আজ ৭ এপ্রিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস। একবার আমার পোস্ট ডক্টরাল জাপানিজ সুপারভাইজারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘তুমি কি জানো আজ একটা বিশেষ দিন।’ ‘আমার জন্মদিন নয়, এটা জানি, ভ্যালেন্টাইনস দিবসও নয়!’ অধ্যাপকের সহাস্য প্রত্যুত্তর। ‘বলো তো ব্যাপারটা কী, আজ কিসের দিন?’ আমি বললাম, ‘আজ বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস। তুমি স্বাস্থ্য অনুষদের ডিন, তুমি এটা জানো না কেন?’ তিনি কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর বললেন, ‘দেখো আমার যতটুকু জানার দরকার, তা আমি জানি! বরং তুমি যতটুকু জানো না, সেটি এখন জেনে নাও। এ ধরনের দিবসগুলো সমস্যাসংকুল, অনুন্নত, স্বল্পোন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য প্রযোজ্য; আমাদের জন্য নয়।’
তিনি আরও বললেন, ‘আমি তো স্বাস্থ্যসংক্রান্ত কোনো সমস্যা আমার দেশে দেখি না। জাতিসংঘ কিংবা এর অঙ্গসংগঠনগুলো থেকে ঘোষিত দিবসগুলো ও বিভিন্ন লক্ষ্যমাত্রা, এখন তোমাদের মতো কিছু দেশের জন্য সামনে এগিয়ে যাওয়ার মাপকাঠি, আমাদের জন্য নয়। আরে, আমাদের ছাত্ররা তো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্টের (উপাচার্য) নামই ঠিকমতো বলতে পারবে না। আমাদের দরকার ভালোবাসা, তাই আমরা ভালোবাসা দিবস পালন করি। হা-হা-হা!’
আসলেই কি তা-ই? একেকটি দিবস আসে আর যায়, তাৎপর্যসহকারে আমরা ঘটা করে পালন করি, কিন্তু থেকে যাই ঠিক আগের মতোই। কবে বলতে পারব যে এসব দিবসের আমাদের আর দরকার নেই।
একটা প্রশ্ন এখন আমাকে প্রায়ই শুনতে হয় যে করোনাকাল কি শেষ হয়ে গেছে! এর উত্তর ‘হ্যাঁ’ কিংবা ‘না’-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) করোনার নতুন নতুন ধরনের খবর দিয়ে যাচ্ছে, যা আগের ধরনগুলোর চেয়ে বেশি সংক্রামক; যা প্রমাণ করে ভাইরাসটি প্রতিনিয়ত বিবর্তনের মাধ্যমে শক্তি সঞ্চয় করছে। নতুন রূপে ভবিষ্যতে আবার হয়তো তার আবির্ভাব ঘটবে; অর্থাৎ করোনাকাল এখনো শেষ হয়নি কিংবা স্থানিক সংক্রামক ভাইরাসে পরিবর্তিত হয়নি।
অন্যদিকে করোনার সংক্রমণে ধারাবাহিক মৃত্যুহীন দিন কাটাচ্ছে বাংলাদেশ। শনাক্তের হার ১ কিংবা এর সামান্য ওপরে-নিচে; অর্থাৎ করোনার দিন শেষ। প্রিন্টিং মিডিয়ায় গত দুই বছরে গড়ে শতকরা ৩০ ভাগ খবর দখল করে রাখত এই ভাইরাস, যা গত দুই মাসে শতকরা ৩ (টিকার খবরসহ) ভাগও নয়। কমে যাচ্ছে ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় করোনার টক শোসহ অন্য অনুষ্ঠানগুলো। এর অর্থ, করোনায় এখন আর উৎকণ্ঠার কারণ নেই। বিষয়গুলো করোনা আছে কী নেই, সেই বিতর্ক শেষ করে না; বরং আমাদের একটি শূন্যতার মধ্যে ফেলে দেয়। করোনার সংক্রমণ প্রতিকার ও প্রতিরোধের এখন পর্যন্ত একমাত্র কার্যকর উপায় স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ ও টিকা গ্রহণ; যা নির্ভর করছে আমাদের অভ্যাসগত পরিবর্তন, আমাদের চাওয়া কিংবা না চাওয়ার ওপর।
