২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

জার্মান রাজনীতির ‘সৌভাগ্যের প্রতীক’ অ্যাঙ্গেলা ম্যার্কেল

অ্যাঙ্গেলা ম্যার্কেল
ছবি: রয়টার্স

৩০ বছর আগের ঘটনা। তখন অ্যাঙ্গেলা ম্যার্কেলের বয়স ৩৭ বছর। সাদাসিধে জীবনেই অভ্যস্ত ছিলেন তিনি। ১৯৯১ সালে প্রভাবশালী রাজনীতিক চ্যান্সেলর হেলমুট কোহলের হাত ধরে জার্মানির রাজনীতিতে প্রবেশ করেছিলেন তিনি। সেই সময় রাজনীতিতে আসা নিয়ে তিনি নানা দ্বিধা আর সংশয়ে ছিলেন।

হামবুর্গে জন্মগ্রহণকারী অ্যাঙ্গেলা ডরথিয়া ম্যার্কেল ১৯৫৪ সালে জন্মের পরপরই, সমাজতান্ত্রিক ধ্যানধারণায় বিশ্বাসী তাঁর ধর্মযাজক বাবা হোর্স্ট কেসনার এবং মা ইংরেজি ও ল্যাটিন ভাষার শিক্ষিকা হেরলিন্ড কেসনারের সঙ্গে পশ্চিম থেকে পূর্ব জার্মানিতে চলে যান।

১৯৮৯ সালের শেষের দিকে যখন পূর্ব জার্মানির সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙে বহুদলীয় গণতন্ত্রের সূচনা হচ্ছিল, সেই সময় সেখানে গণতান্ত্রিক জোটের মুখপাত্র হয়েছিলেন তিনি। পরে ১৯৯০ সালে পূর্ব জার্মানির সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী প্রধানমন্ত্রী লোথার ডে মেসায়ারের সরকারের সরকারি মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সেই ছিল পদার্থবিদ্যার কৃতী ছাত্রী ড. আঙ্গেলা ম্যার্কেলের রাজনীতিতে হাতেখড়ি।

রাজনীতিতে আসার পরপরই, ১৯৯১ সালে জার্মানির স্বনামধন্য সাংবাদিক গুন্থার গাউস অ্যাঙ্গেলা ম্যার্কেলের একটি সাক্ষাৎকারে নিয়েছিলেন।সেই সাক্ষাৎকারে রাজনীতিতে নবীন ম্যার্কেল তাঁর রাজনৈতিক-ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয়ের কথা বলেছিলেন। কারণ হিসেবে তিনি জার্মানির পূর্বাঞ্চলে একদম প্রত্যন্ত এলাকায় তাঁর বসবাস এবং অপরিচিত রাজনীতিক হিসেবে কতটা এগোতে পারবেন, তা নিয়ে সন্দেহের কথা জানিয়েছিলেন। সেই সময় ক্রিশ্চিয়ান গণতান্ত্রিক পার্টিতে সদ্য যোগ দেওয়া অ্যাঙ্গেলা ম্যার্কেল, তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সফলতা নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলেন। তখন কেই-বা জানত, প্রত্যন্ত পূর্ব থেকে উঠে আসা একজন পদার্থবিদ শেষ পর্যন্ত ১৬ বছর সুনাম আর সুখ্যাতি নিয়ে জার্মানি তথা বিশ্ব রাজনীতিক হয়ে উঠবেন।

অ্যাঙ্গেলা ম্যার্কেলের বাবা ছিলেন সমাজতন্ত্রের প্রতি উৎসাহী একজন প্রোটেস্ট্যান্ট যাজক। তাঁর দাদাও ছিলেন সাবেক পূর্ব জার্মানির কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। তিনি বেড়ে উঠেছিলেন রাজনীতিক পরিবারের সান্নিধ্যে। ১৯৮৬ সালে পিএইচডি করছেন ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রিতে। তাঁর স্বামী বার্লিনের হুমবোল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইয়োখিম সাওয়ার কোয়ান্টাম রসায়নে পিএইচডি ডিগ্রিধারী। এই দম্পতিযুগলের কোনো সন্তান নেই। সাংবাদিক গুন্থার গাউসের সেই সাক্ষাৎকারে তিনি পূর্ব আর পশ্চিমের তুলনা করতে গিয়ে পশ্চিমের প্রাচুর্যময় জীবনের প্রতি তাঁর অনাগ্রহ এবং পূর্ব জার্মানির জীবনব্যবস্থায় তিনি সুখী ছিলেন বলে জানিয়েছিলেন।

তাঁর বিদায় পর্বের অনুষ্ঠানে ৩ ডিসেম্বর তিনি বলেছেন, গণতন্ত্র রক্ষায় ঘৃণা, সহিংসতা ও ভুল তথ্যের বিরুদ্ধে সজাগ থাকতে হবে এবং গণতন্ত্রী হিসেবে সহনশীলতার সীমা খুঁজে বের করতে হবে। ১৬ বছর ক্ষমতায় আসীন থাকার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে ম্যার্কেল বলেন, সময়টা অত্যন্ত ঘটনাবহুল ছিল। ছিল চ্যালেঞ্জিং। তবে মানবিকতাকে ধারণ করেই তিনি তাঁর রাজনীতি করেছেন।

হেলমুট কোহলের মন্ত্রিসভায় ১৯৯১ সালে নারী ও যুববিষয়ক এবং ১৯৯৪ সালে পরিবেশ ও পরমাণু নিয়ন্ত্রণবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে ১৯৯৮ সালে ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও ২০০০ সাল থেকে দলের সভানেত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। রক্ষণশীল ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন পার্টিতে হেলমুট কোহল পরবর্তী অনেক ঝানু রাজনীতিক থাকলেও অ্যাঙ্গেলা ম্যার্কেল তাঁর আপন প্রতিভা আর কৌশলের জোরে সবাইকে পাশ কাটিয়ে জার্মানির রাজনীতিতে নিজের অবস্থান শক্ত করেন। পরপর চারবার নির্বাচনে জয়লাভ করার সাফল্য ইতিপূর্বে তাঁরই দলের দুই সাবেক চ্যান্সেলর কনরাড আডেনআওয়ার আর হেলমুট কোহল দেখিয়েছেন। দীর্ঘ সময় ধরে জার্মানির রাজনীতিতে অ্যাঙ্গেলা ম্যার্কেলের যে ইমেজ তৈরি হয়েছে, এর ধারেকাছে আপাতত কোনো রাজনীতিক দৃশ্যমান নন।

তাঁর বিদায় পর্বের অনুষ্ঠানে ৩ ডিসেম্বর তিনি বলেছেন, গণতন্ত্র রক্ষায় ঘৃণা, সহিংসতা ও ভুল তথ্যের বিরুদ্ধে সজাগ থাকতে হবে এবং গণতন্ত্রী হিসেবে সহনশীলতার সীমা খুঁজে বের করতে হবে। ১৬ বছর ক্ষমতায় আসীন থাকার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে ম্যার্কেল বলেন, সময়টা অত্যন্ত ঘটনাবহুল ছিল। ছিল চ্যালেঞ্জিং। তবে মানবিকতাকে ধারণ করেই তিনি তাঁর রাজনীতি করেছেন। ম্যার্কেল তাঁর উত্তরাধিকারী ওলাফ শলৎজ ও তাঁর আসন্ন সরকারকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আমি তাঁদের ভবিষ্যতে সব সময় অন্যের চোখ দিয়ে অভ্যন্তরীণ ও বিশ্ব সমাজ-রাজনীতিকে দেখতে বলব। তবেই প্রকৃত পরিস্থিতি অনুধাবন করা সহজ হবে।’

১৬ বছর ধরে তিনি দেশ চালালেও পুরো সময়টিতে ম্যার্কেলের পথ মসৃণ ছিল না। ২০০৮ সাল থেকে বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার ঝড়ে যখন ইউরোপসহ সারা বিশ্বে অনেক দেশের বেসামাল অবস্থা, তখন মুক্তবাজার অর্থনীতিকে সুকৌশলে সুনিয়ন্ত্রিত করেন। শুধু অর্থনৈতিক সংস্কার নয়, তাঁর শাসনামলে নানা সামাজিক সংস্কার তাঁর ভাবমূর্তি বাড়াতে সাহায্য করেছে।

গত বছরগুলোয় ইউরোপের দক্ষিণের গ্রিস, পর্তুগালের মতো দেশগুলোতে ইউরো মুদ্রা সংকটে, ইউরো মুদ্রাবাজার বা ইউরো জোন ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা হয়েছিল। তখন নিজের দেশে ও দলের মধ্য ইউরো সংশয়বাদীরা জার্মান আর্থিক খাত থেকে ঋণ দেওয়ার প্রশ্নে ও ঋণগ্রহীতাদের শক্ত শর্তের কারণে আঙ্গেলা ম্যার্কেল প্রচণ্ডভাবে সমালোচিত হন।

পরবর্তী সময় ইউরো সংশয়বাদীসহ ইউরো জোনের প্রবক্তারা, উভয়েই তাঁর নীতির প্রশংসা করেন। জাপানের ফুকুশিমার পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে দুর্ঘটনার পর তিনি জার্মানির পারমাণবিক এবং কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ক্রমে বন্ধ করে পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎ উৎপাদনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।

২০১৪ সালে ১০ লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়া, ২০১৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষমতায়নের পর অব্যাহতভাবে জার্মানি ও ইইউ সমালোচনা ও অযাচিত চাপ, ২০২০ সালে যুক্তরাজ্যের ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ছেড়ে চলে যাওয়া, রাশিয়ার সঙ্গে গ্যাস পাইপলাইন স্থাপন নিয়ে ঠান্ডা যুদ্ধ, সবশেষ করোনা পরিস্থিতিতে নানা সিদ্ধান্ত ও করোনা প্রতিরোধী টিকা নিয়ে দীর্ঘসূত্রতা প্রভৃতি সমস্যা তাঁকে মোকাবিলা করতে হয়।

গত ১৬ বছরে তাঁর এই অর্থনৈতিক ও সামাজিক বা পরিবেশবিষয়ক সংস্কার বা ইউরোপীয় এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতি জার্মানিকে শুধু এগিয়ে নিয়ে গেছে। তিনি রক্ষণশীল ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী হয়েও দলের গণ্ডি পেরিয়ে অন্য দলের সমর্থক ভোটারদের কাছে ভোট আদায়ে সক্ষম হয়েছেন। স্বল্পভাষী ম্যার্কেল সব সময় সময়োপযোগী আর কৌশলের সঙ্গে দেশ পরিচালনা করেছেন, সংকট থেকে উত্তরণের চ্যালেঞ্জে বিগত দিনগুলোতে তিনি জার্মানি ও ইউরোপীয় রাজনীতিতে অগ্রগণ্য নেত্রী হয়ে উঠেছিলেন। অ্যাঙ্গেলা ম্যার্কেলকে নিয়ে বার্লিন হুমবোল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক হ্যারফিল্ড মুঙ্কলার কিছুদিন আগে ডের টাগেস স্পিগেল পত্রিকাটিকে বলেছিলেন, ‘জার্মান রাজনীতির ললাটে ম্যার্কেল ছিলেন সৌভাগ্যের প্রতীক। তাঁর মতো রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী এই মুহূর্তে আমি দেখছি না।’

সরাফ আহমেদ প্রথম আলোর জার্মানি প্রতিনিধি
[email protected]