গণতন্ত্র অর্থ জনগণের শাসন। জনগণের প্রতিনিধির মাধ্যমে জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালিত হবে, সেটাই গণতন্ত্রের চর্চা। যেহেতু দেশের সব মানুষ একসঙ্গে দেশ পরিচালনা করতে পারবেন না, তাই শতভাগ গণতন্ত্র কোনো দিনই সম্ভব নয়। আবার সবার প্রত্যাশা এক হবে না। ফলে তা বাস্তবায়নও অসম্ভব। তবে যত বেশিসংখ্যক মানুষ অনুভব করেন তাঁদের প্রতিনিধিরা তাঁদের ইচ্ছা বা অনিচ্ছার প্রতিফলন রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে করছেন, ততটুকু ভালো গণতন্ত্রের চর্চা হচ্ছে বলা যায়। সে হিসেবে দেশের সিংহভাগ মানুষের যদি ওই ধরনের উপলব্ধি হয় যে জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী জনপ্রতিনিধি শাসন করছেন, তাহলেই শুধু গ্রহণযোগ্যভাবে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চালু আছে বলা যায়। এর জন্য অবশ্যই জনগণের কাছে সরকারের সার্বক্ষণিক জবাবদিহি থাকা প্রয়োজন।
স্বাধীনতা অর্জনের সুবর্ণজয়ন্তীর পরও বলা যায়, সার্বিক বিবেচনায় স্বাধীনতার পর থেকে অদ্যাবধি বাংলাদেশে কোনো সময় গণতন্ত্রের চর্চা গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে ছিল না। এর প্রধান কারণ, আমাদের সংবিধান। সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে এবং বিভিন্নভাবে গণতন্ত্রের চর্চার বিষয়ে জোর দিয়ে বলা হয়েছে। কিন্তু সার্বিকভাবে সংবিধানের বিভিন্ন বিধানে গণতন্ত্রের চর্চার চেয়ে একনায়কতন্ত্রবাদকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন সংশোধনীর মাধ্যমে অনেক ধরনের পরিবর্তন আনা হলেও গণতন্ত্রচর্চার সুযোগ সৃষ্টির জন্য কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ক্ষমতায় আসীন হয়ে সরকার গণতন্ত্রের চর্চার সুযোগ সংকুচিত করেছে। গণতন্ত্রচর্চার সহায়ক প্রতিষ্ঠানগুলোকে পর্যায়ক্রমে দুর্বল থেকে দুর্বলতর করে প্রায় ধ্বংস করা হয়েছে।
সংবিধানের পঞ্চম ভাগের ৭০ অনুচ্ছেদ আইনসভা-সংক্রান্ত বিধানাবলিতে বর্ণিত বিধান বাতিল অথবা পরিবর্তন করে নমনীয় করা আবশ্যক। এখানে বর্ণিত আছে, ‘কোনো নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হইয়া কোনো ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদি—
(ক) উক্ত দল হইতে পদত্যাগ করেন, অথবা
(খ) সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন,
তাহা হইলে সংসদে তাঁহার আসন শূন্য হইবে, তবে তিনি সেই কারণে পরবর্তী কোনো নির্বাচনে সংসদ সদস্য হইবার অযোগ্য হইবেন না।’
বর্তমান বিধান অনুযায়ী সংসদ বা আইনসভা দলীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে (দলীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর মাধ্যমে মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়। সংসদে প্রস্তাব অনুমোদনে সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থন প্রয়োজন।) সম্পূর্ণভাবে নির্বাহী বিভাগ প্রধানের নিয়ন্ত্রণাধীন। এ কারণে সংসদে নির্বাহী বিভাগের বা সরকারের জবাবদিহির সুযোগ থাকে না। নির্বাহী বিভাগের প্রধান বা প্রধানমন্ত্রী যা চান ও যেভাবে চান, সংসদ সেভাবেই চলে। তাঁর ইচ্ছার বাইরে কোনো সিদ্ধান্ত হয় না।
এক ব্যক্তি অর্থাৎ নির্বাহী বিভাগের প্রধান বা প্রধানমন্ত্রী একই সঙ্গে নির্বাহী বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের জবাবদিহি নিশ্চিত করার জন্য নিয়োজিত ‘সংসদ’ এবং নির্বাহীসহ অন্য সব নাগরিকের মধ্যে আইনের শাসন নিশ্চিত করার জন্য ‘বিচার বিভাগ’ ও জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচনে ‘নির্বাচন কমিশন’ গঠন নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হলে, সেখানে গণতন্ত্রের চর্চা সম্ভব হয় না। সে পদ্ধতিকে সংজ্ঞা অনুসারে একনায়কতন্ত্র বলা হয়।
সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদও বাতিল করা প্রয়োজন। এ অনুচ্ছেদে অধস্তন আদালতকে রাষ্ট্রপতির নিয়ন্ত্রণাধীন করা হয়েছে, যা সংবিধানের ৪৮ অনুচ্ছেদের কারণে কার্যকরভাবে প্রধানমন্ত্রীর কর্তৃত্বাধীন। এখানে বর্ণিত আছে, ‘এই সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদের (৩) দফা অনুসারে কেবল প্রধানমন্ত্রী ও ৯৫ অনুচ্ছেদের (১) দফা অনুসারে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তাঁহার সকল দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করিবেন।’
তা ছাড়া ১১৬ অনুচ্ছেদ রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি বিভাগে বর্ণিত ২২ অনুচ্ছেদ [‘রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গসমূহ হইতে বিচার বিভাগের পৃথক্করণ রাষ্ট্র নিশ্চিত করিবেন’] এর পরিপন্থী।
৯৫(২) অনুচ্ছেদের (গ)-এ বর্ণিত আছে, ‘সুপ্রিম কোর্টের বিচারক পদে নিয়োগ লাভের জন্য আইনের দ্বারা নির্ধারিত যোগ্যতা না থাকিয়া থাকিলে; তিনি বিচারক পদে নিয়োগ লাভের যোগ্য হইবেন না।’
উল্লিখিত বিধানটি সংবিধানের ষষ্ঠ ভাগে বিচার বিভাগসংক্রান্ত প্রথম পরিচ্ছদ-সুপ্রিম কোর্ট বিষয়ে। এ-সংক্রান্ত আইনটি করা আবশ্যক এবং এর মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগে প্রধান বিচারপতি ও ঊর্ধ্বতন আদালতের প্রাধান্য থাকা জরুরি। অন্যথায় বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগের বিষয়টি সংবিধানের ৯৫, ৯৫(২), (ক) এবং (খ) এর কারণে নির্বাহী বিভাগ বা তৎ প্রধানের নিয়ন্ত্রণে থাকছে। সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদে আছে, ‘প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারকগণ রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হইবেন।’ তবে (২) কোন ব্যক্তি বাংলাদেশের নাগরিক না হইলে, এবং তিনি (ক) সুপ্রিম কোর্টে অন্যূন দশ বৎসর কাল অ্যাডভোকেট না থাকিয়া থাকিলে; অথবা (খ) বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে অন্যূন দশ বৎসর কোনো বিচার বিভাগীয় পদে অধিষ্ঠান না করিয়া থাকিলে, তিনি বিচারক পদে নিয়োগ লাভের যোগ্য হইবেন না।’
সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের বরখাস্ত করার ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে ছিল। পরবর্তী সময়ে সংবিধান সংশোধন করে এ ক্ষমতা সংসদে নেওয়া হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্টের এক রায়ে ওই সংশোধনী বাতিল করা হয়েছে। সরকার এ বিষয়ে পুনর্বিবেচনার জন্য আবেদন করেছে বলে জানা যায়। তবে এটা সংসদের হাতে পুনরায় অর্পিত হলে বর্তমান প্রেক্ষাপটে এ বিষয়েও সম্পূর্ণ সরকারপ্রধানের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
১১৮ অনুচ্ছেদ (১) বর্ণিত ‘আইনের বিধানাবলি সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগ দান করিবেন।’ সংবিধানের সপ্তম ভাগে বর্ণিত নির্বাচনসংক্রান্ত বিধানাবলিতে উল্লিখিত আইনটি প্রণয়ন করার যে বিধান আছে, তা বাস্তবায়ন করতে হবে। সে আইনে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন সংগঠিত করার জন্য উপযুক্ত ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠনের মাপকাঠি ও পথ থাকবে। আইনটি না থাকার কারণে রাষ্ট্রপতি শুধু প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ মোতাবেক নির্বাচন কমিশন গঠন করতে পারবেন। এককথায় বর্তমানে নির্বাচন কমিশন গঠনও প্রধানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণাধীন।
একই বিভাগের ১২৬ অনুচ্ছেদে বর্ণিত ‘নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সকল নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্ব হইবে;’—বিষয়টি কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের জন্য একটি আইন করা আবশ্যক। যে আইনে এ বিধানটি লঙ্ঘন শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে এবং কী ধরনের শাস্তি দেওয়া হবে, তার বিস্তারিত বর্ণনা থাকতে হবে। অন্যথায় নির্বাহী বিভাগের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ছাড়া এ বিধান অকার্যকর থাকবে। এককথায় পরোক্ষভাবে হলেও বর্তমানে এ বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর আওতার ভেতর।
এক ব্যক্তি অর্থাৎ নির্বাহী বিভাগের প্রধান বা প্রধানমন্ত্রী একই সঙ্গে নির্বাহী বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের জবাবদিহি নিশ্চিত করার জন্য নিয়োজিত ‘সংসদ’ এবং নির্বাহীসহ অন্য সব নাগরিকের মধ্যে আইনের শাসন নিশ্চিত করার জন্য ‘বিচার বিভাগ’ ও জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচনে ‘নির্বাচন কমিশন’ গঠন নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হলে, সেখানে গণতন্ত্রের চর্চা সম্ভব হয় না। সে পদ্ধতিকে সংজ্ঞা অনুসারে একনায়কতন্ত্র বলা হয়।
বর্তমানে আমাদের সংবিধানের মূলনীতির অন্যতম ‘গণতন্ত্র’ প্রস্তাবনায় এ বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে। তা ছাড়া আমাদের দেশের নামকরণ করা হয়েছে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’। স্বাধীনতাসংগ্রামসহ গণমানুষের সব আন্দোলন-সংগ্রামের মূল প্রেরণা ছিল গণতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সৃষ্টি। সে দেশের বর্তমান সংবিধানের অনেক বিধান এ ধ্যানধারণার পরিপন্থী। ফলে অনতিবিলম্বে বর্তমান সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংশোধন, সংযোজন ও সহায়ক আইন প্রণয়ন অত্যাবশ্যক। উপরিউক্ত প্রস্তাব সে উদ্দেশ্যে দেওয়া হলো।
গোলাম মোহাম্মদ কাদের সাংসদ ও চেয়ারম্যান, জাতীয় পার্টি