আরবে রাজনীতির মাঠে তিনটি চরিত্র সক্রিয় আছে। মঞ্চের একদিকে প্রধান চরিত্রে আছে মিসরে সৃষ্টি হওয়া মুসলিম ব্রাদারহুড ও এর বিভিন্ন দেশের শাখা। বিভিন্ন দেশে নির্বাচন হলেই ব্রাদারহুড বা তাদের শাখা-সংগঠন জিতে যায়। কিন্তু ক্ষমতা ধরে রাখতে পারে না। একমাত্র তুরস্কের রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। মঞ্চের মাঝামাঝি অবস্থান করছে ধর্মনিরপেক্ষ উদারপন্থীদের অংশ। এরা ব্রাদারহুডের সঙ্গে মিলে কর্তৃত্ববাদী একনায়কের বিরুদ্ধে লড়াই করে। পরে ব্রাদারহুড-সমর্থিতরা সরকার গঠন করলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যর্থতার অভিযোগে আন্দোলনে নামে।
উদারপন্থীরা পশ্চিমাদের সহানুভূতি পেলেও কখনোই রাজনীতির মূল চরিত্রে আসতে পারেনি। বরং পশ্চিমা প্রভাবিত সামরিক বাহিনী ও সুশীল সমাজ ক্ষমতার অংশীদার হয়ে মঞ্চের আরেক দিকে অপর প্রধান চরিত্র হয়ে বসে আছে। লড়াইটা হয় মূলত মুসলিম ব্রাদারহুড-সমর্থিত দলগুলোর সঙ্গে পশ্চিমা প্রভাবিত অভিজাতদের। এ লড়াইয়ে উদারপন্থী ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিও অংশ নেয়। কিন্তু বরাবর অভিজাতরাই জিতে যায়। নিজেদের ক্ষমতা সংহত করে। আরব দেশগুলো গণতন্ত্রের মরীচিকার পেছনেই শুধু ছুটে বেড়ায়। আরবরা যতই গণতন্ত্রের কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করে, গণতন্ত্র ততই দূরে সরে যায়। আরবে গণতান্ত্রিক সরকারগুলো খুব বেশি দিন টিকতে পারছে না। হাতে গোনা দু-একটি দেশে কালেভদ্রে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটের সরকার এলেও কয়েক দিন পর আবারও কর্তৃত্ববাদী শাসন জেঁকে বসে।
আরব বসন্ত দুটি দেশে কর্তৃত্ববাদী একনায়কতন্ত্রের পতন ঘটিয়েছিল। প্রথমে তিউনিসিয়া। এরপর মিসরে। কিন্তু মিসরে নির্বাচিত সরকার বেশি দিন টেকেনি। তিউনিসিয়াতেও ১০ বছরের বেশি টিকতে পারল না। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তিউনিসিয়া আরব বসন্তের বিপ্লবপূর্ব রাজনীতিতে ফিরে যেতে পারে। কাইস সাইদের কর্তৃত্ববাদী শাসন আরও দীর্ঘায়িত হতে পারে। ইতিমধ্যেই কাইস সব সরকারি প্রতিষ্ঠান, আইনসভা, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের নিয়ন্ত্রণ নিজ হাতে নিয়েছেন। কিন্তু কাইস যদি এককভাবে তিউনিসিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হন, তবে গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়তে পারে।
গৃহযুদ্ধ শুরু হলে তিউনিসিয়ায় আল-কায়েদা, ইসলামিক স্টেটের (আইএস) মতো জঙ্গি সংগঠনগুলোর উত্থান অবধারিত। এ কারণে আরবে আরও একটি যুদ্ধের ক্ষেত্র সৃষ্টি হতে পারে। অথবা কাইস ৩০ দিনের মধ্যে সংসদকে ক্ষমতা ফিরিয়ে দিলে তিউনিসিয়ার স্বাভাবিক রাজনীতি শুরু হতে পারে।
