি—এসবের পেছনেই ছুটছে। কিন্তু এই এই নয়া উদারবাদ অর্থনৈতিক কাঠামোর আড়ালে কোটি কোটি আধুনিক দাস তৈরি হচ্ছে; এদিকে কেউ নজর দিচ্ছে না।
শুরুতেই বলে রাখা ভালো, আধুনিক দাসত্ববাদের সংজ্ঞা নিয়ে অনেকের মধ্যেই দ্বিমত রয়েছে। মতভিন্নতা বা মতভেদ যা-ই থাকুক না কেন, দাসত্ববাদ নানা দিক দিয়ে সমাজে ছড়িয়ে আছে। এখানে বরং নয়া দাসত্ববাদের একটি দিক—অভিবাসন, নয়া উদারবাদ ও দাসত্ববাদের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করা যায়। অভিবাসন, নয়া উদারবাদ ও দাসত্ববাদের সম্পর্ক অত্যন্ত পারস্পরিক নির্ভরশীল। একদিকে নয়া উদারবাদ নতুন নতুন অভিবাসী তৈরি করছে, এই অভিবাসীরাই আবার অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে নয়া সস্তা দাস হিসেবে প্রবেশ করছে। উদাহরণ হিসেবে দেশে গার্মেন্টস খাত ও ইউরোপের অভিবাসন নিয়ে বলা যেতে পারে।
অভিবাসন, নয়া উদারবাদ ও দাসত্ববাদের সম্পর্কের সরলীকরণে বলা যায়, টেক্সটাইল, গার্মেন্টস, চিংড়ি খাতসহ বিভিন্ন খাতে যাঁরা শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন, এঁদের বড় একটি অংশই অভ্যন্তরীণ অভিবাসী। নদীভাঙন, বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও খরার কারণে এঁদের অনেকেই পূর্ববর্তী পেশা পরিবর্তন করে শিল্পাঞ্চলে চলে যান। প্রাকৃতিক দুর্যোগও আবার জলবায়ু পরিবর্তনের ফল। জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে অতিরিক্ত মুনাফালোভী অর্থনৈতিক কাঠামোর কারণে। কার্যত দেখা যাচ্ছে, অব্যাহত দুর্যোগ পরিস্থিতি সস্তা শ্রম সরবরাহ করে যাচ্ছে বাজারে। পেশা ও জীবিকা হারিয়ে শ্রমিকেরা যা পান, তার বিনিময়েই শ্রম বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। এ জন্য দেশে গার্মেন্টস খাতে এত স্বল্প বেতন (৫০০০-৮০০০ টাকা) দিয়েও শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে। এসব শ্রমিকের কোনো অধিকার নেই। ইউনিয়ন করার ও অধিকার নিয়ে কথা বলা সুযোগ নেই। কথা বললেই চাকরি নেই। গার্মেন্টস খাতে যে শ্রমশোষণ হচ্ছে, এটা উন্নত বিশ্বও জানে। কিন্তু অধিক মুনাফামুখীনতার কারণে উন্নত বিশ্ব শ্রমের প্রকৃত মূল্য দিতে রাজি হচ্ছে না। বিভিন্ন কলকারখানা, ইটভাটা, উপকূলে শুঁটকি প্রক্রিয়াজাত কেন্দ্রগুলো এখন দাসখামারে পরিণত হয়েছে। বলা যেতে পারে, এঁরা তো স্বেচ্ছায়ই শ্রম দিচ্ছেন। কিন্তু জাতিসংঘ ও আইএলওর সংজ্ঞা বিবেচনায় নিলে অবশ্যই এসব জায়গায় নয়া দাসত্ববাদের চর্চা হচ্ছে। সমসাময়িক কালে আধুনিক দাসত্ববাদ নিয়ে গবেষণা করছেন কেভিন ব্যালেজ। তাঁর মতে, শোষণ ও বঞ্চনার উদ্দেশে যেকোনো ব্যক্তির ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ স্থাপনই হচ্ছে আধুনিক দাসত্ববাদ।
জলবায়ু পরিবর্তন নয়া উদারবাদসৃষ্ট দুর্যোগের একটি উদাহরণ মাত্র। নয়া উদারবাদ এ রকম আরও অনেক দুর্যোগের কারণ। নানাবিধ রাজনৈতিক সংকটও সৃষ্টি হচ্ছে এ কারণে। ইউরোপে প্রতিবছর হাজার হাজার অভিবাসী পাড়ি জমাচ্ছে। স্থলপথ, জলপথ ও আকাশপথ যে যেভাবে পারছে ইউরোপে ঢুকছে। ২০১৫ সালেই ১০ লাখের বেশি অভিবাসী ইউরোপে পাড়ি জমায়। সাম্প্রতিক সময়ে সীমান্তপথগুলোয় কড়া নজরদারির কারণে কমে এলেও ইউরোপামুখী অভিবাসীঢল থেমে নেই। এর সঙ্গে হয়তো সরাসরি প্রাকৃতিক বা রাজনৈতিক দুর্যোগের সম্পর্ক নেই। তবে বড় একটি অংশই যে এসবের শিকার, তা নিয়ে খুব বেশি সন্দেহ নেই। এ নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা হয়নি বটে। তবে অনেকের সঙ্গেই কথা বলে জানা গিয়েছে, বিভিন্ন কারণেই তারা অভিবাসী হয়েছে। সাধারণভাবে মনে করা হয়, এদের সবাই অর্থনৈতিক অভিবাসী। কিন্তু মূল কারণ হচ্ছে, নয়া উদার অর্থনীতি এদের জন্য কোনো অর্থনৈতিক সমাধান হাজরি করতে পারেনি। তাই এরা অভিবাসী হচ্ছে। এবং অভিবাসিত হয়ে নতুন দাসে পরিণত হচ্ছে। জার্মানিতে আমি অনেককেই চিনি, যারা মাসে ২০০ থেকে ২৫০ ঘণ্টা কাজ করে থাকেন। কিন্তু ইউরোপের বেঁধে দেওয়া বেতনকাঠামোর হিসাবে মাত্র ১৫০ থেকে ১৬০ ঘণ্টার পয়সা পাচ্ছেন। বাকি শ্রমঘণ্টা কোথায় যাচ্ছে? প্রতি ঘণ্টায় বেতন যা দেওয়ার কথা, তা দেওয়া হচ্ছে না। এসব সবাই জানে। দেখে। কিন্তু কোনো পদক্ষেপ নেই।
কার্যত, ইউরোপ বিশাল দাসবাজারে পরিণত হয়েছে। ইউরোপের দেশগুলো লাখ লাখ সিরীয় উদ্বাস্তু নিয়ে বেশ বাহবা কুড়িয়েছে। সাধুবাদ অবশ্যই তাদের প্রাপ্য। যুদ্ধাক্রান্ত সিরীয়দের নিরাপদ আশ্রয় দিচ্ছে। কিন্তু এর বিপরীত চিত্রও মনে রাখতে হবে। ইউরোপের বাজারে শ্রমের ঘাটতি আছে। মাঝে অর্থনৈতিক মন্দার সময় বেকারত্বের বৃদ্ধি ঘটলেও শ্রমঘন খাতে শ্রমিকের ঘাটতি আবারও বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এই শ্রমিকের ঘাটতি মূলত পূরণ করছে অভিবাসীরা। এতে আসলে উভয় পক্ষেরই লাভ হচ্ছে। একপক্ষ পাচ্ছে নিরাপদ আশ্রয়। আরেক পক্ষ পাচ্ছে সস্তা দাস। এই দাসদের কিনে আনতে হয় না। আটকে রাখতে হয় না। ক্রয় করতে হয় না। এরা নিজেরাই ধরা দিতে চলে আসে।
১৯ শতকের তুলনায় এখন দাসের দাম বরং কমেছে। ওই সময় যুক্তরাষ্ট্রের আলাবামায় একজন দাস কিনতে ১ হাজার ২০০ ডলার ব্যয় হতো। এখনকার মূল্যমানে ৩০ থেকে ৪০ হাজার ডলারের সমমান। আর এখন? ৯০ থেকে ১০০ ডলার বা ৬০ থেকে ৭০ ইউরোতেই শ্রমদাস পাওয়া যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার হিসাবমতে, সারা বিশ্বে ২৭ মিলিয়ন মানুষ নানাভাবে দাসত্বের মধ্যে রয়েছে। এর মধ্যে ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও বাংলাদেশেই রয়েছে ১০ থেকে ১৫ মিলিয়ন আধুনিক দাস। দাসপ্রথা বিলোপের জন্য প্রায় ২৫০ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্র লড়াই করেছিল। সরকারি হিসাবমতে, প্রতিবছর ১৪ থেকে ১৭ হাজার মানুষ পাচারের শিকার হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকছে এবং দাসত্বের শিকার হচ্ছে।
২১ শতকের অন্যতম বড় অভিশাপ হচ্ছে আধুনিক দাসত্ববাদ। এটা সব জায়গাতেই ছড়িয়ে পড়ছে। উন্নত আধুনিক যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ বা যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া বা ইরাক, ঝুঁকিপূর্ণ পাকিস্তান বা জলবায়ুজনিত ঝুঁকিপূর্ণ বাংলাদেশ; সবাই কমবেশি নয়া দাসত্ববাদের শিকার হচ্ছে। তাই নয়া উদারবাদের দুই সংখ্যার প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, উন্নয়নের ফাঁদে পড়লেই হবে না। একই সঙ্গে মানবাধিকার, শ্রমিকাধিকারও নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে এসব উন্নয়ন, আয়বৃদ্ধি কেবলই স্বল্প কিছু গোষ্ঠীর কাছে কুক্ষিগত হয়ে থাকবে। নয়া দাসত্ববাদের আড়ালে ঢেকে যাবে সভ্যতার সব গৌরবময় সৌধ।
ড. মারুফ মল্লিক, ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো, ইনস্টিটিউট অব ওরিয়েন্ট অ্যান্ড এশিয়ান স্টাডিজ, ইউনিভার্সিটি অব বন