ছবিগুলো ভয়ংকর আর শব্দগুলো শুনলে আতঙ্ক জাগে। ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিল হামলার ঘটনায় শুনানির প্রথম দিনের যে ভিডিও জবানবন্দি আমরা দেখতে পেলাম তা যেমন নগ্ন সত্য, আবার প্রচণ্ড বিরক্তিকরও। ১৮ মাস আগের একটা শীতের দিনের ঘটনার সাক্ষ্যপ্রমাণ হলেও এগুলো কোনোভাবেই আমেরিকার শুধু অতীতের ঘটনা নয়। বরং আমেরিকার ভবিষ্যৎ নিয়ে একটা গভীর সতর্ক বার্তা দিচ্ছে।
এখানে ভুল কিছু ভাবার অবকাশ নেই। ট্রাম্পের সহিংস সমর্থকেরা মার্কিন কংগ্রেসে ঢুকে যে তাণ্ডব চালিয়েছিল এবং নির্বাচনের ফলাফল বানচাল করার যে চেষ্টা করেছিল, তার সত্যতা বের করে আনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ। যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদের গঠিত কমিটি ক্যাপিটল হিলের ওই বিদ্রোহের তদন্ত করছে। তারা ১ লাখ ৪০ হাজারের বেশি নথিপত্র সংগ্রহ করেছে। এক হাজারের বেশি প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে কথা বলেছে। তারা এ ঘটনার সঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সম্পৃক্ততা খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছে। শুনানির সময় প্রকাশিত ভিডিও চিত্রে দেখা যাচ্ছে, দাঙ্গাকারীরা চিৎকার করে বলছে ‘মাইক পেন্সকে ঝুলিয়ে দাও’।
এর আগে রিপাবলিকান দলীয় একজন কংগ্রেস সদস্য বলেছিলেন, ৬ জানুয়ারির বিদ্রোহীদের আচরণ ছিল ‘সাধারণ পর্যটকদের ভ্রমণ’-এর মতো। কিন্তু নতুন করে প্রকাশিত ভিডিও চিত্রে সেই দাবি আর ধোপে টিকছে না। ক্যাপিটল হিলে হামলার দিনে ক্যারোলিন এডওয়ার্ডস নামে একজন নারী পুলিশ কর্মকর্তা মাথায় গুরুতর আঘাত পান। হামলার বিবরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন, উন্মত্ত জনতা তাঁকে ধাওয়া করে তাড়িয়ে নিয়ে যায় এবং জ্ঞান হারানো পর্যন্ত মারতেই থাকে। চারদিকে পেপার স্প্রে ও কাঁদানে গ্যাসের ঝাঁজ। মেঝেতে রক্তের বন্যা বইছিল। রক্তের মাঝেই তিনি অসাড় হয়ে শুয়ে ছিলেন। তিনি বলেছেন, এটা ছিল একটা হত্যাকাণ্ড। চারদিকে গোলমাল চলছিল।
গণতন্ত্রের সমস্যা হচ্ছে এটা সংকটের মধ্য দিয়েই টিকে থাকে, কিন্তু মানুষ খুব ভুলভাবে ধারণা করেন যে গণতন্ত্র হলো অবিনশ্বর। তবে আমরা গণতন্ত্র নিয়ে আত্মবিশ্বাসী এ কারণে যে, গণতন্ত্র শেষ দাওয়াই হিসেবেই টিকে থাকে। আজকের দিনে আমেরিকার গণতন্ত্র খুব বাজেভাবেই সেই অবস্থান থেকে সরে এসেছে।
ট্রাম্পের চারপাশের লোকেরা জানতেন, ক্যাপিটল হিলের ওই ঘটনা তদন্তের পেছনের কারণটি মিথ্যা। ট্রাম্পের অ্যাটর্নি জেনারেল উইলিয়াম বার তাঁর দেওয়া ভিডিও সাক্ষ্যে ২০২০ সালের নির্বাচনের ফলাফল চুরি করার ট্রাম্পের দাবিকে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। ট্রাম্পের মেয়ে ইভাঙ্কাও এই দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন। কিন্তু কংগ্রেসের রিপাবলিকান সদস্যদের মধ্যে অনেকেই ক্যাপিটল হিলের হামলার তদন্তটিকে আবর্জনার বাইরে কিছু ভাবেন না। তাঁরা ভালো করেই জানেন যে ওই দিন তাঁরা যা করেছেন, সেটা আইনপ্রণেতা হিসেবে তাঁদের শপথ ভঙ্গ। তবে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবর্তী নির্বাচনকে সামনে রেখে রিপাবলিকানরা স্বস্তির মেজাজে আছেন। তাঁরা মনে করছেন, ভোটারদের মন এখন দেড় বছর আগে ট্রাম্পের বিদ্রোহের চেয়ে বাইডেন সরকারের বর্তমান মূল্যস্ফীতি নিয়ে অনেক বেশি আচ্ছন্ন। পেট্রলের দাম যে গ্যালনপ্রতি ১০ ডলারে উঠেছে, সেটাই এখন মানুষের মাথাব্যথার বড় কারণ।
হতাশাজনক হলেও সত্য, রাজনীতিতে এমন ধারণাই সঠিক হয়। ডেমোক্র্যাটরা অতীতের একটা গুরুতর অপরাধের ঘটনা দিয়ে তাঁদের বর্তমান ব্যর্থতাকে বদলাতে পারবেন না। কিন্তু সবকিছুর পরও ৬ জানুয়ারি ঘটনা হারিয়ে যাওয়ার মতো কোনো বিষয় নয়। কেননা, এটা অতীতের বিষয় নয়। বর্তমানেরও বিষয়। এর সবচেয়ে নিশ্চিত প্রমাণ হলেন ট্রাম্প নিজে। অনেকে ধারণা করছেন, ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর মনোনয়ন যদি ট্রাম্প চান, তবে সেটা তিনি পেয়ে যাবেন। ৬ জানুয়ারির ঘটনা নিয়ে এখনো অনুতাপশূন্য ট্রাম্প। গত বৃহস্পতিবার শুনানি শুরুর আগে ট্রাম্প নতুন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ভিডিও পোস্ট করেন। সেখানে তিনি বলেছেন, ‘ওই দিনটি (৬ জানুয়ারি ২০২১) আমাদের দেশের ইতিহাসে তথা আমেরিকাকে আবার মহান করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মহত্তম আন্দোলন।
ট্রাম্প যদি আবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত না-ও হন, কিংবা সেই চেষ্টা না-ও করেন, তারপরও যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যতের সঙ্গে তাঁর নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে। ব্যক্তিগতভাবে ট্রাম্প কী করলেন না করলেন, এখন তাতে কিছু যায় আসে না। কেননা, ট্রাম্পবাদ এখন রিপাবলিকানদের আনুষ্ঠানিক মতাদর্শ। একাধিক জরিপের ফলাফল বলছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ রিপাবলিকান ভোটার বিশ্বাস করেন, ২০২০ সালের নির্বাচনের প্রকৃত বিজেতা হলেন ট্রাম্প। আগামী নির্বাচনে ট্রাম্প কিংবা ফ্লোরিডার গভর্নর রন ডিসান্তিসের মতো গোছালো রাজনীতিবিদের মতো যেই প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হোন না কেন, ডেমোক্র্যাটদের মূল্যবোধের বিরুদ্ধে ট্রাম্পবাদ সব সময়ের জন্য একটা সাংস্কৃতিক যুদ্ধ জারি রাখবে। আগামী দিনের আমেরিকার রাজনীতির কেন্দ্রীয় চিত্রই হবে এটি।
চলমান শুনানিকে অতীতের কৃতকর্মের বিচারের চেয়ে কেন ভবিষ্যতের হুমকি হিসেবে বিবেচনা করা প্রয়োজন? ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি একটা গণতান্ত্রিক নির্বাচনকে ভন্ডুল করে দেওয়ার উদ্দেশ্য যে ট্রাম্প সমর্থকদের ছিল, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। ট্রাম্প সমর্থকেরা ব্যর্থ হয়েছিলেন, কেননা, আমেরিকার নির্বাচনী ব্যবস্থায় তাঁদের নিবৃত্ত করার মতো যথেষ্ট বিধিবিধান রয়েছে। নির্বাচনী ব্যবস্থা ও ভোট গণনা দুই ক্ষেত্রেই আমেরিকায় স্বচ্ছতা রয়েছে। কিন্তু ২০২৪ সালের নির্বাচন ২০২০ সালের নির্বাচনের মতো না-ও হতে পারে। কেননা, রিপাবলিকানরা আটঘাট বেঁধেই নামছে।
রিপাবলিকানরা যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে খুব পদ্ধতিগতভাবে আমেরিকান গণতন্ত্রের রক্ষাবেষ্টনীটি ভেঙে টুকরা টুকরা করে ফেলছে। ২০২১ সালে রিপাবলিকান-শাসিত ১৯টি অঙ্গরাজ্যে ভোটারদের প্রতারণার হাত থেকে রক্ষা করার বিধি পাস হয়েছে। কাগজে-কলমে ভোটার রক্ষার বিধি হলেও বাস্তবে এটা ভোটার দমনেরই বিধি। নিম্ন আয় ও সংখ্যালঘু আমেরিকানদের ভোট দেওয়া কঠিন হয়ে উঠবে তাতে। এর প্রভাব চলতেই থাকবে।
সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, কয়েকটি রিপাবলিকান-শাসিত অঙ্গরাজ্যে আইনপ্রণেতারা নির্দলীয় নির্বাচনী ব্যবস্থার বদলে তাঁদের অথবা তাঁদের সঙ্গীদের বসানোর জন্য হইচই শুরু করেছেন। এর উদ্দেশ্য হলো আদালতকে বিচ্ছিন্ন করে অঙ্গরাজ্যগুলোর আইনপ্রণেতাদের নির্বাচনের একমাত্র কর্তৃপক্ষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা।
আগামী সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির (রিচার্ড নিক্সন এ ঘটনায় পদত্যাগ করতে বাধ্য হন) ৫০ বছর পূর্তি হবে। কিন্তু সে ঘটনার যদি পুনরাবৃত্তি এখন হয়, তবে পুরোপুরি উল্টো চিত্র আমরা দেখতে পাব। ডানপন্থী মিডিয়া সে ঘটনার প্রচার না-ও করতে পারে। বৃহস্পতিবারের শুনানির সময় ফক্স মিডিয়া সম্প্রচার করেনি। এটা এখন অকল্পনীয় যে সিনেটের রিপাবলিকান সদস্যরা তাঁদের পূর্বসূরিরা যেভাবে রিচার্ড নিক্সনকে অপসারণ করেছিলেন, সেই একই পথ অনুসরণ করবেন।
প্রায় এক দশক আগে ডেভিড র্যানসিম্যান ‘দ্য কনফিডেন্স ট্র্যাপ’ নামে একটা বই লিখেছিলেন। সেখানে তিনি যুক্তি দেখিয়েছিলেন, গণতন্ত্রের সমস্যা হচ্ছে এটা সংকটের মধ্য দিয়েই টিকে থাকে, কিন্তু মানুষ খুব ভুলভাবে ধারণা করেন যে গণতন্ত্র হলো অবিনশ্বর। তবে আমরা গণতন্ত্র নিয়ে আত্মবিশ্বাসী এ কারণে যে, গণতন্ত্র শেষ দাওয়াই হিসেবেই টিকে থাকে। আজকের দিনে আমেরিকার গণতন্ত্র খুব বাজেভাবেই সেই অবস্থান থেকে সরে এসেছে।
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে
জনাথন ফ্রিডল্যান্ড গার্ডিয়ানের কলাম লেখক