এটা ঠিক, তিউনিসিয়ার বরখাস্ত হওয়া সরকার আরব বসন্তের অনেক প্রতিশ্রুতিই পূরণ করতে পারেনি। দিন দিন বেকারত্বের সংখ্যা বাড়ছিল। এরই মধ্যে করোনার থাবা সাধারণের জীবনমানের আরও অবনতি ঘটিয়েছে। এসব কারণে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ দানা বাঁধতে শুরু করে। পরবর্তী নির্বাচনেই তিউনিসিয়ার জনসাধারণ নতুন সরকার বেছে নেওয়ার সুযোগ পেত। কিন্তু জনসাধারণকে এক পাশে সরিয়ে রেখে একটি বিশেষ গোষ্ঠী ও বহিরাগত শক্তি সরকারকে বরখাস্ত করেছে বলে এন্নাহাদার সমর্থকেরা অভিযোগ করছেন।
প্রেসিডেন্ট নিজে ও আমলাতন্ত্রের মধ্যে থাকা তাঁর সমর্থকেরা করোনার সময় ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছেন। বিক্ষোভকারীরা এন্নাহাদার অফিসে হামলা করেছে এবং আগুন দিয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য প্রধানমন্ত্রী বা তাঁর সরকার নয়; এন্নাহাদা পার্টিকেই তারা আক্রমণের লক্ষ্য বানিয়েছে।
আরব বসন্ত-উত্তরকালে তিউনিসিয়ার ক্ষমতার রাজনীতিতে ব্রাদারহুডের শাখা এন্নাহাদা পার্টি রাজনৈতিক অবস্থান পরিবর্তন করে ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলোর সঙ্গে জোট গঠন করে। এন্নাহাদা পার্টি তিউনিসিয়ায় শরিয়াহ আইন প্রবর্তনের পক্ষে থাকলেও শেষ পর্যন্ত রক্ষণশীল অবস্থান থেকে সরে আসে এবং ২০১৪ সালে নতুন সংবিধান প্রবর্তন করা হয়। নতুন সংবিধানে ব্যক্তির স্বাধীনতা, নারীর অধিকার ও সংখ্যালঘুর অধিকারের বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
এবারই প্রথম ক্ষমতা থেকে এন্নাহাদা পার্টি ছিটকে পড়ল না; ২০১৩ সালেও বিরোধী নেতা চকরি বেলাইদের হত্যাকাণ্ডের পর ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ায় এন্নাহাদা পার্টি। টেকনোক্র্যাট সরকার গঠন করা হয়। ২০১৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এন্নাহাদা পার্টি ধর্মনিরপেক্ষদের সঙ্গে যোগ দেয়। ওই নির্বাচনে বেইজি সাইদ এসেবি নির্বাচিত হন। এমনকি ২০১৯ সালে প্রেসিডেন্ট পদে শেষ রাউন্ডের ভোটে এন্নাহাদা কাইস সাইদকে সমর্থন করেছিল।
এত কিছুর পরও এন্নাহাদা তিউনিসিয়ার ধর্মনিরপেক্ষদের আস্থা অর্জন করতে পারেনি। ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলো কোনোভাবেই এন্নাহাদার সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করতে আগ্রহী নয়। তিউনিসিয়ার ঘটনা প্রমাণ করে, ইসলামপন্থী দল হওয়ার পরও ধর্মনিরপেক্ষদের সঙ্গে সমঝোতা করতে এন্নাহাদা যতটা উদার অবস্থানে ছিল, বিপরীতে উদারপন্থী ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলো এন্নাহাদার সঙ্গে সমঝোতা না করতে ততটাই কট্টর অবস্থান অবলম্বন করেছে।
তিউনিসিয়ার সরকার পতনের পর অনেকেই মন্তব্য করছেন, রাজনৈতিক ইসলাম ব্যর্থ হয়েছে। এ ক্ষেত্রে তাঁরা মিসরে মুসলিম ব্রাদারহুডের মোহাম্মদ মুরসির সরকারের পতনেরও উল্লেখ করেন। অবশ্য দুটি দেশে একই কায়দায় ব্রাদারহুড-সমর্থিত দলগুলোর পতন ঘটানো হয়েছে। জনবিক্ষোভের রেশ ধরেই মিসরে মুরসির সরকার ও তিউনিসিয়ার সরকার ক্ষমতার দৃশ্যপট থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়। কিন্তু মিসরে মুরসির পর ক্ষমতা দখলকারী ফাতাহ সিসির সরকারও পরিস্থিতির পরিবর্তন করতে পারেনি। বরং অর্থনৈতিক দুরবস্থার পাশাপাশি দমন-নিপীড়ন বেড়েছে।
