চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে অচেতন অবস্থায় শুয়ে আছেন এক রোগী। তাঁর মাথা ও চোখে ব্যান্ডেজ, নাকে অক্সিজেনের নল। মাথার সাদা ব্যান্ডেজে বড় হরফে লেখা আছে, ‘হাড় নেই, চাপ দিবেন না’। পত্রপত্রিকায় এই ছবি ছাপা হয়েছে এবং যথারীতি ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। যেকোনো রোগীরই এ রকম পরিণতি সাধারণ মানুষকে ব্যথিত করবে। তারপরও ছবিটি যদি হয় সেই মেডিকেল কলেজেরই একজন ছাত্রের এবং একই রাজনৈতিক দলের প্রতিপক্ষ গোষ্ঠীর আক্রমণের শিকার হয়ে যদি তাঁর এই অবস্থা হয়, তাহলে মানুষের মনে তা কী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে, সহজেই অনুমেয়। কিন্তু রাজনীতির নামে গ্রুপিংয়ের চর্চা করতে গিয়ে এই সংবেদনশীলতাও যেন হারিয়ে ফেলেছেন সরকারি দলের ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীরা। যেকোনো মূল্যে ক্যাম্পাসে নিজেদের গোষ্ঠীর কর্তৃত্ব বজায় রাখা ছাড়া আর কোনো লক্ষ্য বা মোক্ষ তাঁদের নেই।
গত ৩০ অক্টোবর হামলার শিকার গুরুতর আহত মেডিকেল কলেজের এই ছাত্র মাহাদি প্রায় ২০ দিন চিকিৎসার পর এ যাত্রা প্রাণে বেঁচে তাঁর বাড়ি কুমিল্লায় ফিরে গেছেন। কিন্তু মেধাবী ছাত্রটি আর কখনো চিকিৎসাবিজ্ঞানের মতো একটি বিষয়ে অধ্যয়ন অব্যাহত রাখতে পারবেন কি না, এখনই বলা সম্ভব নয়। শুধু মাহাদি কেন, একই কলেজের আরও ৩১ জন ছাত্র শেষ পর্যন্ত শিক্ষাজীবন শেষ করে চিকিৎসক হিসেবে বেরিয়ে আসতে পারবেন কি না, সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। কারণ, সেই ২৯ ও ৩০ অক্টোবরের সহিংস সংঘর্ষের ঘটনায় জড়িত অভিযোগে ৩১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার করেছে কলেজ কর্তৃপক্ষ।
প্রতিবছর কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির মৌসুমে আমরা দেখতে পাই মেডিকেল কলেজ, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় সুযোগ পাওয়ার জন্য কী গভীর একাগ্রতায় প্রস্তুতি নিতে থাকেন ছাত্রছাত্রীরা। তারপর শুরু হয় শহর, মফস্বল, এমনকি দেশের প্রান্তিক অঞ্চল থেকে বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি পরীক্ষা দিতে ছোটাছুটি। মা-বাবা বা অভিভাবকদের তখন ঘুম হারাম সন্তানের ভবিষ্যৎ চিন্তায়। সেই সন্তানেরা যখন এসব প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ পান, সেদিন থেকেই স্বপ্নের জাল বুনতে থাকেন মা-বাবা। কিন্তু সে রকম একজন অভিভাবক কি ভাবতেও পারেন তাঁর যে ছেলেকে ডাক্তার হতে পাঠিয়েছিলেন, তিনি নিজেই বন্ধু-সহপাঠীদের হাতে প্রহৃত হয়ে পড়ে থাকবেন হাসপাতালের শয্যায়? আর যে মেধাবী ছাত্র হাজারো পরীক্ষার্থীর মধ্যে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে পছন্দের প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন, তিনিই-বা কেন সেখান থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার ঝুঁকি নিচ্ছেন? সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। তার আগে বেশ কয়েক বছর আগের একটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করতে চাই।
পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে একজন ফটোসাংবাদিকের ওপর হামলা করেছিলেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের কিছু উচ্ছৃঙ্খল নেতা-কর্মী। তাঁর ক্যামেরাটিও কেড়ে নিয়েছিলেন তাঁরা। সেটা ২০১৬ সালের ঘটনা। এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ সাংবাদিকেরা প্রতিবাদ-বিক্ষোভ করেছিলেন। বিভিন্ন কর্মসূচিও ঘোষণা করেছিল সাংবাদিক ইউনিয়ন।
তখন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ছিলেন নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন। মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগেও একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল তাঁর অনুসারীদের। সাংবাদিকদের ক্ষোভের বিষয়টি অনুধাবন করে নিজেই তিনি হাজির হয়েছেন চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে। ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন তিনি। এ ধরনের ঘটনা যাতে আর না ঘটে, সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন। সাংবাদিকেরা তাঁকে এই ঘটনার জন্য ছাত্রলীগের একজন নির্দিষ্ট নেতার নামে অভিযোগ করে তাঁকে দল ও কলেজ থেকে বহিষ্কারের দাবি জানিয়েছিলেন। তৎকালীন মেয়র এই বহিষ্কারের দাবি মানার ক্ষেত্রে অপারগতা জানিয়ে দুটি অসুবিধার কথা উল্লেখ করেছিলেন সেদিন। প্রথমত, যে ছাত্রের নামে অভিযোগ, তিনি এমবিবিএস চূড়ান্ত বর্ষের ছাত্র। এ মুহূর্তে তাঁকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করার মানে তাঁর ছাত্রজীবন তো বটেই, পেশাজীবনকেও ধ্বংস করা। উপস্থিত সাংবাদিকেরা সেদিন নাছির উদ্দীনের এই যুক্তিকে গ্রহণযোগ্য মনে করেছিলেন। কেননা, সমাজে একজন চিকিৎসক এতটাই প্রয়োজনীয় ও আদৃত যে তাঁর ভবিষ্যৎ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া মানে পক্ষান্তরে সমাজেরই ক্ষতি। কিন্তু যে কারণে সাংবাদিকদের দ্বিতীয় দাবিটি মানতে অনীহা প্রকাশ করেছেন নাছির উদ্দীন, সেটি ছিল সত্যিই বিস্ময়কর। তিনি জানিয়েছিলেন, এই ছাত্রলীগ কর্মীকে তিনি বের করে দিলে অন্য পক্ষ তাঁকে কাছে টেনে নেবে। অর্থাৎ অন্তঃকোন্দলের কারণে দলে ‘বাহুবলীদের’ কী পরিমাণ আদর ও কদর আছে, সেটারই অসহায় স্বীকারোক্তি প্রকাশ পেয়েছিল সেদিন নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের কথায়।
চট্টগ্রামের রাজনীতির খোঁজখবর যাঁরা রাখেন, তাঁরা জানেন, এ শহরে আওয়ামী লীগের দুটি উপদলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান ও সাবেক মেয়র নাছির উদ্দীন। নিজেদের অবস্থান মজবুত রাখার জন্য তাঁরা মরিয়া। তা সত্ত্বেও চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে অন্তর্দলীয় কোন্দল যতটা নয়, তার চেয়ে অনেক বেশি তীব্র ছাত্রলীগের মধ্যে। দ্বন্দ্ব-সংঘাতের কারণে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, চট্টগ্রাম সরকারি কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগে সংঘর্ষ ও হতাহত হওয়ার ঘটনা প্রায় নিয়মিতই উঠে আসছে সংবাদমাধ্যমে। কত তদন্ত কমিটি হলো, কিন্তু যুগ যুগ ধরে চলতে থাকা দ্বন্দ্বের নিরসন হয়নি, বরং যুক্ত হয়েছে নতুন মাত্রা।
এখন আগের সেই প্রশ্নে আসি, কেন মেধাবী শিক্ষার্থীরা জড়িয়ে পড়ছেন দ্বন্দ্ব-সংঘাতে। সহজ ও একমাত্র উত্তর, তাঁরা ব্যবহৃত হচ্ছেন অভিভাবক সংগঠনের নেতাদের দ্বারা। দলে নিজেদের প্রভাব প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাণশক্তিতে ভরপুর এই তরুণদের ভুল পথ দেখাচ্ছেন নেতারাই। অন্যদিকে, এই তরুণদের তাৎক্ষণিক লাভ টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজির মাধ্যমে কিছু নগদ অর্থ হাতিয়ে নেওয়া।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের আশপাশে যত ক্লিনিক বা ওষুধের দোকান আছে, ভাড়ায় চালিত যত অ্যাম্বুলেন্স আছে, তার মালিকদের কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায়ের ব্যাপারটি ওপেন সিক্রেট। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বা চট্টগ্রাম কলেজের মতো দেশের প্রায় সব কটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভবন নির্মাণসহ অন্যান্য উন্নয়নকাজে নিযুক্ত ঠিকাদারেরা এই ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীদের কাছে জিম্মি। মূলত, এই চাঁদা আদায়ের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়ছেন একই সংগঠনের উপদলে বিভক্ত ছাত্ররা। আদর্শের সঙ্গে এসব লড়াইয়ের কোনো সম্পর্কই নেই।
বুয়েটের ছাত্র আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করেছেন স্বনামধন্য এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরই ছাত্ররা। সেই ২৫ ছাত্রের বিচার চলছে। রাষ্ট্রপক্ষ তাঁদের মৃত্যুদণ্ড চেয়েছে। রায় যা-ই হোক, এই আসামিদের ভবিষ্যৎ বলে যে আর কিছুই থাকল না, তা তো নিশ্চিত। অথচ আবরার তো বটেই, যাঁদের আজ আমরা খুনি পরিচয়ে চিনছি, তাঁরাও হয়ে উঠতে পারতেন আমাদের সম্পদ। এই ক্ষতি পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের। আদর্শহীন এই ছাত্ররাজনীতির হাত থেকে নিস্তার মিলবে কবে?
বিশ্বজিৎ চৌধুরী প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক, কবি ও সাহিত্যিক