২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

জনগণের পক্ষে লবিস্ট নিয়োগ করবে কে?

দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের জল-স্থল-অন্তরিক্ষে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু লবিস্ট নিয়োগের ঘটনা। কে, কত টাকায়, কোথায় লবিস্ট নিয়োগ করেছেন, লবিস্ট নিয়োগে কী ফল পাওয়া গেছে, লবিস্ট নিয়োগের টাকা কোথা থেকে এসেছে ইত্যাদি নিয়ে প্রায় প্রতিদিন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দল বিএনপির নেতারা বাগ্‌যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন।

এরই মধ্যে মার্কিন কংগ্রেস সদস্য ও পররাষ্ট্রবিষয়ক হাউস কমিটির চেয়ারম্যান গ্রেগরি ডব্লিউ মিকসের একটি বক্তব্য নিয়েও পরস্পরবিরোধী কথা শোনা যাচ্ছে। বাসস পরিবেশিত খবরে বলা হয়, গত সোমবার নিউইয়র্কের কুইন্স এলাকায় একটি তহবিল সংগ্রহের জন্য আয়োজিত অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, তারা (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে চায় না। কিন্তু মানবজমিন তাঁর বক্তব্যের ভিডিও ক্লিপের বাংলা ভাষান্তর ছেপেছে। এতে দেখা যায়, ওই কংগ্রেস সদস্য এ রকম কোনো আশ্বাস দেননি, বরং বলেছেন, বাংলাদেশের প্রকৃত পরিস্থিতি জানতে তিনি সেখানে যেতে চান। ঢাকায় যে নতুন রাষ্ট্রদূত যাচ্ছেন, তাঁর কাছ থেকেও খবর নেবেন, সবার কথা শুনবেন। এরপর বাংলাদেশ বিষয়ে তাঁর মতামত জানাবেন। মিকস আরেকটি কথা বলেন, ২০২৩ সালের নির্বাচন তাঁরা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে চান।

ধারণা করি, লবিস্ট নিয়োগ বিতর্ক ২০২৩ সালের নির্বাচন পর্যন্ত চলবে। মন্ত্রীদের অভিযোগ, বিএনপি দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে লবিস্ট নিয়োগ করেছে আর সরকার সেই ষড়যন্ত্র রুখতে লবিস্ট নিয়োগ করেছে। বিএনপির পাল্টা জবাব, সরকার যে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করছে, নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংস করছে, বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা হত্যা ও গুমের শিকার হচ্ছেন, সেসব তারা উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে তুলে ধরছে।

এই যে লবিস্ট নিয়োগ নিয়ে বিতর্ক, এর কোথাও জনগণ নেই। মনে হচ্ছে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের দায়বদ্ধতা বিদেশিদের কাছে। যখন যে দল ক্ষমতায় আসে, তখন তারা নিজেদের জনপ্রিয়তাকে স্থায়ী বন্দোবস্ত ভাবে।

সংবিধানের সপ্তম অনুচ্ছেদের (১) উপধারায় বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে।’ উপধারা (২)-এ আছে, ‘জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তি রূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোনো আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসামঞ্জস্য হয়, তাহা হইলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইবে।’

আওয়ামী লীগের নেতা-মন্ত্রীদের কথাবার্তা স্ববিরোধী। তাঁরা একদিকে বলছেন বিএনপি দেশের জনগণ দ্বারা পরিত্যক্ত এবং মৌলবাদী ও জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে আন্তর্জাতিক মহলে বন্ধুহীন। অন্যদিকে তাঁরা দাবি করেন, বিএনপির অপপ্রচারের কারণে র‍্যাবের সাবেক ও বর্তমান সাত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা এসেছে।

সংবিধানের এই অনুচ্ছেদ বিশ্লেষণ করলে আমরা দুটি বিষয় পাই। এক. প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ। কোনো রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠী নয়। জনগণ যাঁকে চাইবে, তিনিই দেশ চালাবেন। প্রশ্ন হলো জনগণের সেই চাওয়া কীভাবে নির্ধারিত হবে। একটি অবাধ ও সুষ্ঠু ভোটের মাধ্যমে, যেখানে ভোটাররা অবাধে তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন। নূরুল হুদা কমিশন মার্কা ভোট নয়।

আমাদের রাজনৈতিক সমস্যার শুরু ও শেষ এখানেই।

সপ্তম অনুচ্ছেদের দ্বিতীয় উপধারায় বলা আছে, সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন। এর বাইরে যাওয়া যাবে না। অতীতে যারা ক্ষমতায় ছিল এবং বর্তমানে ক্ষমতায় আছে, তারা বুকে হাত দিয়ে বলুক সংবিধানে স্বীকৃত নাগরিকের মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন হয় এমন আইন তারা করেনি। আইন সময়নিরপেক্ষ। একসময়ের কালো আইন অন্য সময়ে ভালো আইনে রূপ নিতে পারে না।

