গ্রহণযোগ্য নির্বাচনই সব অস্বস্তি এড়াতে পারে

নির্বাচন শব্দটির আগে কোনো বিশেষণ সাধারণত আমি প্রয়োগ করি না। কেননা এটি একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ শব্দ। এর অর্থ, যেকোনো বৈধ দল বা মতের লোক নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন। ভোটাররা পাবেন তাঁদের পছন্দসই ব্যক্তিকে ভোট দেওয়ার সুযোগ। প্রার্থী ও তাঁর কর্মী-সমর্থকেরা আইন ও বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে পাবেন প্রচার-প্রচারণার সুযোগ। ভোটাররা তাঁদের অধিকার প্রয়োগে অবারিত সুযোগের পাশাপাশি নির্বাচনের আগে, নির্বাচনকালীন ও এর পরে থাকবেন নিরাপদ। এ সবকিছু মিলিয়েই নির্বাচনব্যবস্থা পরিচালিত হয়। যেসব দেশ এটা অব্যাহতভাবে চর্চা করে যাচ্ছে, তারা এর ভিন্নটা ভাবতে পারে না। আর এ সবকিছু মিলিয়েই একটি নির্বাচন দেশ ও বিদেশে পায় গ্রহণযোগ্যতা। ক্ষেত্রবিশেষে আমাদের দেশে এ ধরনের নির্বাচনের পরও মন্দ রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্য পরাজিত দল ক্ষীণ কণ্ঠে হলেও কারচুপির অভিযোগ করে। তবে পানি পায় না হালে। তাই নির্বাচন শব্দটির আগে গ্রহণযোগ্য বিশেষণ যুক্ত করার পেছনে রয়েছে আমাদের অর্ধশতকের বিভিন্ন ধরনের নির্বাচন দেখার অভিজ্ঞতা।

আমরা দেখেছি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন চারবার অনুষ্ঠিত ও ফলাফল ব্যাপকভাবে সমাদৃত নির্বাচন। তেমনি দেখেছি ভোটারবিহীন নির্বাচন। আবার কোনো নির্বাচনে দেখেছি অধিকাংশ আসনে একজন মাত্র প্রার্থী। পেশিশক্তির বলে ভোট ছিনিয়ে নেওয়ার নির্বাচনও দেখতে হয়েছে আমাদের। আবার ইদানীং দেখছি কোনো কোনো প্রার্থী বা তাঁর কর্মীদের ওপর নির্বাচনী প্রচারণা শুরুর পর পরই দৃশ্যমান হয়রানি এবং ক্ষেত্রবিশেষে এলাকা ছাড়া করা। সভা-সমাবেশের বিধিসম্মত অধিকারও সংকুচিত করতে দেখা যাচ্ছে। এর অন্যথা কেউ করলে ঝুলতে হয় মামলায়। এ কারণে ভোটের দিন সরকারবিরোধী প্রার্থী ভোটকেন্দ্রে এজেন্টই দিতে পারেন না, এটাও দেখছি। জোরদারভাবে শুনেছি মধ্যরাতের নির্বাচনের কথা।

বলা অনাবশ্যক, এসব নির্বাচন সেই গ্রহণযোগ্যতা পায় না। আইনের আলোকে অবৈধ বলার সুযোগ আছে কি না, জানি না। তবে রাজনৈতিক বিবেচনায় অগ্রহণযোগ্য এ ধরনের নির্বাচন। এসব নির্বাচনের মাধ্যমে বিজয়ী প্রার্থীদের দ্বারা গঠিত সরকার কোনো প্রতিবাদ বা প্রতিরোধের মুখোমুখি না হতে পারে, তবে দুর্বল হয়ে পড়ে ক্ষমতার ভিত। তাঁদের নির্ভর করতে হয় মূলত সরকারের প্রশাসনযন্ত্র ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ওপর। জনগণের সঙ্গে সম্পর্কটা শিথিল হয়ে যায়।

দুই শতাধিক ছোট–বড় দেশ নিয়ে গঠিত এই বিশ্ব। আমরা আয়তনে খুব বড় না হলেও ১৮ কোটি লোকের বাসভূমি। অর্থনৈতিকভাবে ক্রমে উন্নতি করছি। প্রবৃদ্ধির হার ও বৈদেশিক মুদ্রার মজুত সন্তোষজনক। সামাজিক খাতেও ইতিবাচক পদক্ষেপ রয়েছে অনেক। বিশ্বসমাজে প্রশংসিত হচ্ছি এগুলোর জন্য। পাশাপাশি জাতীয় নির্বাচনব্যবস্থার সঙ্গে গত পরপর দুটো নির্বাচনে জনগণের সম্পৃক্ততা আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পাওয়া এবং রাষ্ট্রশক্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু সংস্থার নেতিবাচক আচরণও নজরে আসে অনেকের। ফলে বিশ্বসমাজে আমাদের মর্যাদা হ্রাস পাচ্ছে।

যেমন অতি সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত ১১০টি গণতান্ত্রিক দেশের শীর্ষ সম্মেলনে আমরা আমন্ত্রিত হইনি। এ বাছাইটা একেবারে পক্ষপাতহীন হয়েছে, এমনটা মনে হয় না। অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর তালিকায় পাকিস্তানসহ আরও কিছু দেশের নাম দেখে মনে হয় আমাদের আমন্ত্রিত হওয়া উচিত ছিল। সে ক্ষেত্রে আমাদের কূটনৈতিক প্রয়াসের দুর্বলতাকে দায়ী করব। ঠিক তেমনি পরপর দুটি গত জাতীয় নির্বাচন যেভাবে আমরা করেছি, তাতে আমাদের যারা হেয় করতে চায়, তাদের হাতে সুযোগ তুলে দেওয়া হয়েছে।

আমাদের স্বাধীনতার চেতনা ও সংবিধানের অঙ্গীকার অনুসারে মানবাধিকার সংরক্ষণের বিষয়ে সক্রিয় কেন হব না, এটা বোধগম্য নয়। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনও কেন করা যাবে না, এরও কৈফিয়ত নেই। এ ধরনের নির্বাচন হলে নির্বাচিত সরকার জনগণের অনেক কাছাকাছি আসবে। আন্তর্জাতিকভাবে বৃদ্ধি পাবে দেশের মর্যাদা।

যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের সমালোচক আছেন। তেমনি আছেন সমর্থক। রোহিঙ্গা সমস্যার দিকে তাকালেই সেটা স্পষ্ট হয়। আর বিশ্বের এ পরাশক্তিকে আমরা উপেক্ষা করতে পারব না। তাদের কাছ থেকেও বহুমুখী সম্পর্কের সুফল নিতে হবে আমাদের। যে বিষয়গুলো নিয়ে তাঁরা অভিযোগ আনছেন, সেগুলো নিয়ে আলোচনা না করা সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটাতে পারে। এটা আমাদের সরকার চায় না এবং আলোচনা করবে বলে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বক্তব্যে স্বস্তি লাভ করছি। অবশ্য দু-একজন বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমাদের গণতন্ত্র শিখতে হবে না। তাঁরা ভুলে যান, এ উপমহাদেশ আধুনিক গণতন্ত্রের দীক্ষা লাভ করেছিল ব্রিটিশ শাসনামলে ও অনেকটা তাদের প্রভাবে। আর যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি অনেক জোরালো।

এরপর আসছে আরেকটি স্পর্শকাতর বিষয়। কয়েক দিন আগে যুক্তরাষ্ট্র আমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ আইন প্রয়োগকারী সংস্থা র‌্যাব ও এর সাবেক ও বর্তমান কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপ করেছে। মূলত মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে এমনটা করা হয় বলে যুক্তরাষ্ট্রের বক্তব্যে দাবি করা হয়। বাংলাদেশ সরকার কূটনৈতিক সূত্রে সঙ্গে সঙ্গে এর তীব্র প্রতিবাদ করেছে। তবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে যাঁরা কাজ করেন বা করছেন, তাঁদের বিবেচনায় বিষয়টি আরও ঘনীভূত হওয়ার আগে মীমাংসার পথে যেতে হবে। এটা সত্য, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রেও ঘটছে।

ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলের আচরণ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তেমন সোচ্চার নয়। ভারতের কাশ্মীরি ও মাওবাদীদের ওপর সেখানকার আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অমানবিক আচরণ নিয়েও তাঁরা কোনো সাড়াশব্দ করছে না। তবে একসময়ে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী দীর্ঘকাল অবরোধের আওতায় ছিলেন। তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র তা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। অবশ্য এমন কিছু বলে ধরে নেওয়া যাবে না, যা আমাদের দেশে র‌্যাবসহ কতিপয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থা মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে না। তাদের বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের অভিযোগ গোপনীয় নয়। হতে পারে অপরাধী চক্রকে মোকাবিলা করতে গিয়ে কিছু ক্ষেত্রে এমনটা ঘটছে। তবে সব ক্ষেত্রেই তা হওয়ার কথা নয়।

অন্যদিকে র‌্যাবের বিরুদ্ধে সমালোচনার পাশাপাশি এটিও বলতে হবে যে জঙ্গি তৎপরতা দমনে তারা প্রশংসনীয় সাফল্য দেখিয়েছে। তাদের গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক অত্যন্ত কার্যকর এবং তা আরও জোরদার করা দরকার। তবে মানবাধিকার প্রসঙ্গটি পাশে ঠেলে নয়। অন্য রাষ্ট্র যেটা করে পার পায়, আমাদের ক্ষেত্রে এমনটা না-ও হতে পারে। অনেক ব্যাপারেই আমরা পাশ্চাত্যের ওপর নির্ভরশীল। জাতিসংঘের নিয়মনীতিও অনেকটা তারাই চালায়।

আমাদের পোশাকশিল্পের মূল বাজারও উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপনির্ভর। এ বিষয় নিয়ে আগাম আশঙ্কা করা অসমীচীন হবে না। কেননা অন্য দেশের ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি যুক্তরাষ্ট্র ধীরে ধীরে অবরোধের মাত্রা ও পরিসর বাড়ায়। তদুপরি রোহিঙ্গাদের মানবিক সাহায্য ও নৈতিক অবস্থান অনেকটা পাশ্চাত্যনির্ভর। হাল আমলে যুক্তরাষ্ট্র একক শক্তি হিসেবে না থাকলেও আমাদের ভালো বা মন্দ করার সুযোগ রাখে ব্যাপকভাবে। তাদের প্রতিপক্ষ চীনকে আমরা অবকাঠামো নির্মাণে আর্থিক সহায়তার জন্য পেলেও রোহিঙ্গা সমস্যার ক্ষেত্রে পাইনি। তেমনি অবস্থান ভারতের। তাই সবার সঙ্গে বন্ধুত্বের নীতিটি আমাদের থাকবে। পাশাপাশি অবসান করা দরকার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে হাল আমলের ভুল–বোঝাবুঝি।

দৃশ্যত যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অনুপস্থিতির বিষয়টি বড় করে তুলে ধরছে। এ বিষয়ে এখনো সোচ্চার না হলেও ধরে নেওয়া যায় ইউরোপ তাদের সঙ্গে আছে। অন্যদিকে আমাদের স্বাধীনতার চেতনা ও সংবিধানের অঙ্গীকার অনুসারে মানবাধিকার সংরক্ষণের বিষয়ে সক্রিয় কেন হব না, এটা বোধগম্য নয়। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনও কেন করা যাবে না, এরও কৈফিয়ত নেই। এ ধরনের নির্বাচন হলে নির্বাচিত সরকার জনগণের অনেক কাছাকাছি আসবে। আন্তর্জাতিকভাবে বৃদ্ধি পাবে দেশের মর্যাদা।

আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো ও এর কর্মকর্তারা রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এগুলো উত্তরোত্তর জোরদার হোক, এর কর্মকর্তারা হোক অধিকতর দক্ষ ও কুশলী, এটা সবাই চান। তবে সংবিধানস্বীকৃত মানবাধিকার তাঁদের বিবেচনায় রাখতে হবে। এসব বিষয় নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যে ভুল-বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে, তার অবসান আবশ্যক। আর সেটা করতে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন বড় রকমের ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে।

  • আলী ইমাম মজুমদার সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব

    [email protected]