২০১৯ সালের আগস্টে ঘুরতে গিয়েছিলাম ভারতের মেঘালয়। সাজানো-গোছানো ছিমছাম রাজ্যটি দেখে যে কেউ মুগ্ধ হবেন। আমিও হয়েছি। চেরাপুঞ্জি আর শিলংয়ের যে বিষয়টি আমাকে মুগ্ধ করেছে তা হলো, পুরো শহরে কিছুক্ষণ পরপর রয়েছে গণশৌচাগার। টাকার বিনিময়ে যেকোনো পর্যটক এই শৌচাগার ব্যবহার করতে পারবেন। দেখে অবাক হয়েছি, একেবারে ফাঁকা পাহাড়ি বাঁকে যে শৌচাগারটি রয়েছে, সেটিকেও একজন রক্ষণাবেক্ষণ করছেন। অনেকেরই মনে হতে পারে, গণশৌচাগার দেখে মুগ্ধ হওয়ার কী আছে? কেন আমি মুগ্ধ, সেই কথা বলি।
এই যে আমাদের কোটি মানুষের শহর ঢাকা। লেখাপড়া, ব্যবসা-বাণিজ্য, কাজের কারণে প্রতিদিন লাখ লাখ নারী, পুরুষ, শিশু, অসুস্থ, প্রসূতি ঘরের-বাইরে বের হচ্ছেন। এই শহরে সারা দিন কাজের প্রয়োজনে যে সংখ্যক মানুষ প্রতিদিন আসা-যাওয়া করে, রাস্তাঘাটে চলাচল করে, তাদের জন্য কি পর্যাপ্ত শৌচাগারের ব্যবস্থা আছে? চোখ বন্ধ করে বলা যায়, পর্যাপ্ত গণশৌচাগার নেই এই শহরে। বিশেষ করে নারীদের ব্যবহারোপযোগী গণশৌচাগার এ দেশের যেকোনো শহরে একদম অপ্রতুল। আমরা কেন যেন এই অতি জরুরি স্থাপনার কথা ভুলে যাই। যেন এই স্থাপনা ব্যবহার করার প্রয়োজন মানুষের হয় না বা হলেও তা বলতে নেই। যেন এটি খুব লজ্জার বিষয়। অথচ লজ্জার বিষয় হওয়া উচিত ছিল রাস্তার পাশে শত শত লোকের মাঝে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়া।
এই যে ঢাকা শহরের অন্যতম সুন্দর এলাকা হাতিরঝিল, সেখানে ঘুরতে আসা নারী দর্শনার্থীদের জন্য যথেষ্ট গণশৌচাগার আছে? এই যে আমাদের দেশের দর্শনীয় স্থানগুলো আছে, সেখানে কি পর্যটক তথা নারীদের জন্য যথেষ্ট শৌচাগারের ব্যবস্থা আছে? ঢাকা শহরের চিড়িয়াখানার কথাই ধরে নিই। কোন প্রান্তে শৌচাগার আছে তা খুঁজে বের করতে একজন নতুন দর্শনার্থীর কষ্ট হবে। আর যদিও-বা ভাগ্যক্রমে তিনি তা খুঁজেও পান, সেই শৌচাগার ব্যবহারের উপযোগী হবে কি না, সেই প্রশ্নও থেকে যাচ্ছে। অথচ এসব শৌচাগার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বেতনভুক্ত কর্মচারী আছেন।
শুধু কি এই রাজধানীতেই গণশৌচাগার প্রয়োজন? বাকি শহরগুলোর কি দরকার নেই? বাংলাদেশ তথা বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত। এখানেও কি পর্যাপ্ত গণশৌচাগার আছে? লাবণী পয়েন্ট থেকে হিমছড়ি বা ইনানী বিচে যাওয়ার পথে কোনো নারী পর্যটকের শৌচাগারে যাওয়ার প্রয়োজন হলে সেই ব্যবস্থা নেই। এমনকি নারী পর্যটকেরা সমুদ্রস্নানের পর ভেজা কাপড় বদলাতে চাইলেও ভেজা কাপড় নিয়ে সেই হোটেল পর্যন্ত যেতে হয়। কেন যেন এই বিষয়গুলোর দিকে আমাদের গরজ কম, দরদ কম, দৃষ্টি কম, গুরুত্ব কম।
একটা প্রবাদ আছে, একটা দেশ ততটা উন্নত, সে দেশের গণশৌচাগার যতটা উন্নত। এমনটা ভাবার কারণ নেই যে আমাদের দেশে গণশৌচাগার, আমাদের দেশেও কিন্তু গণশৌচাগার আছে। আমাদের এই প্রিয় ঢাকা শহরের উত্তর অংশে ২৫টি এবং দক্ষিণ অংশে ৭৫টি গণশৌচাগার আছে। পুরান ঢাকার বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য গণশৌচাগার আছে মাত্র ৩৭ টি। এর মধ্যে ২৯টি নতুন ও ৮টি পুরোনো। (সূত্র যমুনা টিভি অনলাইন, ২৯ জানুয়ারি, ২০২০)। ২০১৮ সালের এক সমীক্ষা অনুযায়ী, ঢাকায় নারীদের জন্য আধুনিক গণশৌচাগার মাত্র ২৬ টি। চলাফেরার পথে যে কটি গণশৌচাগার দেখা যায়, তা বেশির ভাগই ব্যবহারের অনুপযোগী। কোনোটির দরজা নেই, দরজা থাকলে ছিটকিনি নেই, অন্ধকার, দুর্গন্ধযুক্ত, ভাঙা কমোড, ময়লা পানি আর পোকামাকড়ের ঘরবসতির কথা না হয় না-ই বলা হলো। সর্বসাধারণের জন্য যে কটি শৌচাগার আছে, সেখানে পুরুষদের যাওয়াটাই একটি যুদ্ধের শামিল, সেখানে নারীদের কথা তো চিন্তাই করা যায় না। অথচ একটি দেশের সব স্থানে পর্যাপ্ত পরিমাণ পরিচ্ছন্ন গণশৌচাগার থাকা একটি জরুরি বিষয়। কারণ, জনস্বাস্থ্য, লিঙ্গসমতা, নারীস্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা এবং শহরের সৌন্দর্য রক্ষার জন্যও গণশৌচাগার জরুরি।
আমাদের দেশ মধ্যম আয়ের দেশ হতে যাচ্ছে, দেশের রাস্তায় ছুটবে মেট্রোরেল, প্রবল পদ্মার বুক চিরে মাথা তুলে দাঁড়ানো দ্বিতল পদ্মা সেতুর ওপরের চার লেনে চলবে যানবাহন আর নিচের লেনে ছুটবে রেলগাড়ি। অথচ দেশের ভাসমান মানুষ যারা ফুটপাতে থাকে বা শহরে বিভিন্ন কাজের জন্য আসে, তারা পর্যাপ্ত শৌচাগারের অভাবে রাস্তায় মলমূত্র ত্যাগ করবে। রাস্তায় নাকে কাপড় গুঁজে চলতে হবে, চোখ বুজে চলতে হবে। গণশৌচাগার নিশ্চিত করা সিটি করপোরেশনের আইনি দায়িত্ব। সিটি করপোরেশন গণশৌচাগার করবে, তার রক্ষণাবেক্ষণ করবে, সঙ্গে সঙ্গে আমাদেরও ভাসমান মানুষদের, রাস্তায় চলাচলকারীদের সচেতন করতে হবে। প্রকাশ্যে মলমূত্র ত্যাগ বন্ধে প্রয়োজনে আইনি জরিমানার ব্যবস্থা করতে হবে। তবে তার আগে পর্যাপ্ত পরিচ্ছন্ন গণশৌচাগারের ব্যবস্থা করতে হবে।
জাতি হিসেবে আমরা উন্নয়নশীল দেশের সারিতে নাম লেখাচ্ছি, সেখানে আমাদের নাগরিকদের বিশেষ করে নারীদের স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রাখতে পারি না। এ শহরে বস্তি এলাকায় লাখো মানুষের বসবাস। সবশেষ শুমারিতে দেখা যায়, বস্তিবাসীর প্রায় ৪২ শতাংশ মানুষ অস্বাস্থ্যকর শৌচাগার ব্যবহার করছে (সূত্র দৈনিক যুগান্তর, ১৯ নভেম্বর ২০১৮)। অধিকাংশ বস্তিতে পুরুষ ও নারীদের আলাদা শৌচাগারের ব্যবস্থা নেই, থাকলেও তা পাশাপাশি। পুরুষদের চোখ এড়িয়ে শৌচাগার ব্যবহার করা অনেকের জন্যই কঠিন হয়ে পড়ে, ফলে অনেকেই প্রয়োজনের সময় শৌচাগার ব্যবহার করতে পারেন না। ঢাকার প্রায় ৮৫ ভাগ নারী যাঁরা বিভিন্ন কারণে নিয়মিত বাইরে যান, কেবল স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগারের অভাবে তাঁরা পানি কম পান করেন। ফলে নানা রকম স্থায়ী ও অস্থায়ী রোগে ভুগছেন এই শহরের অধিকাংশ নারী।
এত অপ্রতুলতার মধ্যেও আশার কথা হলো, বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে নারীবান্ধব গণশৌচাগার নির্মাণের প্রকল্প হাতে নিয়েছে আমাদের দুই সিটি করপোরেশন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আশাবাদী, এই প্রকল্পের সব কাজ শেষ হলে এই সংকটের অবসান হবে। নারীরা স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকলে দেশ হিসেবে, জাতি হিসেবে কত দূরই বা এগোনো যাবে। পিছিয়ে যাব আমরা। পিছিয়ে যাবে দেশ। তাই দায়িত্ব নিয়ে, বাস্তবতা মেনে নিয়ে অনেক কিছুতেই পরিবর্তন আনতে হবে।
একটি সভ্য জাতির মেরুদণ্ড হচ্ছে তাদের পয়োনিষ্কাশনের সুব্যবস্থা। জাতি হিসেবে সভ্য হতে হলে আমাদের মানসিক পরিবর্তনও আনতে হবে। পরিচ্ছন্ন শৌচাগার ব্যবহারে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। নারীদের জন্য নারীবান্ধব শৌচাগার তৈরি করতে হবে। ঢাকা শহরসহ বিভিন্ন শহর ও বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্রে পরিচ্ছন্ন শৌচাগার সুনিশ্চিত করতে হবে। সভ্য জাতি হিসেবে শুধু শহরের কাঠামো নয়, অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে, সঙ্গে সঙ্গে জনগণের মৌলিক সুবিধাও নিশ্চিত করতে হবে। এই কাজ বা দায়িত্ব শুধু সরকার বা সিটি করপোরেশন নয়, নাগরিক হিসেবে আমাদের সবার।
মাহবুবা সুলতানা প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়ক