এশিয়া ও ইউরোপের ভয়ানক বিরোধপূর্ণ দুই অঞ্চল ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র খোলাখুলি সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে পারে চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে। ইউক্রেন ও তাইওয়ানের সংকট সমাধানযোগ্য, কিন্তু সেটা করতে হলে বিবদমান সব পক্ষকে অন্যের বৈধ নিরাপত্তার স্বার্থের প্রতি সম্মান দেখাতে হবে। রাশিয়ার আগ্রাসন থেকে সার্বভৌমত্ব রক্ষার অধিকার ইউক্রেনের রয়েছে, কিন্তু রাশিয়ার নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে, এমন কিছু করার অধিকার তাদের নেই।
ইউক্রেনের সাম্প্রতিক সংকট রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র দুই দেশের উচ্চাকাঙ্ক্ষার ফলাফল। রাশিয়া ২০১৪ সালে ক্রিমিয়াকে নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। ইউক্রেনের প্রধান দুই শিল্পাঞ্চল দখল করে নিজেদের জ্বালানি, শিল্পপণ্য ও বাজারের ওপর দেশটিকে নির্ভরশীল করে রাখতে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে রাশিয়া। অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত হওয়ার চেষ্টা করছে ইউক্রেন। এ উদ্দেশ্যে তারা একটা চুক্তিও করেছে। এখন ক্রেমলিনের ভয়, ইইউর সদস্য হয়ে গেলে ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পথে বাধা থাকবে না ইউক্রেনের।
২০০৮ সালে তখনকার মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ইউক্রেনকে ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। রাশিয়ার সীমানায় ন্যাটোর উপস্থিতি নিশ্চিত করতেই ছিল এ আহ্বান। যুক্তরাষ্ট্রের নেতারা যুক্তি দেখান, সামরিক জোট বাছাই করার স্বাধীনতা রয়েছে ইউক্রেনের। তবে কোনো দেশ ইচ্ছা করলেই যেকোনো সামরিক জোটে যুক্ত হতে পারে না। কেননা প্রতিবেশী দেশের নিরাপত্তার স্বার্থ এতে জড়িত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে শিক্ষা নিয়ে অস্ট্রিয়া ও ফিনল্যান্ড নিজেদের স্বাধীনতা ও ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধির কথা বিবেচনা করে ন্যাটোতে যোগ দেয়নি। তারা মনে করেছিল, এ জোটে গেলে সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্রোধের মুখে পড়তে হবে। আজ ইউক্রেনকেও সে রকম বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে হবে।
তাইওয়ানের ক্ষেত্রেও বিষয়টা একই রকম। ‘এক চীন নীতি’ অনুসরণ করে তাইওয়ানের অধিকার রয়েছে নিজ ভূখণ্ডে শান্তি ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। রিচার্ড নিক্সন ও মাও সে–তুংয়ের আমলে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে সম্পর্কের যে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছিল, এর মূলে ছিল এই এক চীন নীতি। তাইওয়ানের বিরুদ্ধে যদি একতরফা কোনো সামরিক অভিযান চালায় চীন এবং তাতে করে বৈশ্বিক নিরাপত্তা ও অর্থনীতির ওপর হুমকি তৈরি হয়, যুক্তরাষ্ট্রেরও অধিকার আছে চীনকে বারণ করার।
২০১৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর ডোনাল্ড ট্রাম্প বলছিলেন, ‘আমি এক চীন নীতি খুব ভালো করেই বুঝতে পারছি। কিন্তু ঠিক এটা বুঝতে পারছি না, চীনের সঙ্গে বাণিজ্যসহ অন্যান্য বিষয়ে চুক্তি করার আগে কেন এই নীতি মানতে আমরা বাধ্য।’
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাইওয়ানের কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা স্বাধীনতা ঘোষণার ছল খুঁজছেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিকেরা ‘এক চীন’ নীতি থেকে বেরিয়ে আসার কথা বলছেন। ২০১৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর ডোনাল্ড ট্রাম্প বলছিলেন, ‘আমি এক চীন নীতি খুব ভালো করেই বুঝতে পারছি। কিন্তু ঠিক এটা বুঝতে পারছি না, চীনের সঙ্গে বাণিজ্যসহ অন্যান্য বিষয়ে চুক্তি করার আগে কেন এই নীতি মানতে আমরা বাধ্য।’ এ মাসে যে গণতন্ত্র সম্মেলন ডেকেছিলেন জো বাইডেন, তাতে খুব উদ্দেশ্যমূলকভাবে তাইওয়ানকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের পদক্ষেপ চীনের সঙ্গে উত্তেজনা অনেক গুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে।
ইউক্রেন ও তাইওয়ান সংকটের শান্তিপূর্ণ ও সোজাসাপটা সমাধান সম্ভব। ইউক্রেনের সদস্যপদ দেওয়ার প্রক্রিয়া ন্যাটোকে স্থগিত রাখতে হবে। যেকোনো ধরনের আগ্রাসী সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হবে রাশিয়াকে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নীতির আলোকে ইউক্রেনকে মুক্তভাবে বাণিজ্য করার সুযোগ দিতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রকে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে যে তারা তাইওয়ানের বিচ্ছিন্ন হওয়ার বিরোধিতা করছে। অন্যদিকে চীনকে ঘোষণা দিতে হবে যে তারা একতরফা সামরিক অভিযানে যাবে না এবং দুই ধরনের ব্যবস্থার নীতি থেকে সরে আসবে না।
বৈশ্বিক কোনো শান্তিই স্থিতিশীল হবে না যদি সেই উদ্যোগের সঙ্গে সম্পৃক্ত পক্ষগুলো একে অন্যের বৈধ নিরাপত্তার স্বার্থের প্রতি সম্মান না দেখায়।
ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
জেফরি ডি স্যাক্স কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের টেকসই উন্নয়নকেন্দ্রের পরিচালক