
বলা হয়ে থাকে, ‘প্রেম’ ও ‘যুদ্ধ’ মানুষকে কিছুটা অন্ধ করে দেয়। এখানে যুক্তি নয়, আবেগ ও উন্মাদনার রাজত্ব। আমাদের দেশে এ রকম আর একটি অন্ধত্বের অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘নির্বাচন’, বিশেষত জাতীয় সংসদ নির্বাচন। দেশ ও সমাজের সকল প্রকার ও প্রকৃতির অনুষ্ঠান-প্রতিষ্ঠান, সরকার, রাজনীতি, অর্থনীতি, উন্নয়ন, প্রশাসনসহ সবকিছু দেখার ও বোঝার এখন একটিই চশমা—নির্বাচন।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থায় নির্বাচনের গুরুত্বকে অস্বীকারের কোনো উপায় নেই। কিন্তু তা শুধু একটি জাতীয় নির্বাচনে সীমাবদ্ধ হয়ে থাকবে, তা-ও শোভন ও সংগত কোনোটাই নয়। একটি দেশে গণতন্ত্রের জন্য শুধু একটি প্রতিষ্ঠান ও তার যেনতেন একটি নির্বাচনই যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন বিভিন্ন পর্যায় ও স্তরে আরও অনেক সহায়ক প্রতিষ্ঠান এবং আরও অনেক অনুরূপ নির্বাচন।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলো সেই রূপ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান হিসেবেই স্বীকৃত। ২০১৩ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে এ দেশেও সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা, ইউনিয়ন ও জেলা পরিষদসমূহের নির্বাচন হয়েছে। নির্বাচনসমূহ নিয়ে অভিযোগ বিস্তর, কিন্তু নির্বাচনের পর ওই প্রতিষ্ঠানগুলো আদৌ কার্যকর কি না, সে বিষয়ে কেউ খুব একটা মাথা ঘামায় না। অন্যদিকে স্থানীয় সরকার ও শাসনব্যবস্থার আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন মেয়াদোত্তীর্ণ শুধু নয়, তামাদি হয়ে যাচ্ছে বা গেছে, সে বিষয়টি আজ পুরো জাতি প্রায় বিস্মৃত। কেউ কোথাও এ নিয়ে উচ্চবাচ্য করছে না যে ‘বড় নির্বাচন’, অর্থাৎ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আমাদের অন্য সব ‘ছোট নির্বাচন’-এর বিষয় পুরোপুরি ভুলিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। এই রচনায় সে রকম তিনটি নির্বাচন বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।
উপজেলা পরিষদের সংরক্ষিত নারী আসনের নির্বাচন ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরপরই অনুষ্ঠিত হয় চতুর্থ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। তার আগে ২০০৯ সালে তৃতীয় উপজেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। উপজেলা পরিষদ আইন ১৯৯৮, যা ২০১১ সালে সংশোধিত হয়, সে অনুযায়ী {ধারা ৬(ঙ) এবং ৬(৪)} মোট সদস্যের এক-তৃতীয়াংশ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। উপজেলার অন্তর্ভুক্ত ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভার নারী সদস্য ও কাউন্সিলররা নিজেদের মধ্যে নির্বাচনের মাধ্যমে ওই আসনগুলো পূরণ করবেন। অনেক বিলম্বে ২০১৫ সালের ৩১ মে প্রথমবারের মতো উপজেলা পরিষদের সংরক্ষিত নারী আসনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনের ছয় মাসের মাথায় ওই নির্বাচন অকার্যকর হয়ে পড়ে। কারণ, ছয় মাসের মধ্যে ইউনিয়ন পরিষদের মেয়াদ শেষে নতুন নির্বাচনের সময় হয়ে যায়।
আশা করা হয়েছিল, ২০১৬ সালের এপ্রিল-মে-জুন মাসে ইউপি নির্বাচন শেষে পুনরায় উপজেলা পরিষদের সংরক্ষিত নারী আসনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ২০১৭ সাল শেষ হতে চলল, এই নির্বাচন নিয়ে কোথাও কোনো আলোচনা নেই। এটি যেন একটি ভুলে যাওয়া বিষয়। এই নির্বাচন না হওয়ার কারণে স্থানীয় সরকারের একটি স্তরে নারীদের সাংবিধানিক অধিকার নিঃসন্দেহে ক্ষুণ্ন হচ্ছে। অবিলম্বে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত। এটি কোনো জটিল ও ব্যয়বহুল নির্বাচন নয়। প্রতিটি উপজেলায় নির্বাচন কর্মকর্তা ও ইউএনওরা এ নির্বাচন সম্পন্ন করে নিতে পারেন। তবে উদ্যোগটা নিতে হবে স্থানীয় সরকার বিভাগকে। নির্বাচন কমিশন স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে এই নির্বাচন করতে পারে না। স্থানীয় সরকার বিভাগের এই উদাসীনতা ক্ষমাযোগ্য নয়। অন্যদিকে দেশের নারী অধিকার সংগঠন ও কর্মীদের নীরবতাও সমানভাবে নিন্দনীয়। আশা করি, সবার উদাসীনতা ও নীরবতার অবসান হবে এবং উপজেলা পরিষদে নারীর সাংবিধানিক অধিকার তারা ফিরে পাবে।
