অনেক সরকারি চাকরিতে বদলি একটি আবশ্যিক শর্ত। সে বদলি করতে হয় পদোন্নতি, নবসৃজিত পদ পূরণ, চাকরিরত স্থানে চাহিদা মেটাতে কারও অক্ষমতা, নতুন কোনো কর্মস্থলের বিশেষ চাহিদা ইত্যাদি কারণে। এ ছাড়া একই পদে থাকলেও প্রশাসন, বিচার বিভাগ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ বেশ কিছু ক্ষেত্রে সময়ান্তরে বদলি করা হয়। এর কারণ, একই কর্মক্ষেত্রে দীর্ঘদিন থাকলে ওই কর্মকর্তা–কর্মচারী কোনো স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে জড়িয়ে যেতে পারেন। এ ছাড়া জাতীয় পর্যায়ে মন্ত্রণালয় বা কর্মস্থল বদল করে উপরিউক্ত পরিস্থিতি এড়ানোর যুগবাহিত রেওয়াজ রয়েছে। তবে বিশেষ করে স্থানান্তরের বদলির ক্ষেত্রে কিছু একটা সময়সীমা মেনে চলা হয়। কেননা, এক স্থান থেকে অন্যত্র বদলি করলে তাঁর সংসারজীবন কিছুটা ওলটপালট হয়। নতুন জায়গায় সংসার পাতার ঝঞ্ঝাট অনেক। কিছুটা অতিরিক্ত অর্থের আবশ্যকতাও থাকে। অন্যদিকে ঝুঁকিতে থাকে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া।
এ ছাড়া সরকারের দিক থেকেও এখানে রয়েছে একটি ব্যয়সংশ্লেষ। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা–কর্মচারীর সপরিবার ভ্রমণ ভাতা ও নির্দিষ্ট পরিমাণ মালামালের পরিবহন খরচ দিতে হয় সরকারকে। সুতরাং অসময়োচিত বদলি অত্যাবশ্যক না হলে পরিহার করে চলা হয়। তার ওপর কোনো কর্মকর্তা যদি জনস্বার্থে ভালো কোনো উদ্যোগ নিতে গিয়ে প্রভাবশালী কোনো মহলের বিরাগভাজন হন, সে ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা চাইবে তাঁকে সেখান থেকে বদলি করাতে। বদলি প্রক্রিয়ার সঙ্গে যাঁরা সংশ্লিষ্ট থাকেন, তাঁদের উচিত সচেতন ও সক্রিয়ভাবে এ ধরনের বদলির প্রচেষ্টা ঠেকানো। কেননা, এর মধ্যেই সংশ্লিষ্ট রয়েছে সুশাসনের চাবিকাঠি। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা জনস্বার্থে নিয়োজিত। কিন্তু এরূপ জনস্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে কেউ কেউ প্রভাববলয়ের রোষানলে পড়েন। তখন যদি তাঁদের প্রতি বিরূপ আচরণ করা হয়, তবে এ ধরনের কর্মকর্তারা হতোদ্যম হবেন। ভবিষ্যতে ঝুঁকি নিতে থাকবেন দ্বিধান্বিত। শুধু তিনি নন। তাঁর পরিণতি জেনে অন্যরাও এ থেকে নেতিবাচক শিক্ষাই লাভ করবেন। আর তা হচ্ছে জনস্বার্থ বিসর্জন দিয়ে নিজের গা বাঁচিয়ে চলা।
একটি জেলায় ডেপুটি কমিশনার (ডিসি) পদের মেয়াদকাল সাধারণত তিন বছরের কাছাকাছি। জনস্বার্থে নিশ্চয়ই তাঁকে আগেও বদলি করা চলে। করা হয়ও। কিন্তু কোনো ডিসি কয়েকটি দুর্নীতির ঘটনার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গিয়ে মাত্র এক বছর তিন মাসের মাথায় এ ধরনের বদলির শিকার হলে অবশ্যই দুঃখজনক বলতে হবে। ধরে নেওয়া যৌক্তিক হবে, কার্যত তাঁকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। এমনটাই ঘটেছে চাঁদপুর থেকে সদ্য বদলির আজ্ঞাধীন ডিসির ক্ষেত্রে।
গত জানুয়ারি মাসে প্রথম আলোর এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে জানা যায়, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য ভূমি হুকুম দখল করতে প্রকৃত ক্ষতিপূরণের অধিক ৩৫৯ কোটি টাকা হাতিয়ে নিতে সক্রিয় ছিল একটি প্রভাবশালী মহল। ডিসি সেটি ঠেকিয়েছেন। একই প্রভাবশালী গোষ্ঠীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বেশ কিছুকাল মেশিন বসিয়ে জনপদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ স্থান থেকে কোটি কোটি টাকার বালু উত্তোলনের প্রকাশ্য ব্যবসায়ে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ডিসি ঊর্ধ্বতন মহলের সঙ্গে যোগাযোগ করে কিছু প্রতিবন্ধকতা অপসারণের মাধ্যমে বন্ধ করেন এ কার্যক্রম। সে প্রভাবশালী মহলটিরই কয়েকজন ভুয়া দলিলের মাধ্যমে সরকারের ৪৮ একরের বেশি খাসজমি দখল করে নিয়েছে। এ নিয়েও গত মার্চের শেষে প্রথম আলোতে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে ডিসি খাসজমি উদ্ধার ও ভুয়া খতিয়ান বাতিলের জন্য আইনানুগ প্রক্রিয়ায় অগ্রসর হন।
ডিসির এ কার্যকলাপ দুর্বৃত্ত চক্রটির পছন্দনীয় হতে পারে না। তারা একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর আপনজন ও দলীয় বলয়ের বলে সরকারি দলেই ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে। ডিসির কার্যক্রম যদি অসংগত ও আইনানুগ না হতো, তাহলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানানো যেত। তারা নিতে পারত আইনানুগ ব্যবস্থা। সে ডিসিকে নেত্রকোনায় ডিসি হিসেবে বদলি করা হয়েছে। তাহলে ধরে নিতে হয় তাঁর বিরুদ্ধে প্রকৃত কোনো অভিযোগ নেই। চাঁদপুরকে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর কণ্টকমুক্ত করতে একজন সাহসী কর্মকর্তাকে সরিয়ে নেওয়া হলো। এতে সবুজসংকেত পেল অপরাধী চক্র। আর লালসংকেত দেখতে পাচ্ছেন নির্ভীক জনসেবকেরা। কার্যত বদলি করা ডিসির অপরিণত সময়ে বদলিতে ভোগান্তি হবে। সরকারের হবে অনাবশ্যক ব্যয়।
অঞ্জনা খান মজলিশের এখন তো বদলি হওয়ার কথা ছিল না। আর এসব ব্যাপারে তাঁর গৃহীত পদক্ষেপের কোনোটিই তো চূড়ান্ত নয়। জাল দলিল বাতিলের মামলা দেওয়ানি আদালতে। সিদ্ধান্ত হবে আদালতের নির্দেশে। এখন এর জন্য সরকারের পক্ষে উদ্যোগ নেওয়া প্রধান কর্মকর্তাকে সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়ার ফলে স্বাভাবিকভাবে মামলাটি যথাযথ তদবির না হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এমনটা আকস্মিকভাবে চাঁদপুরের ডিসির ক্ষেত্রে ঘটল, তা নয়। প্রায়ই ঘটছে। তাই দিন দিন অনেকটাই অকার্যকর হয়ে পড়ছে প্রশাসনের বিভিন্ন অঙ্গ। মাত্র কয়েক দিন আগে বাংলাদেশ রেলের শফিকুল নামের একজন টিকিট এক্সামিনার বিনা টিকিটে ভ্রমণরত তিনজন যাত্রীকে জরিমানা করেন। সে যাত্রীরা রেলমন্ত্রীর আত্মীয় পরিচয় দিলেও ছাড় দেননি সাহসী শফিকুল। ধর ধর করে রাতেই টেলিফোন। আর রাতেই কর্মরত অবস্থাতেই সাময়িক বরখাস্ত হন তিনি। তৎপর গণমাধ্যমের ক্লান্তিহীন প্রচেষ্টায় গোটা চিত্র দেশবাসীর সামনে আসতে থাকে। অনেকটা গণধিক্কারের মুখে পিছু হটেন রেলমন্ত্রী। পুনর্বহাল হন শফিকুল। তবে সবাই শফিকুলের মতো ভাগ্যবান নন। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের বেশ কিছুসংখ্যক সৎ সাহস দেখাতে গিয়ে পদোন্নতিবঞ্চিত, তুচ্ছ কারণে বিভাগীয় মামলায় সাজাপ্রাপ্ত কিংবা ন্যূনপক্ষে ওএসডি হয়ে আছেন। চাঁদপুরের ডিসি অঞ্জনা খান মজলিশ বরং একদিক দিয়ে ভাগ্যবান যে তিনি আরও একটি জেলায় যাচ্ছেন ডিসি হিসেবেই। ধারণা করছি, স্বার্থান্বেষী মহলের বিরাগভাজন হওয়ার ভয়ে তিনি নিজেকে গুটিয়ে নেবেন না। ন্যায়-অন্যায়ের ফারাক তিনি ধরেছেন সঠিকভাবে। অব্যাহত রাখবেন তাঁর এ প্রচেষ্টা। আমরা তাঁর শুভকামনা করি।
তবে বিষয়টিতে সরকারের সঙ্গে যাঁরা সংশ্লিষ্ট রয়েছেন, তাঁদের জন্য নতুন ভাবনার খোরাক দিল। কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য হুকুম দখল করা জমির দাম বেআইনিভাবে বাড়িয়ে নেবে, জাল দলিল করে দখল নেবে খাসজমি, সরকারের যথোপযুক্ত অনুমতি ব্যতিরেকে ও রাজস্ব না দিয়ে নদী থেকে বালু উত্তোলন করে চলবে দিনের পর দিন, এমনটা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এ অনিয়ম ও অবিচার অবশ্য চলছে দেশের অনেক স্থানে। তবে কেউ কিছু প্রতিকারের উদ্যোগ নিলে তঁাকে দমিয়ে দিতে হবে, এমনটা সমর্থন করা যায় না। কিন্তু চাঁদপুরের ব্যাপারটা তো প্রকৃতপক্ষে তাই হয়ে গেল।
অঞ্জনা খান মজলিশের এখন তো বদলি হওয়ার কথা ছিল না। আর এসব ব্যাপারে তাঁর গৃহীত পদক্ষেপের কোনোটিই তো চূড়ান্ত নয়। জাল দলিল বাতিলের মামলা দেওয়ানি আদালতে। সিদ্ধান্ত হবে আদালতের নির্দেশে। এখন এর জন্য সরকারের পক্ষে উদ্যোগ নেওয়া প্রধান কর্মকর্তাকে সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়ার ফলে স্বাভাবিকভাবে মামলাটি যথাযথ তদবির না হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আর বাদীপক্ষের অনমনীয় উদ্যম ও উদ্যোগ না থাকলে এ মামলায় সরকারের প্রতিকার পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে যাবে। ভূমি হুকুম দখল মামলায় ডিসির ধার্যকৃত ক্ষতিপূরণই তো চূড়ান্ত নয়। আরবিট্রেশন আছে। আছে আইন-আদালত। কেউ মনে করলে সেখানে যাওয়ার রাস্তা তো খোলা। আর বালু উত্তোলনকারী চেয়ারম্যানকে আদালত কিংবা সরকার যথোপযুক্ত বিবেচনা করলে প্রতিকার দিতে পারে। ডিসির আদেশ তো এখানে কোনোটিই চূড়ান্ত নয়। সুতরাং তাঁকে একমাত্র পথের কাঁটা বিবেচনা করা অসংগত।
ক্ষমতার দাপটে অঞ্জনা খান মজলিশ চাঁদপুর থেকে চলে যাচ্ছেন। এমন অনেকে আসবেন ও যাবেন। তবে যে বিষয়গুলো অমীমাংসিত রয়ে গেল, তা হচ্ছে সরকার তার স্বার্থ রক্ষা করতে চায় কি না। একে জনস্বার্থ বলা হয়। অঞ্জনা খান মজলিশের বদলির আদেশে উল্লেখ রয়েছে, তাঁকে বদলি করা হয়েছে জনস্বার্থে। অথচ সব বিবেচনায় এ অসময়োচিত বদলিটি হয়েছে জনস্বার্থতত্ত্বের বিপরীতে। জনস্বার্থের যাঁরা রক্ষক, তাঁরা জলাঞ্জলি দিলেন এর মৌলিক বৈশিষ্ট্য। চাঁদপুরের হাল আমলের শাসনব্যবস্থাকে ভঙ্গুর করার দায় মূলত তাঁদের। অন্তত সেখানকার জনগণ তাই বিবেচনা করেন।
● আলী ইমাম মজুমদার সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব