করোনাকালে ক্রেতা-বিক্রেতার কাছে ক্রয়-বিক্রয়ের সবচেয়ে সহজলভ্য ও আকর্ষণীয় মাধ্যম হয়ে উঠেছে ই-কমার্স। ২০২০ সালে বিশ্বের ১০টি সেরা ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৯টির আয় দ্বিগুণ বেড়েছে। গ্লোবাল ডেটা ইনটেলিজেন্স সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে আমেরিকান ই-কমার্স ব্র্যান্ড আমাজন (৩৮৬.১ বিলিয়ন ডলার), চীনের ই-কমার্স ব্র্যান্ড জেডি ডট কম (১০৮.১ বিলিয়ন ডলার) ও আলিবাবা (১০৪ বিলিয়ন ডলার) সবচেয়ে বেশি আয় করেছে।
ঘরে বসেই ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য যেখানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ই-কমার্স একটি বিশ্বাসযোগ্য ও আস্থাশীল মাধ্যম হয়ে উঠছে, সেখানে আমাদের দেশের চিত্রটা ঠিক উল্টো। সম্প্রতি বেশ কটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে এই খাতের দৈন্য দশা উঠে আসছে।
প্রশ্ন থেকেই যায়, এই দৈন্য দশার পেছনে আসলে দায়টা কার? দেশের বহুল আলোচিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণা, বিশ্বাস ও মূল্যবোধের ঘাটতিতে সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রক সংস্থার যেমন দায় রয়েছে, তেমনি এর দায় ক্রেতার ওপরও বর্তায়।
পত্রপত্রিকা বা অন্যান্য মাধ্যম থেকে আমরা জানতে পারি, ইভ্যালির আছে ৪৫ লাখ গ্রাহক, কয়েক হাজার মার্চেন্ট এবং একটি সুপ্রতিষ্ঠিত সরবরাহ চেইন (ডিস্ট্রিবিউশন নেটওয়ার্ক)। কিন্তু এসব গ্রাহক আসলে কতটা বিশ্বস্ত বা প্রকৃত বন্ধু, পুরো সরবরাহ চেইন কতটা টেকসই বা ভঙ্গুর, স্বল্পস্থায়িত্বের না দীর্ঘস্থায়িত্বের, তা আমরা কোনো মাধ্যম থেকেই জানতে পারি না।একটু বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যাবে এসব গ্রাহকের প্রকৃতি আসলে কী রকম? আদৌ এসব গ্রাহক ইভ্যালির অদৃশ্য সম্পদ কি না?
ইভ্যালি মূলত লোভনীয় অফার ও চটকদার বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে গ্রাহক আকৃষ্ট করেছে। এসব গ্রাহক হয় আগন্তুক, তা না হলে প্রজাপতি গ্রাহক, যারা কোম্পানির বিশ্বস্ত বন্ধু নয়। মার্কেটিংয়ের ভাষায় এসব গ্রাহককে মৌমাছি ক্রেতা হিসেবেও বিবেচনা করা যেতে পারে।
বাজারে মূলত চার ধরনের গ্রাহক বা ক্রেতা পাওয়া যায়। যেমন: আগন্তুক (যারা কোম্পানির প্রতি বিশ্বস্ত ও লাভবান কোনোটিই নয়), প্রজাপতি গ্রাহক (যারা কোম্পানির জন্য লাভবান কিন্তু কোম্পানির প্রতি বিশ্বস্ত নয়), নাছোড়বান্দা (যারা কোম্পানির প্রতি বিশ্বস্ত কিন্তু লাভবান নয়) এবং প্রকৃত বন্ধু (যারা কোম্পানির জন্য খুবই লাভবান এবং বিশ্বস্ত উভয়ই)।
ইভ্যালি মূলত লোভনীয় অফার ও চটকদার বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে গ্রাহক আকৃষ্ট করেছে। এসব গ্রাহক হয় আগন্তুক, তা না হলে প্রজাপতি গ্রাহক, যারা কোম্পানির বিশ্বস্ত বন্ধু নয়। মার্কেটিংয়ের ভাষায় এসব গ্রাহককে মৌমাছি ক্রেতা হিসেবেও বিবেচনা করা যেতে পারে। কারণ, এসব ক্রেতা যেসব ই-কমার্স কোম্পানির যতক্ষণ ডিসকাউন্ট আছে, ততক্ষণ পর্যন্ত ওই কোম্পানির কাছে স্থায়ী হয়, তা না হলে উড়ে যায়।
এ ক্ষেত্রে ইভ্যালি উৎপাদন ব্যয়েরও অনেক কমে পণ্য বিক্রি করেছে, যেটাকে আমরা আন্তর্জাতিক ব্যবসার ভাষায় ডাম্পিং বলে থাকি। আন্তর্জাতিক ব্যবসায় এই ডাম্পিং প্রতিরোধে কতশত ব্যবস্থা নেওয়া হয়, অথচ ইভ্যালি ঘরে বসেই প্রতিমুহূর্তে গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণা করে গেছে। ইভ্যালি নিজস্ব বিনিয়োগ না করে আগের গ্রাহকের টাকাকে মূলধন হিসেবে নিয়ে পরের গ্রাহককে ছাড় দিয়েছে।
ইভ্যালি একটি ডুবন্ত জাহাজ। এর যাত্রীদের কী হবে? এটিকে কি উদ্ধার করা যাবে? আমি মনে করি খুবই কঠিন। তবে এর যাত্রীদের পাওনা ইভ্যালির যাবতীয় সম্পদ বিক্রি করে যতটুকু পাওয়া যাবে, তা ক্রেতার পাওনার অনুপাতে মিটিয়ে দেওয়া যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে ক্রেতারা হয়তোবা খুবই অল্প পরিমাণ টাকা ফেরত পাবে, যা একপ্রকার তাদের লোভেরই শাস্তি, যেটি কিনা পরে অন্য গ্রাহকদের সচেতন করবে।
অনেকেই ইতিমধ্যে পত্রপত্রিকায় গুরুত্বপূর্ণ সমাধানের পথ উল্লেখ করেছেন। কিন্তু কিছু মৌলিক বিষয় এখনো উঠে আসেনি। যেহেতু ই-কমার্স দেশের একটি সম্ভাবনাময় খাত, সেহেতু টেকসই ই-কমার্স তথা সরবরাহ চেইন গঠনের লক্ষ্যে কিছু মৌলিক বিষয়কে সমাধানকল্পে ভাবা যেতে পারে।
পত্রপত্রিকা থেকে জানতে পারি, আইনের বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো, এমনকি সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলো পদে পদে অর্জিত দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশ যথাযথ বাস্তবায়ন হয়নি, বরং সন্দেহজনক লেনদেনের ঘটনায় গত বছরের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট ইভ্যালির লেনদেন এক মাস বন্ধ রাখার পর আবারও সচল করে দেয়।
ইভ্যালির মালিক রাসেল অতিরিক্ত ডিসকাউন্ট ও জনপ্রিয় মডেল বা সেলিব্রিটির মাধ্যমে চটকদার বিজ্ঞাপন প্রচার করে দ্রুত গ্রাহকসংখ্যা বাড়িয়ে অন্য কোম্পানির কাছে বিক্রির চেষ্টা করে। এ ধরনের অনৈতিক ব্যবসায়িক পন্থা ও অসুস্থ মানসিকতা পরিহার করতে হবে।
এ দ্বারা মূলত আইনের বাস্তবায়ন ও সুশাসন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। তাই প্রথমত কঠিন শাস্তি, সুশাসন ও আইনের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা জরুরি।
দ্বিতীয়ত, সততা, মূল্যবোধ ও বিশ্বাস অর্জনের ক্ষেত্রে জোর দিতে হবে। ইভ্যালি সরবরাহ সময়কে কৃত্রিমভাবে বিলম্ব করে ক্রেতার সঙ্গে প্রতারণা করছিল। এটি মূলত এক ক্রেতার অর্থ দিয়ে অন্য ক্রেতার পণ্যেও মূল্য পরিশোধের কৌশল, যা আসলে সব গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণা ও অসততা। ই-কমার্স মূলত বিশ্বাস ও আস্থার ওপর নির্ভরশীল। যেসব ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের প্রতি মানুষের আস্থা বেশি, সেসব প্রতিষ্ঠানের সুনাম তথা অদৃশ্য সম্পদও বেশি।
এ ক্ষেত্রে প্রতিটি ই-কমার্স কোম্পানিকে সুস্থ প্রতিযোগিতা, বিশ্বাসযোগ্য প্রতিশ্রুতি ও সততার সঙ্গে ব্যবসা করা উচিত। এ ছাড়া বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে নৈতিক মূল্যবোধ গঠনের প্রশিক্ষণের ওপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
তৃতীয়ত, মানসিকতার পরিবর্তন। উদ্যোক্তা বা মালিককে অবশ্যই রাতারাতি বড়লোক হওয়ার যে প্রবণতা, তা পরিহার করতে হবে। বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়, ইভ্যালির মালিক রাসেল অতিরিক্ত ডিসকাউন্ট ও জনপ্রিয় মডেল বা সেলিব্রিটির মাধ্যমে চটকদার বিজ্ঞাপন প্রচার করে দ্রুত গ্রাহকসংখ্যা বাড়িয়ে অন্য কোম্পানির কাছে বিক্রির চেষ্টা করে। এ ধরনের অনৈতিক ব্যবসায়িক পন্থা ও অসুস্থ মানসিকতা পরিহার করতে হবে।
চতুর্থত, সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রক সংস্থা বা অ্যাসোসিয়েশন, যেমন: ই-ক্যাব, বাংলাদেশ ব্যাংক, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। দায় এড়ানোর চেষ্টা বা একজনের দোষ আরেকজনের ঘাড়ে চাপানোর সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সংশ্লিষ্ট সব স্টেকহোল্ডার নিয়ে সমন্বয়ের মাধ্যমে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
পঞ্চম, ডিজিটাল মনিটরিংকে আরও শক্তিশালী করতে হবে, প্রয়োজনে লোকবল বাড়িয়ে গ্রাহক অভিযোগ সেল গঠন করে প্রতিটি অভিযোগ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ ও প্রতিবেদন প্রস্তুত করতে হবে, যাতে ইভ্যালির মতো অত্যন্ত ধূর্ত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানকে শুরুতেই সতর্ক এবং প্রয়োজনে বন্ধ করা যায়।
পরিশেষে বলা যায়, বিশ্ব তথা বাংলাদেশের জন্য ই-কমার্স একটি সম্ভাবনাময় ও উদীয়মান খাত। করোনার সময় ই-কমার্সের বিস্তার আমরা ব্যাপকভাবে লক্ষ করছি। কিন্তু উদ্যোক্তার দ্রুত লাভের মানসিকতা ও প্রতারণা, অতিরিক্ত ডিসকাউন্ট বা ডাম্পিং মূল্যে পণ্য বিক্রি, ক্রেতার অতি লোভ ও অসতর্কতা, ডিজিটাল মনিটরিংয়ের অভাব এবং ই-কমার্স আইনের বাস্তবায়নের দীর্ঘসূত্রতা এই সম্ভাবনাময় খাতকে কঠিন চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলেছে। মোটকথা, টেকসই ই-কমার্স সরবরাহ নেটওয়ার্কের জন্য সততা, নৈতিক মূল্যবোধ, আস্থা ও বিশ্বস্ততা মূল ভিত্তি।
ড. সুবোধ দেবনাথ টেকসই সাপ্লাই চেইন বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস বিভাগের চেয়ারম্যান ও সহযোগী অধ্যাপক।