পার্বত্য জেলা পরিষদ নির্বাচন-দ্বিতীয় পর্যায়ে দেখা যাচ্ছে যে আরও দুটি নির্বাচন যথাক্রমে তিন ও দুই দশক ধরে বন্ধ আছে। এ নিয়েও কোথাও কোনো উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নেই। এ দুটি নির্বাচন হচ্ছে যথাক্রমে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলার (রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান) জেলা পরিষদ নির্বাচন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ নির্বাচন। ১৯৮৯ সালের আইন অনুসারে জেলা পরিষদ গঠিত হওয়ার পর একটিবার শুধু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ওই একই বছর। তারপর থেকে যারাই যখন কেন্দ্রে সরকার গঠন করেছে, তারা নিজ দলের লোক দিয়ে নির্বাচনকে পাশ কাটিয়ে ওই জেলা পরিষদ চালিয়ে যাচ্ছে। তিনটি পার্বত্য জেলা পরিষদের তিনটি পৃথক আইন রয়েছে এবং ওই আইনে সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে চেয়ারম্যান ও সদস্য নির্বাচনের বিধান রয়েছে। চেয়ারম্যান অবশ্যই সংশ্লিষ্ট জেলার ‘উপজাতি’ গোষ্ঠীর সদস্যদের মধ্য থেকেই নির্বাচিত হবেন। সদস্যদের মধ্যে ‘উপজাতি’ ও ‘অ-উপজাতি’ দুই ধরনের সদস্য থাকবে এবং প্রতিটি জেলার ‘উপজাতি’ ও ‘অ-উপজাতি’ সদস্যের সংখ্যা আইনে সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া আছে। যেমন রাঙামাটি জেলা পরিষদে মোট সদস্য হবেন ৩০ জন। তার মধ্যে ‘অ-উপজাতি’ (বাঙালি) ১০ এবং ‘উপজাতি’ ২০ জন। ‘উপজাতি’ গোষ্ঠীর বিন্যাস হবে নিম্নরূপ: চাকমা (১০), মারমা (৪), তঞ্চঙ্গ্যা (২), ত্রিপুরা (১), লুসাই (১), পাংখু (১) ও খেয়াং (১)।
পাহাড়ি জেলা পরিষদগুলো সমতলের তুলনায় অনেক ক্ষমতাশালী। অর্থ-সম্পদের বরাদ্দও অনেক গুণ বেশি, কিন্তু গণতান্ত্রিক জবাবদিহির ব্যবস্থা খুবই ভঙ্গুর ও নাজুক। অনির্বাচিত চেয়ারম্যানরা উপমন্ত্রীর মর্যাদা ভোগ করেন। তিন জেলাতেই নির্বাচিত উপজেলা পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভাসমূহ রয়েছে। সব নির্বাচিত পরিষদের ওপর অনির্বাচিত জেলা পরিষদের কর্তৃত্ব। কারণ, জেলা পরিষদ আইন সেভাবেই পাস করা হয়। এখন তো নতুন আঙ্গিকে উপজেলা পরিষদ হয়েছে, কিন্তু আইনের অসামঞ্জস্য রয়েই গেছে।
তিন দশক ধরে আইনে পরিষ্কার বিধান থাকা সত্ত্বেও পাহাড়ে তিন জেলা পরিষদকে অ-নির্বাচিতদের করায়ত্তে রেখে দেওয়ার রহস্য কী? পার্বত্য জেলার রাজনৈতিক দল ও নেতা, বিশেষ মন্ত্রণালয়, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের বিষয়ে যাঁরা কথা বলেন, কেউই এ বিষয়ে মুখ খোলেন না, এটিও আরেক রহস্য। আশা করি, এসব রহস্যের জট খুলবে এবং সংশ্লিষ্ট সবাই পাহাড়ের তিনটি জেলা পরিষদের গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের ব্যাপারে সোচ্চার হবেন।
সবশেষে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ’-এর নির্বাচন, যা আইন প্রণয়নের দুই দশক পরও অনুষ্ঠিত হলো না, সে বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করব। পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের পর (২৪ মে, ১৯৯৮) আঞ্চলিক পরিষদের আইন গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। পার্বত্য চুক্তির একটি পক্ষ শান্তিবাহিনীর নেতা বাবু জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমাকে আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান নিয়োগ করা হয়। সেই থেকে সুদীর্ঘ দুই দশক তিনি বিনা নির্বাচনে সেই পরিষদের চেয়ারম্যান এবং চেয়ারম্যান হিসেবে প্রতিমন্ত্রীর সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে যাচ্ছেন।
আঞ্চলিক পরিষদ আইন অনুযায়ী ওই পরিষদে ২৫ জন সদস্য নির্বাচিত হওয়ার কথা। সদস্যদের মধ্যে উপজাতীয় ও অ-উপজাতীয় উভয় শ্রেণির সদস্য থাকার বিধান রয়েছে। তা ছাড়া উপজাতীয়, অ-উপজাতীয় মিলে তিনজন নারী, তিন জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং একজন সরকারি প্রতিনিধি থাকার বিধান রয়েছে। প্রতিবছর এক-দুবার আদিবাসী দিবস বা অন্য কোনো উপলক্ষ এলে ‘শান্তি চুক্তি’ বাস্তবায়নের দাবির কথা শোনা যায়, কিন্তু জেলা বা আঞ্চলিক পরিষদকে গণতান্ত্রিক ও আইনসংগতভাবে পুনর্গঠনের কোনো দাবি কোথাও ওঠে না।
দেশে জাতীয় ও বিভিন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনের দামামা বেজে উঠেছে। এই ফাঁকে বিস্মৃতপ্রায় তিনটি তামাদি নির্বাচনের বিষয়ে জাতির দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলাম। আশা করি, সরকার, সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষ, নাগরিক সমাজ এ বিষয়ে সোচ্চার হবে। শুধু জাতীয় নির্বাচন নিয়ে অন্ধ না হয়ে ছোট-বড় সব নির্বাচন সময়মতো করার ব্যাপারে সবাই সচেতন হবে।
ড. তোফায়েল আহমেদ: অধ্যাপক ও সুশাসনবিষয়ক গবেষক।
tofail101@gmail.com