মুরসির জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি খানিকটা নীরবতা অবলম্বন করায় এখন ধর্মনিরপেক্ষদেরই ধরে ধরে গুম করে দিচ্ছে সিসির সরকার। তিউনিসিয়াতেও একই পরিণতির শঙ্কা থেকে যায়। কাইস সাইদ অচিরেই নতুন বেন আলী হিসেবে আবির্ভূত হবেন না—এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই; বরং তিনি একনায়কত্ব কায়েম করার পথেই এগোতে পারেন। তাই মিসর ও তিউনিসিয়ায় রাজনৈতিক ইসলাম নয়, বরং গণতান্ত্রিক শক্তিকে কৌশলে দাঁড়াতে দেওয়া হচ্ছে না।
বলা যায়, সমস্যা রাজনৈতিক ইসলামের নয়, সমস্যা অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক রাজনৈতিক খেলার। আরবের রাজনীতি এক কঠিন সমীকরণের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। কোনো দল সরকার পরিচালনায় ব্যর্থ হলে নির্বাচনে নতুন সরকার আসবে। ইসলামপন্থীরা না পারলে ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি ক্ষমতায় আসবে। কিন্তু আরব দেশগুলোয় নির্বাচনের পথই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এসব দেশে ব্রাদারহুডের শাখা-সংগঠনগুলোর জনভিত্তি বেশ গভীর। যে কারণে নির্বাচন হলে এরাই ক্ষমতায় আসে। কিন্তু ব্রাদারহুডকে পাল্টা চ্যালেঞ্জ করার মতো জনসমর্থন বা রাজনৈতিক শক্তি উদারপন্থী দলগুলোর নেই। তাই মাঝেমধ্যে দু-একটি দেশে নির্বাচনের সুযোগ দেওয়া হলেও কয়েক বছরের মধ্যে আবার কর্তৃত্ববাদী শাসনেই ফিরে যায়।
তাই তিউনিসিয়ার সরকার পতনকে কেবল রাজনৈতিক ইসলাম, ব্রাদারহুড বা এন্নাহাদা পার্টির ব্যর্থতা হিসেবে বিবেচনা না করে গোটা আরবের রাজনীতিকে গুরুত্বসহকারে দেখতে হবে। অভিযোগ রয়েছে, তিউনিসিয়ার সরকার পতন ও জনবিক্ষোভে পশ্চিমাদের প্রক্সি শক্তি সৌদি আরব, আরব আমিরাত, মিসরের সিসি ও লিবিয়ার যুদ্ধবাজ নেতা খলিফা হাফতারের হাত রয়েছে। তাঁদের ভয় হচ্ছে, আরবের কোনো দেশে নির্বাচনের মাধ্যমে নিয়মিত ক্ষমতার পালাবদল হলে অন্য দেশেও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ঢেউ শুরু হবে।
পশ্চিমারাও চায় না আরবে গণতান্ত্রিক সরকার আসুক। মরক্কো থেকে ইরান পর্যন্ত জনসাধারণের সরাসরি ভোটে সরকার নির্বাচিত হলে ইসরায়েলের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে। তাই তারা শুধু তিউনিসিয়াই নয়, আরবের যেকোনো দেশেই গণতান্ত্রিক শাসনকে স্থায়ী হতে দেয় না। এ কারণেই আরবের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানও হয় না, কর্তৃত্ববাদী একনায়কতান্ত্রিক শাসন থেকে মুক্তিও মেলে না।
মারুফ মল্লিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক