কচুয়াইয়ের আলোক 'রেখা'
বাংলাদেশে ‘ঢের’ নামে একটা জাতিগোষ্ঠী আছে এটা হয়তো কম বাঙালিই জানেন। এ রকম অন্তত ৩৩টি পরিবার আছে দক্ষিণ চট্টগ্রামের কচুয়াইয়ে।
চট্টগ্রাম শহর থেকে কচুয়াইয়ের দূরত্ব ৪৫ কিলোমিটার। ঢাকা থেকে হবে ২৯০ কিলোর মতো। তবে ‘মূলধারা’র বাংলাদেশ থেকে বহু দূরের জাতিগোষ্ঠী ওই পরিবারগুলো পুরোপুরি প্রান্তিক।
সেই কবে চা-বাগানে কাজ করতে এসেছিল পূর্বপুরুষ, তার কোনো স্মৃতিকথাও আর অবশিষ্ট নেই। হারিয়েছে ভাষা আর জাতি পরিচয়ও। দূর থেকে অচেনা জনপদে লরিতে ভরে কাজে আসার পথে চাটগাঁয়ের কৌতূহলী মানুষের কাছে এদের পূর্বপুরুষ শ্রমজীবীরা কেবল বলেছিল ‘ঢের এয়েছি’। সেই থেকে পটিয়া ও চন্দনাইশে তারা ‘ঢের’ নামে পরিচিত এক নিম্নবর্গ। স্থানীয় লেকজনের তরফ থেকে এ রকম সম্বোধনে অসন্তোষ আছে ঢেরদের। চাপিয়ে দেওয়া এই ‘পরিচয়’ এক স্থায়ী বঞ্চনারই প্রতীকী স্মারক।
তবে সময় বদলাচ্ছে। ‘ঢের’ তরুণী রেখা দাস এবার এইচএসসি পরীক্ষা দেবেন। কচুয়াইয়ে ওদের পাড়ায় এটা বড় ঘটনা। মধ্য আয়ের স্বাধীন বাংলাদেশের পাঁচ দশকে ঢেরদের অর্জন ‘রেখা’। তিনি এখন বাংলাদেশের প্রান্তিক এই দলিত সমাজের আলোকরেখাই বটে।
রেখাকে এগোতে সাহায্য করছে ‘স্বপ্ননগর বিদ্যা নিকেতন’। এটি একটা প্রাথমিক স্কুল। তবে স্কুলের চেয়েও বেশি কিছু। কেবল দলিত সম্প্রদায়ই নয়, আশপাশের বাঙালি শিশুরাও পড়ছে সেখানে। একসঙ্গেই। এভাবে উভয় জাতিসত্তার মানুষ ভুলে গেছে তাদের মাঝে এককালে জাতপাতের ফারাক ছিল। স্কুলে ওরা সবাই এখন একসঙ্গেই দুপুরে খায়।
যেভাবে শুরু
এই বিদ্যাঘরের গল্পটি চট্টগ্রামে অনেকে জানেন। বাকি দেশেরও তা জানা উদ্দীপনাময় হতে পারে। পটিয়ার পরিত্যক্ত এক চা-বাগানে শিক্ষার আলো ছড়াতে এর যাত্রা। পাহাড়ি ধাঁচের এই এলাকায় আগে যোগাযোগ ছিল দুরূহ। ছিল দারিদ্র্য। শিক্ষাবঞ্চনা দারিদ্র্যকে আরও দাসোচিত করে তুলেছিল।
অন্তত তিন কিলোমিটারে শিশুদের কোনো বিদ্যাপীঠ নেই এখানে। দেড় দশক আগে নিরক্ষর শিশুদের পড়াতে শুরু করেন স্বেচ্ছাসেবী দুই বাঙালি তরুণ। মাঝে কিছুদিন বন্ধ থাকে সেই উদ্যোগ। ২০০৯-এ নব উদ্যমে রীতিমতো প্রাতিষ্ঠানিক পরিকল্পনায় একই স্থানে শুরু স্বপ্ননগর বিদ্যানিকেতনের। এখন শিক্ষার্থীদের ৬৫ ভাগই কচুয়াইয়ের বাঙালি সন্তান। বাকিরা পুরোনো বাগিচাশ্রমিক পরিবারের শিশু।
ছনের ঘরে শুরু হলেও দৃষ্টিনন্দন নকশায় একটা ভবন হয়েছে ইতিমধ্যে। স্থানীয় সব ঘরের মানুষ এসব নির্মাণে অংশ নেন। স্বপ্ননগর তাই আশপাশের সবার। বাগানের পরিত্যক্ত ফ্যাক্টরি ঘর সংস্কার করতে গিয়ে যেসব ইট মেলে, সেগুলো দিয়েই স্কুলে যাওয়ার দীর্ঘ রাস্তা বানিয়েছে ‘কমিউনিটি’। পেছন থেকে এই উদ্যোগ এগিয়ে নিচ্ছেন চট্টগ্রামের পরিবর্তনবাদী কয়েকজন তরুণ-তরুণী।
নতুন এক শিক্ষাচিন্তার নিরীক্ষা
বাংলাদেশে প্রায় দেড় শ চা-বাগান ভালো ব্যবসা করে। তবে এসব বাগানে গুণগতভাবে উন্নত প্রাথমিক শিক্ষা বেশ বিরল। পটিয়া চা-বাগান বন্ধ হয়ে গেছে আনুমানিক ১৯৭৯ সালে। কিন্তু সেখানের শিক্ষাচিত্র যে দেশের জন্য আলোকরেখা হয়ে উঠতে পারল, তার কারণ ধ্রুবজ্যোতি হোড়, সুজা আল-মামুন, নাসিমা সিরাজি, ইশতিয়াক মাহমুদ, নিলয় দাশ, অনিকেত চৌধুরী, সৈয়দা মাসকুরা জাহান প্রমুখ তারুণ্য। চট্টগ্রাম ও ঢাকার উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়েছেন এঁরা। এখন কেউ শিক্ষাবিদ, প্রকৌশলী, স্থপতি, আইনজীবী আবার কেউ সাংবাদিকতায় উচ্চশিক্ষিত। ছাত্রত্বকালে অনেকে শিক্ষা অধিকার ও গণতন্ত্রের জন্য কাজ করতেন। সে সময়কার রূপান্তরবাদী শিক্ষা চিন্তারই নিরীক্ষা যেন স্বপ্ননগর বিদ্যানিকেতন।
বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার নিলয় দাশ এই স্কুলেই গড়েছেন বায়োগ্যাসের পোর্টেবল একটা মডেল। চারপাশ বিদ্যুৎহীন হলেও স্বপ্ননগর বিদ্যাপীঠে জ্বলছে ‘সোলার এনার্জি’। প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন সুজা আল-মামুন। নাসিমা সিরাজি পাঠদানের সৃজনশীল উপায়গুলো বের করছেন। অন্যরাও কাজ ভাগ করে নিয়েছেন। যাবতীয় কিছু সমন্বয় করেন ধ্রুবজ্যোতি হোড়। ছোট্ট স্কুলটি এদের জীবনের অংশ হয়ে আছে। আগামী দিনে একে আবাসিক স্কুলে পরিণত করার ইচ্ছা। শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবার থাকার জায়গা হবে সেখানে।
বিদ্যালয় সংস্কৃতি থেকে কর্তৃত্ব দূর করার শপথ
১১ বছরের পথ চলা শেষে স্বপ্ননগর বিদ্যানিকেতনের আয়তন এ মুহূর্তে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত। আরও বাড়বে। শিক্ষক না বাড়িয়ে শিক্ষার্থী বাড়াতে চাইছে না এই বিদ্যাপীঠ। ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত কাছাকাছি রাখার ইচ্ছা। প্রায় ১১৫ জন শিক্ষার্থী এখন। এই স্কুলের বৈশিষ্ট্য হলো, যারা মাধ্যমিক স্কুলে যায়, তাদেরও শিক্ষার্থী হিসেবে গণ্য করা হয়। কে কোথায় ভর্তি হচ্ছে, কী পড়ছে, শিক্ষাজীবন চালু রাখতে কার কী প্রয়োজন সেসবেও নজর রাখা হয় নিয়মিত। সেই সূত্রেই উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী হয়েও রেখা দাস স্বপ্ননগর টিমের তত্ত্বাবধানে আছেন। একাদশ শ্রেণির আরও অনেকে আছে রেখাকে অনুসরণ করে। এরাই স্বপ্ননগরের প্রথম প্রজন্ম। এ রকম ১৪০ জন শিক্ষার্থীকে বছরজুড়ে দেখাশোনা করে স্কুল।
এরা বেড়ে উঠেছে একটা নতুনধারার শিক্ষাপদ্ধতির ফসল হিসেবে, যাকে উদ্যোক্তারা বলছেন শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক পড়া-লেখা-শেখা। বিদ্যালয় সংস্কৃতি থেকে কর্তৃত্ব, খবরদারি ও নিপীড়নের অতীত পরম্পরা দূর করতে চায় এই চেষ্টা। ঢেরপাড়ায় শিক্ষকদের ‘মুখের ওপর কথা’ বলতে পারে শিক্ষার্থীরা। কৌতূহল প্রকাশে বাধা নেই। ভিন্নমতেও তারা সাবলীল। গতানুগতিক চোখে অনেক সময় ‘বেয়াদব’ও মনে হয় এই শিশুদের!
কচুয়াইয়ের ঢেরপাড়ায় শিক্ষা মানে ব্যবহারিক কিছুও বটে। দৈনন্দিন পাঠকে সামাজিক চর্চার সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হয়। ‘শিক্ষিত’ করার নামে কিশোরদের সমাজবিচ্ছিন্ন করার ধারা বদলাতে চাইছে স্বপ্ননগর। স্কুলটির ব্যয়ভারও চলছে স্থানীয় বহুজনের দান-অনুদান-অংশগ্রহণে। দেশ-বিদেশের অনেকে আগ্রহী হয়ে এর বিকাশে অবদান রাখছেন। এটাই শক্তির জায়গা। তার পরও টানাপোড়েন আছে। কৃষি আবাদ, ফলমূলের গাছ লাগনো, গরু-ছাগল পালন করেও আয়ের বিকল্প উৎস খোঁজা হচ্ছে। প্রতিদিন বাগানের পরিচর্যা দিয়েই এখানে শিশুদের পাঠের কাজ শুরু হয়। শ্রেণিকক্ষগুলোও স্থানান্তরযোগ্য। যখন যেখানে ইচ্ছা চটজলদি শ্রেণিকক্ষ সরিয়ে পাঠ শুরু করা যায়। খোলা জায়গায় বসেও পড়ালেখা চলে।
কচুয়াইয়ে রেখাদের উঠে দাঁড়ানো
এখানে শিক্ষার্থী পরিবারগুলো অতিদরিদ্র। অর্থ দেওয়ার সামর্থ্য নেই বললেই চলে। সে জন্য বিকল্প হিসেবে স্কুলের বিভিন্ন কাজে শিক্ষার্থী পরিবারের অনেকে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে একদিন শারীরিক শ্রম দিয়ে যান সহায়তা হিসেবে। সঙ্গে বাঁশ, কাঠ ইত্যাদি নিয়ে আসেন। আশপাশের ইটভাটাগুলো দেয় নির্মাণ উপকরণ। কখনো শ্রমিক-কর্মচারী ভাড়া করে উন্নয়নধর্মী কাজ করতে হয় না। স্কুলের জন্য কমিউনিটির ৯০ ভাগ মানুষের শারীরিক শ্রমের অভিজ্ঞতা আছে।
এসব মিলিত অবদানের পরও প্রত্যাশা ও পরিকল্পনামতো এই বিদ্যাপীঠকে এগিয়ে নিতে আরও সম্পদ প্রয়োজন। বিদ্যাপীঠের জায়গাটি জেলা প্রশাসনের মালিকানাধীন। তার পাওয়া না-পাওয়া নিয়েও আছে অনিশ্চয়তা। যদিও সবার আশা, এ রকম একটা শিক্ষা উদ্যোগকে শেষ পর্যন্ত স্থায়ী ঠিকানা দেবেন প্রশাসকেরা।
জমি জিরাত আর আর্থিক অনটনের চেয়েও কচুয়াইয়ে শিক্ষা বিস্তারের বড় বাধা দারিদ্র্য, বাল্যবিবাহ। পরিবারগুলো মেয়েদের বেশি দূর পড়াতে চায় না। যে কারণে শিক্ষার সংগ্রাম একই সঙ্গে সমাজসংস্কার ও দারিদ্র্যবিরোধী সংগ্রামও এখানে। যা দুরূহ এবং ৭-৮ জন তরুণের একার কাজ নয়।
তবে নাসিমা, নিলয়, ধ্রুবজ্যোতি আর সুজা আল-মামুনেরা চেষ্টা করছেন। এটাই আশার দিক। এ রকম আশার অন্বেষা অনেক। একদা দেশের কিশোর-তরুণেরা সড়কে শৃঙ্খলা আনতে চেয়েছিল। আরেক দল শিক্ষার্থী ভর্তি ও চাকরির পরিসরে মূল্যায়নের ভিত্তি করতে চেয়েছিল মেধাকে। সেই পরম্পরাতেই যেন স্বপ্ননগর বিদ্যাপীঠ চাইছে শিক্ষার সব পরিসর হোক শিক্ষার্থীবান্ধব ও কর্তৃত্বমুক্ত। শিক্ষালয়গুলো গড়ে উঠুক কমিউনিটির অংশগ্রহণে গণতান্ত্রিক আবহে।
চারদিকে শিক্ষিত তারুণ্য বিভিন্ন কাজের মধ্য দিয়ে যেভাবে সমাজ-সংস্কৃতিতে কাঠামোগত পরিবর্তন আনতে চাইছে, তারই এক অপ্রথাগত দৃষ্টান্ত কচুয়াইয়ের এই শিক্ষা আন্দোলন। এ রকম আলোকরেখা আগামী দিনে কতটা পথরেখা হয়ে উঠবে, তা অবশ্যই অনিশ্চয়তায় মোড়ানো। সমগ্র জনসমাজ এই তরুণদের কীভাবে পথ করে দেবে, সেটা দেখার অপেক্ষায় থাকতে হবে আরও কিছু সময়। কিন্তু কচুয়াইর রেখারা স্পষ্ট উঠে দাঁড়ানোর কথা জানাচ্ছে।
আলতাফ পারভেজ: গবেষক