
জন্ম-মৃত্যু জীবজগতের অমোঘ জীবনচক্রের স্বাভাবিক নিয়ম। কিন্তু মৃত্যু যখন যেখানে স্বাভাবিক নয়, সেখানে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাই স্বাভাবিক। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে অস্বাভাবিক মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে, কিন্তু তা সমাজে কোনো তরঙ্গ সৃষ্টি করছে না। এ মৃত্যুর মিছিল বন্ধ করার আশা ও আশ্বাস কোথাও নেই।
সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সব পর্যায়ে অস্বাভাবিক মৃত্যুসহিষ্ণুতা, আশ্চর্য শিথিলতা, অমানবিক তাচ্ছিল্য এবং ক্ষমাহীন উদাসীনতা। কোনো কোনো হত্যাকাণ্ড নিয়ে জাতীয়-আন্তর্জাতিক প্রতিবাদের ঝড়, আবার বহু হত্যাকাণ্ড অনুল্লেখ্য-অনুচ্চারিত। মৃত্যু, হত্যা, গুম, খুন, জখম—এগুলোর শ্রেণিভেদ অমানবিক ও অগ্রহণযোগ্য। প্রতিটি অন্যায় আঘাতের প্রতিবাদ-প্রতিকার একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজের মূল দাবি।
এ দেশের জন্ম-ইতিহাস রক্তাক্ত। অনেক অনেক অশ্রু, সম্ভ্রম, রক্ত ও জীবনের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের এই স্বাধীন দেশ। একটি মানবিক ও ন্যায়নিষ্ঠ সমাজ গড়াই তো ছিল আমাদের সব ত্যাগ-তিতিক্ষার কারণ। আজকে স্বদেশে স্বজাতি ও স্বজনের হাতে কেন এত মৃত্যু সংঘটিত হবে? অতীত অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হওয়া উচিত ছিল, আমরা জীবনের বিনিময়ে জীবন রক্ষা করব। প্রাণসংহারের মতো অমানবিকতা আমাদের মতো স্বাধীনতাসংগ্রামের উত্তরাধিকারীর প্রত্যাশার সঙ্গে বেমানান শুধু নয়, সার্বিক জাতীয় অপরাধ ও কলঙ্ক। তাই সার্বিক এক অপরাধবোধকে সামনে রেখেই এই আলোচনার সূত্রপাত।
নয় মাসের স্বাধীনতাযুদ্ধে লাখ লাখ শহীদের প্রসঙ্গটি সংগত কারণে পৃথকভাবে বিবেচনা করে অন্যান্য অস্বাভাবিক মৃত্যুগুলো শ্রেণিবদ্ধ করে আমাদের নির্মোহ বিশ্লেষণে যেতে হবে। যেমন—স্বার্থগত দ্বন্দ্বের কারণে অপরাধমূলক খুন, জখম, প্রভাব-প্রতিপত্তি ও ব্যবসায়িক কারণে খুন, রাজনৈতিক মতাদর্শগত আন্দোলনে প্রাণহানি, নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব, দৈব-দুর্বিপাক; বিশেষত প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বিভিন্ন রকমের দুর্ঘটনা (সড়ক, নৌ কিংবা আকাশপথ), পারিবারিক বিরোধ ইত্যাদি অস্বাভাবিক হলেও অপ্রতিরোধ্য নয়। এসব প্রাণহানি আইনশৃঙ্খলার প্রশ্ন এবং সমাজের অপরাধপ্রবণতার নিরিখে বিচার্য। কিন্তু সাম্প্রতিক কালের অস্বাভাবিক মৃত্যুতে নতুন নতুন মাত্রা যুক্ত হচ্ছে। সংগঠিত ও টার্গেট করে এবং আন্তর্জাতিকভাবে সংগঠিত গোষ্ঠীর সংশ্লিষ্টতায় ভিন্ন ধর্মীয় ভাবাদর্শ, লেখক, প্রকাশক, ব্লগার হত্যাকাণ্ড। হত্যাকাণ্ড থেকে ধর্মগুরু, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সমকামী অধিকার রক্ষায় সোচ্চার কোনো কর্মী—কারও রেহাই মিলছে না। তা ছাড়া নারী ও শিশুর ওপর সহিংসতা, যৌন নিপীড়ন ও হত্যা—এসবেরও যেন বিস্তার অপ্রতিরোধ্য। তা ছাড়া সার্বিকভাবে সামাজিক অসহিষ্ণুতাও সর্বত্র। এ সবকিছুর পটভূমিতে ভিন্ন একটি মৃত্যু ও প্রাণহানির মিছিল বিষয়ে মহামান্য রাষ্ট্রপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে এ লেখার অবতারণা।
দেশে স্থানীয় সরকারব্যবস্থার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে শুরু হয়েছে, জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত তা চলবে। নির্বাচন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ, জনগণের শাসনকার্যে অংশগ্রহণ এবং জননেতৃত্বের বৈধতাদানে যত দোষত্রুটিই থাকুক, নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশের মানুষ বহু রকমের সরকারের অধীনে বহুমাত্রিক নির্বাচন করে আসছে। অন্তত ১৯৩৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত নির্বাচনী ইতিহাস পর্যালোচনা করলে তার বিস্তারিত অভিজ্ঞতা জানা যাবে। প্রতিটি নির্বাচন কোনো না কোনো একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য নিয়ে ইতিহাসে স্থান করে নেয়। আমাদের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন (২০১৪) এবং তৎপরবর্তী উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ও ঢাকা-চট্টগ্রামের তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ম, অনিয়ম, কারচুপি ইত্যাদি নিয়ে কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্যের দাবি রাখে। কিন্তু চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অনিয়ম, কারচুপি, জাল, ভুয়া ভোট ইত্যাদির যে চিত্র দেখা যাচ্ছে, তা ২০১৪ সাল থেকে হয়ে আসা নির্বাচন-প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতা। তাই নির্বাচন-পদ্ধতিতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করে এসব অনিয়ম থেকে নির্বাচনকে মুক্ত করা এখনো সম্ভব বলে আমি মনে করি। কিন্তু যে একটি অপূরণীয় ক্ষতিকর বৈশিষ্ট্য এই ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা পেতে যাচ্ছে, তা হচ্ছে ‘জননিরাপত্তার একটি মহাবিপর্যয়’। এ বিপর্যয় এমন একটি স্তরে উন্নীত বা অবনত হলো, অদূর ভবিষ্যতে যার ক্ষতি পুষিয়ে ওঠা অসম্ভব।
বাংলাদেশের স্মরণাতীতকালের ইতিহাসে এটি একটি নির্বাচন, যেখানে ছয় ধাপের নির্বাচনে দুই ধাপ বাকি থাকতেই ৬৯ জনের প্রাণহানি এবং সাত হাজার আদম সন্তান আহত। প্রতিদিন জাতি লাশের ও মৃত্যুর নতুন নতুন সংখ্যা পাচ্ছে। কিন্তু এসব মৃত্যুতে সমাজে ও রাষ্ট্রে কোনো উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা লক্ষ করা যাচ্ছে না। সর্বত্র অদ্ভুত ও অস্বাভাবিক সহিষ্ণুতা, অমানবিক তাচ্ছিল্য এবং ক্ষমাহীন উদাসীনতা। সমাজে প্রতিটি মৃত্যুই বেদনাদায়ক ও দুঃখজনক। তা যদি স্বাভাবিক মৃত্যু না হয়, তাহলে অবশ্যই উদ্বেগজনক। এটি যদি আবার লাগাতার হয়, তাহলে বিপর্যয়কর। অদ্ভুত শোনালেও সত্য যে মৃত্যুর নিন্দা ও প্রতিবাদেও শ্রেণিভেদ আছে। মুক্তমনা ব্লগার বা সমকামী অধিকার আন্দোলনের কর্মী হলে তা আন্তর্জাতিক প্রতিবাদের বিষয় হয়। রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কর্মী হলে তা অন্তত জাতীয় পর্যায়ে কিছুদিনের জন্য হলেও কিছু উত্তাপ-উত্তেজনা সৃষ্টি করে, পরে তা বুদ্বুদের মতো আবার মিলিয়ে যায়। সাগর-রুনি, মিশুক মুনির-মাসুদ কিংবা সাম্প্রতিক সময়ের তনু অথবা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চার শিক্ষক—সবার ক্ষেত্রে একই বিষয় সত্য হয়ে ওঠে।
কিন্তু একটি জাতীয় ঘটনার ধারাবাহিকতায় ৬৯ জনের মৃত্যু ও সাত হাজার জনের আহত হওয়ার ঘটনাটি আলাদা বিবেচনায় আনছি এ কারণে যে, এই প্রতিকারের পদক্ষেপ ও ঘটনাপরম্পরা বিশেষভাবে পৃথক্করণের দাবিদার। প্রথমত, এটি একটি নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মধ্যে ঘটছে। অতীতের কোনো নির্বাচনে এ রকম ঘটেনি। যে নির্বাচন জননিরাপত্তা বিপর্যস্ত করেছে, সেই নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের সুরক্ষা ও প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ অসম্ভব এক আকাশকুসুম কল্পনা। তাই রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত দায়িত্ব জনগণের জানমালের সুরক্ষাদান ও জননিরাপত্তা রক্ষা করা। জননিরাপত্তা বিঘ্নিত করে নির্বাচনী গণতন্ত্রের প্রহসন কোনো মানদণ্ডেই গ্রহণযোগ্য নয়। আগে জননিরাপত্তা, তারপর বেঁচে থাকলে গণতন্ত্র ও নির্বাচন।
নির্বাচনকালীন সরকার নির্বাচন কমিশনকে কোনো নির্দেশনা দিতে পারে না। নির্বাচন কমিশন তাদের কাজের জন্য সরকারের কাছে যেকোনো রকমের সহায়তা চাইতে পারে এবং সরকার আইনগতভাবে তা দিতে বাধ্য। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের নির্লিপ্ততা রহস্যজনক। বর্তমানে নির্বাচন কমিশনের নিয়োগকর্তা হিসেবে শুধু গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতিই পারেন নির্বাচন কমিশনের কাছে কৈফিয়ত চাইতে। তারা কেন জননিরাপত্তা এভাবে বিপর্যস্ত হওয়ার পরও নির্লিপ্ত। নির্বাচন কমিশনকে রাষ্ট্রপতির কাছে এ ব্যাপারে জবাবদিহি করতে হবে। অবশ্য যদি মহামান্য রাষ্ট্রপতি তা চান।
এ নির্বাচন আবহমান গ্রামীণ সমাজের বিরাজিত সামাজিক সংহতি বিনষ্ট করছে। এই হানাহানি শুধু নির্বাচনেই সমাপ্ত হওয়ার নয়। হানাহানির যে বিষবৃক্ষ নির্বাচন কমিশনের অদক্ষতা, অযোগ্যতা ও উদাসীনতায় রোপিত হলো, তা বংশপরম্পরায় বিস্তার লাভ করবে। সমাজে সার্বিক অস্থিরতা বাড়বে। আমরা এ-জাতীয় হিংসা, অস্থিরতা, প্রাণবিনাশী ও জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী নির্বাচন চাই না। এ-জাতীয় নির্বাচনের আড়ালে ব্যাপক প্রাণসংহার ও গণতন্ত্রের বিনাশ ঘটছে। তিরোহিত হচ্ছে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, সামাজিক শান্তি এবং জননিরাপত্তার সব স্বীকৃত পথ ও পন্থা।
তাই মাননীয় রাষ্ট্রপতির কাছে দেশের নিরীহ মানুষের প্রাণ ভিক্ষা চাই। এ নির্বাচনের ঘোষিত তফসিল স্থগিত করে প্রতিটি মৃত্যু, হিংসা ও হানাহানির তদন্ত করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়দায়িত্ব নিরূপণ করা হোক। দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি এবং নির্দোষ ও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করুন। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া ৬৯ জন আদম সন্তানকে খড়কুটো হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। তারা তথাকথিত গণতন্ত্র ও নির্বাচনী বন্দুকের গোলাবারুদ নয়। তারা এ রাষ্ট্রের নাগরিক। রাষ্ট্রের সব ধরনের আইনি সুরক্ষার অধিকার তাদের রয়েছে। যে নির্বাচন জননিরাপত্তার ওপর এ ধরনের হুমকি সৃষ্টি করে, সেই নির্বাচন থেকে কিছু অর্জিত হওয়ার নয়। অবিলম্বে এ নির্বাচনী তফসিল স্থগিত করে যথাযথ তদন্ত, বিচার ও ক্ষতিপূরণ দিয়ে আশা করি রাষ্ট্র তার ‘জননিরাপত্তা’ রক্ষার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পূরণ করে সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করবে। অবস্থা স্বাভাবিক হলে অবশ্যই নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে কোনো বাধা থাকবে না।
ড. তোফায়েল আহমেদ: সমাজবিজ্ঞান ও স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ।
tofail101@gmail.com