বিএনপির আমলে প্রণীত আইসিটি আইনের তীব্র বিরোধিতা করেছিল আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য বিরোধী দল। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সেই আইনকে আরও পাকাপোক্ত করা হয়েছে। এরপর আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে দেখলাম, তথ্য অধিকার আইনে নাগরিকদের যেটুকু অধিকার দেওয়া হয়েছিল, ২০১৮ সালে প্রণীত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তার কয়েক গুণ হরণ করা হয়েছে। বিএনপির আমলে অপারেশন ক্লিন হার্টে সংঘটিত বিচারবহির্ভূত হত্যার দায়মুক্তি দিয়ে আইন করেছিল বিএনপি সরকার। কিন্তু আওয়ামী লীগ আমলে গত ১৩ বছরে কি সেই বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ হয়েছে? হয়নি বলেই যুক্তরাষ্ট্র র‌্যাবের সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। হয়নি বলেই সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সিনহা মো. রাশেদ খান, টেকনাফ পৌরসভার কাউন্সিলর একরামুল হকসহ বহু মানুষকে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’-জীবন দিতে হয়েছে। এসব বন্দুকযুদ্ধের গল্প মোটামুটি এক। এখন যদি কেউ বিচারবহির্ভূত হত্যা বা গুমের সমালোচনা করে, সেটি কি দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হবে, না সরকারের ন্যায্য সমালোচনা? নানা মহলের চাপে সিনহা হত্যার দায়ে টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও তাঁর সহযোগী লিয়াকতের ফাঁসির আদেশ হয়েছে। কিন্তু তাঁর সময়ে টেকনাফে মাদকবিরোধী অভিযানের নামে যে আরও ১৪৩ জন ‘বন্দুকযুদ্ধে’ খুন হলো, তার বিচার কবে হবে, কে করবে?

আরও পড়ুন

আওয়ামী লীগের নেতা-মন্ত্রীদের কথাবার্তা স্ববিরোধী। তাঁরা একদিকে বলছেন বিএনপি দেশের জনগণ দ্বারা পরিত্যক্ত এবং মৌলবাদী ও জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে আন্তর্জাতিক মহলে বন্ধুহীন। অন্যদিকে তাঁরা দাবি করেন, বিএনপির অপপ্রচারের কারণে র‍্যাবের সাবেক ও বর্তমান সাত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা এসেছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনিক ব্যবস্থা সম্পর্কে যাঁদের ন্যূনতম ধারণা আছে, তাঁরা এ ধরনের কথা বলতে পারেন না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ও গবেষক ড. আলী রীয়াজ সম্প্রতি প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, কোনো দল বা ব্যক্তি অভিযোগ করলেই যুক্তরাষ্ট্র যেমন কারও প্রতি নিষেধাজ্ঞা জারি করে না, তেমনি কোটি কোটি টাকা দিয়ে লবিস্ট নিয়োগ করলেই সিদ্ধান্ত বাতিল হয়ে যাবে, এমন নয়।

মাঠে-মঞ্চে নেতা-নেত্রীদের বক্তব্য-বিবৃতিতে যত ফারাকই থাকুক না কেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শাসনপদ্ধতিতে বড় রকমের ফারাক নেই। তারা মুখে যত বিরোধিতা করুক শাসনপদ্ধতিতে একে অপরকে কঠোরভাবে অনুসরণ করে চলে। বিএনপি সরকার দেশ শাসনে জনগণের মতামতের ওপর নির্ভর না করে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপরই নির্ভর করেছিল। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তার পরিবর্তন হয়নি। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে মাত্রা বেড়েছে।

আমরা নিজেদের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলে দাবি করি। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকার তার বক্তব্য নিয়ে জনগণের কাছে যাবে, জনগণের কাছে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তার বাস্তবায়নের অগ্রগতি সম্পর্কে বলবে। সরকারের কোনো কর্মসূচি এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাধা থাকলেও তা-ও জনগণকে জানাবে। আবার বিরোধী দলের পক্ষ থেকেও তাদের অভিযোগ যেমন সরকারের দমনপীড়ন, মামলা–হয়রানি সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করবে, তাদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা তুলে ধরবে। এটাই গণতান্ত্রিক রীতি। উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোয় ক্ষমতাসীনেরা নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের সমালোচনাকে আমলে নিয়ে নিজেকে শোধরানোর চেষ্টা করে। কিন্তু আমাদের দেশে সরকার সমালোচনা একেবারে সহ্য করে না। তাদের কাছে সমালোচনা মানে ষড়যন্ত্র।

যখন দেশের জনগণের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয়, তখনই সরকারকে বিরোধী দলের ‘অপপ্রচার’ বন্ধ করতে বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ করতে হয়। দুই বছর আগে থেকে নির্বাচন নিয়ে যে ক্ষমতাসীনদের ভয়, তা–ও জনগণের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হওয়ার কারণে। সরকার ও বিরোধী দল উভয়ই জনগণের নামে রাজনীতি করে, কিন্তু জনগণের পক্ষে কথা বলার জন্য তাদের কোনো লবিস্ট নেই। তারা জনগণের ওপর ভরসা করে না। ভরসা করে বিদেশিদের ওপর।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

[email protected]