বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচার হয়েছে ১১ বছর আগে। ছয় খুনির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। বিদেশে পলাতক ছয় ঘাতকের মধ্যে আজিজ পাশা মারা গেছেন। বাকি পাঁচজনের মধ্যে নূর চৌধুরী কানাডা ও রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে পলাতক। কিন্তু কর্নেল আবদুর রশীদ, শরিফুল হক ডালিম ও মোসলেহউদ্দিন কোথায় আছেন, নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। ভারতীয় গণমাধ্যমে খবর বের হয়েছিল, মোসলেহউদ্দিন সেখানে মারা গেছেন। তবে এর সমর্থনে নির্ভরযোগ্য তথ্য-প্রমাণ নেই।
বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের মধ্য দিয়ে এর দায় নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্কের অবসান হয়নি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে জিয়াউর রহমান জড়িত। তিনি খুনিদের বিদেশে কূটনীতিকের চাকরি দিয়েছেন। জিয়া ও খালেদা জিয়া খুনিদের রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসিত করেছেন।
বিপরীতে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়, মুজিব হত্যার সঙ্গে জিয়া কিংবা বিএনপিকে জড়িত করা উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা মাত্র। আওয়ামী লীগের নেতারাই ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন। খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে গঠিত সরকারের সব মন্ত্রী ছিলেন আওয়ামী লীগার।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির এই পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে আংশিক সত্যতা আছে। পুরো সত্য নেই। খুনিদের রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসন এরশাদ আরও উৎকটভাবে করেছিলেন। তিনি আওয়ামী লীগকে ঠেকাতে ফারুক-রশীদকে দিয়ে ফ্রিডম পার্টি গঠন করিয়েছিলেন। ফারুককে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রার্থী করেছিলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতারা রহস্যজনক কারণে তা বলেন না। আবার বিএনপি যে মোশতাককে আওয়ামী লীগার হিসেবে প্রচার করে, সেটাও উদ্দেশ্যমূলক। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর গঠিত সরকারে যাঁরাই থাকুন না কেন, সেটা গঠিত ও পরিচালিত হয়েছিল খুনিদের নির্দেশে। এরশাদের সরকারে বিএনপির অনেক বড় নেতা যোগ দিয়েছিলেন। এ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না যে এরশাদের সঙ্গে বিএনপি হাত মিলিয়েছিল।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে যাঁরা হত্যা করেছেন, তাঁরা সবাই না হলেও কেউ কেউ প্রকাশ্যে দায় স্বীকার করেছেন। ফলে তাঁদের অপরাধ শনাক্ত করা সহজ হয়েছে। কিন্তু নেপথ্যে যাঁরা ছিলেন বলে অভিযোগ আছে, তার পক্ষে তেমন তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায় না। অনেক তথ্য-প্রমাণ মুছে গেছে বা মুছে ফেলা হয়েছে।
কয়েক বছর ধরে আওয়ামী লীগের নেতারা বলে আসছেন, বঙ্গবন্ধু হত্যায় যাঁরা সরাসরি জড়িত ছিলেন, তাঁদের বিচার হয়েছে। কিন্তু যাঁরা নেপথ্যে থেকে হত্যাকারীদের মদদ দিয়েছেন, ষড়যন্ত্র করেছেন; তাঁদের খুঁজে বের করতে একটি কমিশন গঠন করা হবে। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গত বছর নিজ মন্ত্রণালয় আয়োজিত ভার্চ্যুয়াল আলোচনা সভায় প্রস্তাবিত কমিশনের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যের কুশীলবদের চিহ্নিত করতে হবে এবং নতুন প্রজন্মের কাছে তাদের মুখোশ উন্মোচন করা হবে। আইন কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি খায়রুল হকের উপস্থিতিতে তিনি প্রস্তাবিত কমিশনের কর্মপরিধি ঠিক করারও পরামর্শ দিয়েছিলেন। গত এক বছরে এ নিয়ে সরকার বা আইন কমিশন কিছু করেছে বলে জানা নেই। এসব কি নিছক কথার কথা? যদি কমিশন গঠনের আগেই বলে দেওয়া হয়, ‘আমি নিশ্চিত অমুকে জড়িত’ তাহলে তো কমিশন গঠনেরও প্রয়োজন হয় না।
সত্যানুসন্ধান কমিশন কাদের নিয়ে হবে? এ ধরনের কাজ করতে হয় সেই বুদ্ধিজীবী ও ইতিহাসবিদদের নিয়ে, যাঁদের সম্পর্কে সমাজের সব শ্রেণির মানুষের আস্থা আছে, যাঁরা দলীয় নন, কিন্তু ইতিহাসের সত্য উদ্ঘাটনে অটল। বাংলাদেশের বিভাজিত রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে এ রকম ব্যক্তিত্ব পাওয়া সহজ নয়। আবার পাওয়া গেলেও তাঁদের অনুসন্ধান যাঁদের মনঃপূত হবে না, তাঁরা মানবেন না। অথচ ইতিহাসের সত্য উদ্ঘাটনে কোনো সন্দেহ বা সংশয় থাকা উচিত নয়।
এ প্রসঙ্গ বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের বিষয়টিও আসে। প্রচলিত আইন ও সব প্রক্রিয়া অনুসরণ করে এই বিচার হয়েছে। আওয়ামী লীগের অনেক নেতা বিশেষ আদালতে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করার দাবি জানিয়েছিলেন। কিন্তু তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের পরামর্শে শেখ হাসিনার সরকার (১৯৯৬-২০০১) সে পথে যায়নি। প্রচলিত আইনেই বঙ্গবন্ধুর বিচারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করে। ফলে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষও এ বিচার নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি। মাঝখানে বিএনপি ক্ষমতায় এসে বিচারপ্রক্রিয়া স্থগিত রাখলেও বাতিল করতে পারেনি।
সত্য অনুসন্ধানের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলো নব্বই দশকে বর্ণবাদী শাসনের অবসানের পর দক্ষিণ আফ্রিকায় ডেসমন্ড টুটুর নেতৃত্বে গঠিত ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন। বিচার করা এর উদ্দেশ্য ছিল না; অতীতের অপরাধ স্বীকার করে যাতে শ্বেতাঙ্গরা জাতীয় পুনর্মিলনের সুযোগ নিতে পারে। দক্ষিণ আফ্রিকায় দীর্ঘ বর্ণবাদী শাসন সমাজে যে প্রচণ্ড ঘৃণা ও বিদ্বেষ তৈরি করেছে, বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা এই কমিশনের মাধ্যমে তার অবসান ঘটাতে চেয়েছিলেন। তিনি বর্ণবাদী শাসক ডি ক্লার্কের সঙ্গে ক্ষমতাও ভাগাভাগিও করেছিলেন।
কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। একাত্তরে কতিপয় রাজাকার, আলবদর ছাড়া দেশের গোটা জনগোষ্ঠী একাত্তরে স্বাধীনতার লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। অর্থাৎ জাতি ঐক্যবদ্ধ ছিল। বিভাজন শুরু হয় স্বাধীনতার পর। যুদ্ধ শেষের প্রাপ্য নিয়ে সংঘাত শুরু হয়ে যায়। এই সংঘাত কেবল রাজনীতিতে সীমাবদ্ধ ছিল না। সশস্ত্র বাহিনীর অভ্যন্তরীণ বিরোধে মুক্তিযুদ্ধের চার সেক্টর কমান্ডার একে অপরকে হত্যা করেন বা হত্যার পটভূমি তৈরি করে দেন।
তাই প্রস্তাবিত কমিশনের কর্মপরিধি নির্ধারণের ক্ষেত্রে ১৯৭৫ সালে সেনাবাহিনীর ভেতরে এবং রাজনীতিতে কার কী ভূমিকা ছিল, সেটা বিবেচ্য বিষয় হবে। কোনোভাবেই এখনকার অবস্থান নিয়ে বিচার করা যাবে না।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে যাঁরা হত্যা করেছেন, তাঁরা সবাই না হলেও কেউ কেউ প্রকাশ্যে দায় স্বীকার করেছেন। ফলে তাঁদের অপরাধ শনাক্ত করা সহজ হয়েছে। কিন্তু নেপথ্যে যাঁরা ছিলেন বলে অভিযোগ আছে, তার পক্ষে তেমন তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায় না। অনেক তথ্য-প্রমাণ মুছে গেছে বা মুছে ফেলা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যা নিয়ে বাংলাদেশের কোনো গবেষক, সাংবাদিক বা ইতিহাসবিদ সত্যানুসন্ধানে কাজ করেছেন বলে জানা নেই। সব অভিযোগ কিংবা অভিযোগ খণ্ডনের ভিত্তি দুই বিদেশি সাংবাদিকের দুটি বই। অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের লিগ্যালি অব ব্লাড ও লরেন্স লিফশুলৎজের আনফিনিশড রেভল্যুশন। এ ছাড়া মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের অবমুক্ত হওয়া নথিপত্রেও কিছু কিছু ধারণা পাওয়া যায়।
সেই সময়ের পত্রপত্রিকা ও রাজনৈতিক বিবৃতি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সঙ্গে জিয়াউর রহমানের যে সম্পর্ক ছিল, তার চেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠতা ছিল জাসদ নেতা কর্নেল আবু তাহেরের। তাহের তখন সরকারি সংস্থায় চাকরি করেও জাসদ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। জাসদের সশস্ত্র শাখা গণবাহিনীর প্রধান ছিলেন। সেনাবাহিনীর ভেতরে গঠিত বিপ্লবী সৈনিক সংস্থারও প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তিনি। কর্নেল তাহের ১৫ আগস্ট সকালে নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকার রেডিও স্টেশনে আসেন, বঙ্গভবনে যান এবং খুনিদের নানা পরামর্শ দেন।
১৯৭৫ সালে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন ও রাজনীতিতে যাঁরা সক্রিয় ছিলেন, তাঁদের অনেকেই এখন বেঁচে নেই। অনেকের রাজনৈতিক অবস্থান আমূল বদলে গেছে। সে সময়ে যাঁরা আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করতে চেয়েছিলেন, তাঁদের অনেকে পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গী হয়েছেন।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের সঙ্গে জিয়ার সম্পর্ক ছিল মূলত পেশাগত। আর সেনাবাহিনীর বাইরে থাকা তাহেরের সম্পর্ক ছিল রাজনৈতিক। দুটোর মধ্যে ফারাক আছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের আগে জিয়ার সঙ্গে খুনি ফারুকের একবার কথা হয়; যার উল্লেখ আছে অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের বইয়ে। ফারুক তাঁর সঙ্গে দেখা করে ক্ষমতার পরিবর্তন সম্পর্কে পরামর্শ চেয়েছিলেন। জিয়া তাঁকে বলেছেন, ‘সিনিয়র কর্মকর্তা হিসেবে আমি এসবের সঙ্গে থাকতে পারি না।’ এরপর জিয়া তাঁর ব্যক্তিগত কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেন, ‘ভবিষ্যতে যেন এই লোক তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে না আসতে পারে।’
অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের বইটি বের হয়েছে এরশাদের আমলে এবং তৎকালীন সরকার এটি সব সরকারি অফিসে বিলি করে। এই বইয়ে বঙ্গবন্ধু ও জিয়া উভয়কে রাজনৈতিকভাবে হেয় এবং এরশাদের ক্ষমতায় আরোহণের যৌক্তিকতা প্রমাণের পরোক্ষ চেষ্টা আছে। মাসকারেনহাস নানা তথ্য-উপাত্ত ও খুনিদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে প্রমাণ করতে চেয়েছেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার পেছনে কোনো রাজনীতি ছিল না। ছিল কতিপয় সেনা কর্মকর্তার ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। অন্যদিকে, লরেন্স লিফশুলৎজ আনফিনিশড রেভল্যুশন-এ মূলত বঙ্গবন্ধু হত্যার রাজনৈতিক যোগসূত্র খোঁজার চেষ্টা করেছেন। তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছেন, এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আমেরিকান গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ জড়িত ছিল।
সত্যানুসন্ধানের আরেকটি সমস্যা হলো ১৯৭৫ সালে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন ও রাজনীতিতে যাঁরা সক্রিয় ছিলেন, তাঁদের অনেকেই এখন বেঁচে নেই। অনেকের রাজনৈতিক অবস্থান আমূল বদলে গেছে। সে সময়ে যাঁরা আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করতে চেয়েছিলেন, তাঁদের অনেকে পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গী হয়েছেন। আবার সে সময়ে যাঁরা ৭ নভেম্বরের কথিত অভ্যুত্থানের বিরোধিতা করেছিলেন, তাঁদের কেউ কেউ এখন বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।
অতএব, সত্যানুসন্ধানে সেই সময় কার কী ভূমিকা ছিল, সেটাই একমাত্র বিবেচ্য হওয়া উচিত। এখন কে কোন রাজনীতি করছেন, তা নয়। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের যাঁরা সহায়তা করেছেন, তাঁদের মুখোশ অবশ্যই উন্মোচন করা উচিত। কিন্তু সেই সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতাদের এই আত্মজিজ্ঞাসাও প্রয়োজন যে এত বড় সংগঠন ও এত বিশাল নেতা-কর্মী থাকা সত্ত্বেও কেন তাঁরা খুনিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারলেন না?
● সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি