জাতীয় পর্যায়ে স্থানীয় সরকার দিবস চাই

ড. তোফায়েল আহমেদ
ড. তোফায়েল আহমেদ

বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দেশে-বিদেশে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বহু দিবস পালিত হয়। বর্তমান সময়ে দিবসের সংখ্যা এত বেশি হয়ে পড়েছে যে অনেক দিবস আনুষ্ঠানিকভাবে পালনের আহ্বান থাকলেও আবেদন খুব একটা থাকে না। তাই নতুনভাবে আরও একটি দিবস পালনের প্রস্তাব প্রস্তাবকারীর পক্ষেও বিব্রতকর। জাতীয়ভাবে পালিত দিনগুলোর মধ্যে জাতীয় ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ দিন; যেমন স্বাধীনতা দিবস, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, বিজয় দিবস ইত্যাদি সর্বত্র পালিত হয়। তারপর আসে জাতীয় নেতাসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে নানা অবদান রাখা ব্যক্তিদের জন্ম ও মৃত্যুদিবস। তৃতীয়ত, ধর্মীয় কারণে পালিত গুরুত্বপূর্ণ দিবস, যার আবেদন ওই ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর জন্য সর্বজনীন; যেমন ক্রিসমাস, ঈদ, জন্মাষ্টমী, বুদ্ধপূর্ণিমা ইত্যাদি এ-জাতীয় দিবসের অন্তর্গত। চতুর্থত, আরও কিছু কিছু দিন বিশেষ গুরুত্বসহকারে পালন করা হয়, বিশেষ কিছু ধ্যানধারণা, আদর্শকে প্রতিষ্ঠা বা জনপ্রিয় করার জন্য; যেমন জাতীয় সমবায় দিবস, আন্তর্জাতিক নারী দিবস, কন্যাশিশু দিবস, হাত ধোয়া দিবস ইত্যাদি। যে দিবসটির প্রস্তাব করা হচ্ছে তা চতুর্থ পর্যায়ের দিবসের সমপর্যায়ের হতে পারে। আমাদের প্রতিবেশী ভারতসহ পৃথিবীর বহু দেশে এ দিবসটি পালিত হয়।

প্রস্তাবিত দিন বা দিবসটি হচ্ছে দেশে স্থানীয় শাসন, স্থানীয় সেবা, স্থানীয় গণতন্ত্র ইত্যাদির ওপর যথাযথ নীতিকাঠামো তৈরি ও তা প্রয়োগ এবং গণতান্ত্রিক ও জবাবদিহিমূলক স্থানীয় সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কার্যক্রমকে উৎসাহিত করার জন্য বছরের একটি দিন সারা দেশে যথাযথ গুরুত্বসহকারে ‘স্থানীয় সরকার দিবস’ শিরোনামে একটি দিবস পালন। বহুবার বহু ফোরামে বিষয়টি ওঠানো হয়েছে। কিন্তু আমাদের স্থানীয় সরকার নেতাদের উদাসীনতার কারণে বিষয়টি বেশি দূর এগোয়নি। ভারতে ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ২৪ এপ্রিলকে সর্বভারতীয় নেতৃস্থানীয় সরকার দিবস ঘোষণা করেন। কেন্দ্রীয় পঞ্চায়েত মন্ত্রণালয় ভারতে জাতীয়ভাবে এ দিবসটি পালন করে থাকে। ২৪ এপ্রিল ১৯৯৩, ভারতীয় সংবিধানের ৭৩ তম সংশোধনী পাস হয়। সংবিধানের ৭৩ ও ৭৪ তম সংশোধনীর মাধ্যমে ভারতের স্থানীয় সরকারব্যবস্থা সাংবিধানিক গ্যারান্টি লাভ করে। এই গ্যারান্টি ক্লজ বলে ভারতের সব রাজ্যে বাধ্যতামূলকভাবে তিন স্তরবিশিষ্ট গ্রামীণ স্থানীয় সরকার ও এক স্তরবিশিষ্ট নগর স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়।

এই সংশোধনীর নির্দেশনা হিসেবে স্থানীয় সরকার অর্থ কমিশন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের অর্থায়ন-প্রক্রিয়াকে দলীয় রাজনীতিবলয়ের বাইরে এনে আইনানুগ বিধান অনুসরণ প্রতিটি রাজ্য সরকারের ওপর বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ে এবং এভাবে অর্থায়নে নিরপেক্ষতার নীতি প্রতিপালনের নিশ্চয়তা প্রদানের চেষ্টা করা হয়। ২০১০-এর স্থানীয় সরকার দিবসের প্রধান অনুষ্ঠানে মনমোহন সিং এবং ২০১৫ সালের অনুরূপ অনুষ্ঠানে নরেন্দ্র মোদি স্থানীয় সরকার বিষয়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিক নিয়ে আলোকপাত করেন। সর্বভারতীয় স্থানীয় সরকার দিবসে স্থানীয় সরকারে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য জাতীয় পুরস্কারের রীতি চালু হয়েছে।

ভারতে বিভিন্ন রাজ্য আবার পৃথকভাবেও দিবসটি পালন করে থাকে। কেরালার সরকার প্রতিবছর ১৯ ফেব্রুয়ারি দিনটি পালন করে থাকে। ওই দিনটি বলবন্ত রায় মেহতার জন্মদিন। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু বলবন্ত রায় মেহতার নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করেন এবং সে কমিটির প্রতিবেদন ভারতে শক্তিশালী স্থানীয় সরকার ও শাসনকাঠামোর গোড়াপত্তন করে। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে কেরালায় এই দিনটিতে স্থানীয় সরকার দিবস উদ্যাপিত হয়। আবার ওডিশায় বিজু পট্টনায়েকের জন্মদিন, ৫ মার্চ। ওই রাজ্যে স্থানীয় সরকার দিবস ও বিজুর জন্মদিন একসঙ্গে পালিত হয়। বিজয়ানন্দ (বিজু) পট্টনায়েকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে ভারতের উচ্চপদস্থ বিমানসেনা ছিলেন, পরে রাজনীতিতে আসেন এবং ১৯৯০ থেকে ১৯৯৫ ওডিশার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। বর্তমানে নবীন পট্টনায়েকে, তাঁরই পুত্র যিনি ওডিশার মুখ্যমন্ত্রী। যুক্তরাজ্যের নিউ সাউথ ওয়েলসে ৩০ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট সপ্তাহব্যাপী স্থানীয় সরকার সপ্তাহ পালিত হয়।

ভারতীয় উপমহাদেশ ও বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক কলকাতা, মাদ্রাজ ও মুম্বাই-এ তিনটি শহরে পৌরসভা প্রতিষ্ঠাকে স্থানীয় সরকারের সূচনা হিসেবে দেখলে এ প্রতিষ্ঠানের বয়স প্রায় ৩০০ বছর। পরবর্তী সময়ে উপমহাদেশের প্রথম স্বাধীনতাযুদ্ধ (১৮৫৭) শেষে জেলা পর্যায়ের কাউন্সিল বা বোর্ড গঠনকে বিবেচনায় নিলে গ্রামীণ স্থানীয় সরকারের বয়স প্রায় ১৬০ বছর। বাংলাদেশে স্থানীয় সরকারব্যবস্থা একটি সংবিধানস্বীকৃত এবং আইনানুগ পন্থায় গঠিত প্রতিষ্ঠানসমষ্টি। দেশে প্রায় ৪ হাজার ৫৭৩টি ইউনিয়ন পরিষদ, ৪৯০টি উপজেলা পরিষদ, ৬৪ (৬১ +৩) টি জেলা পরিষদ, ৩২৭টি পৌরসভা এবং ১২টি সিটি করপোরেশন বিদ্যমান। এসব প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৬২ হাজার নির্বাচিত প্রতিনিধি রয়েছেন। জাতীয় রাষ্ট্র ও স্থানীয় রাষ্ট্র উভয় ক্ষেত্রে তাঁদের স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও দায়িত্বশীলতা নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। স্থানীয় গণতন্ত্র, শাসন ও সেবা এবং জাতীয়তার সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয়তার ওপরও যথাযথ গুরুত্ব আরোপের জন্য পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও বছরে এক দিন স্থানীয় সরকার দিবস বা সপ্তাহব্যাপী স্থানীয় সরকার সপ্তাহ পালনের আহ্বান জানাই।

প্রশ্ন হতে পারে কখন, কী বিষয় নিয়ে এবং কীভাবে এ দিবস বা সপ্তাহ পালিত হতে পারে? বিষয় হতে পারে দিবস বা সপ্তাহ পালনের সময় প্রতিটি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান তাদের বিগত দিনের কার্যক্রম নিয়ে নিজ নিজ নির্বাচকমণ্ডলীর কাছে জবাবদিহি করবে এবং আগামী দিনের কর্মপরিকল্পনা তুলে ধরবে। জাতীয়ভাবে সরকার প্রতিবছর এ দিবসের একটি প্রতিপাদ্য ঠিক করে দিতে পারে। কখন বা বছরের কোন সময় দিনটি পালিত হতে পারে? এ প্রসঙ্গে সুপারিশ, তা প্রতিবছর মার্চ মাসের প্রথম দিন বা প্রথম সপ্তাহ হলে ভালো হয়। এতে একটি সুবিধা হচ্ছে চলতি অর্থবছরের বিগত আট মাসের কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা এবং অর্থবছরের শেষ ত্রৈমাসিকে (এপ্রিল-জুন) কী কী করণীয়, তার একটি বাস্তবসম্মত কর্মপরিকল্পনা মার্চ মাসে চূড়ান্ত করা সম্ভব হবে। দেশের প্রতিটি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান নিজ নিজ উদ্যোগে এ দিবস বা সপ্তাহ পালন করবে। জাতীয়ভাবে এ-জাতীয় একটি দিবস পালন শুধু স্থানীয় সরকারকে নয়, জাতীয় উন্নয়নেও সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

ড. তোফায়েল আহমেদ: রাজনীতি ও লোকপ্রশাসনের অধ্যাপক, স্থানীয় সরকার ও শাসন বিশেষজ্ঞ
tofail101@gmail.com