চাওয়া না চাওয়ার বিষয়টি আরেকটু পরিষ্কার করা যাক। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সব অফিস-আদালত এখন সশরীর চলছে। সরেজমিনে পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, ছাত্র-ছাত্রী এবং অন্যান্য পেশাজীবী শুরুতে কিছুটা স্বাস্থ্যবিধি মানলেও এখন তা মোটামুটি শূন্যের কোঠায়। ব্যক্তি পর্যায়ে স্বাস্থ্যবিধির স্ব-স্ব স্টাইল শুরু হয়েছে, যা এখন অভ্যাসে পরিণত হচ্ছে। হাজারো মন্দের মধ্যে করোনা কিন্তু একটা সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছিল। বাঙালির চিরায়ত স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত দৈনন্দিন অভ্যাসগুলো গত দুই বছরে রীতিমতো পাল্টে গিয়েছিল। এই অভ্যাসগুলো ধরে রাখার হার সময়ের সঙ্গে কীভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে, সে গবেষণা হওয়া উচিত। উন্নতি হয়েছে, নাকি যে তিমিরে ছিল সে তিমিরেই আছে।
করোনা মহামারি বৈশ্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় ১৯৫০-পরবর্তী চিকিৎসাবিপ্লবকেন্দ্রিক আমাদের অর্জিত অহংকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আমি বা আপনি একা একা সুস্থ থাকতে পারব না, সেই বোধ ও বাণী আজ ধনী-গরিব সব দেশ ও মানুষের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। সুস্থ থাকতে হলে সবাইকে একসঙ্গে সুস্থ থাকতে হবে।
বয়সভেদে অভ্যাসগত অভিযোজনের ক্ষমতা ও দক্ষতা রীতিমতো বিস্ময়কর। গবেষণায় দেখা গেছে, পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের অভ্যাসগত অভিযোজনের হার ৭০ ভাগের ওপর, যা ৬ থেকে ১২ বছর বয়সীদের ক্ষেত্রে ৫৫ ভাগের নিচে; ১৩ থেকে ১৮ বছর বয়সীদের ক্ষেত্রে ৩০ ভাগের নিচে এবং ১৯ থেকে ৪০ বছর বয়সীদের ক্ষেত্রে ১৮ ভাগের নিচে। আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, স্বাভাবিক বিকাশ প্রক্রিয়ায় শিশুরা ৭ বছর বয়সে সাধারণ জ্ঞান এবং ম্যাচিউরিটিতে একধরনের পরিপক্বতা অর্জন করে, যাকে ‘বিগ লিপ ফরওয়ার্ড’ বলা হয়। চল্লিশোর্ধ্বদের ক্ষেত্রে অভ্যাসগত অভিযোজনের বিষয়টি বেশ চমকপ্রদ। দেয়ালে পিঠ না ঠেকা পর্যন্ত অভ্যাসগত পরিবর্তন হয় না বললেই চলে। আমরা যত চেষ্টাই করি না কেন, মাস্ক পরাসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মানানো এই অংশের দ্বারা রীতিমতো অসম্ভব। সুতরাং আমাদের একমাত্র ভরসার বয়সীদের বয়স ১-১২ বছর পর্যন্ত, যাদের আমরা শিশু বলি। সম্ভাব্য সব শুভ পরিবর্তনের শুরু এদের মাধ্যমেই সম্ভব। আসুন না, এই প্রজন্মকে টার্গেট করি; শিক্ষাদীক্ষা, কর্মে, আচরণে, নেতৃত্বে ওদের সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে তৈরি করি। বিনিময়ে ওরা উপহার দেবে এক নতুন বাংলাদেশ। যে বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে আমরা বলব, এসব স্বাস্থ্য দিবসটিবস আমাদের জন্য নয়।
এবারের বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়, ‘আমাদের পৃথিবী, আমাদের সুস্থতা!’ করোনাভাইরাস সারা পৃথিবীর স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ভয়ংকরভাবে নাড়া দিয়ে গেছে। বৈশ্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় ১৯৫০-পরবর্তী চিকিৎসাবিপ্লবকেন্দ্রিক আমাদের অর্জিত অহংকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আমি বা আপনি একা একা সুস্থ থাকতে পারব না, সেই বোধ ও বাণী আজ ধনী-গরিব সব দেশ ও মানুষের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। সুস্থ থাকতে হলে সবাইকে একসঙ্গে সুস্থ থাকতে হবে, যাকে আমরা গ্লোবাল হেলথ বলে থাকি। পরিবেশগত কিছু উন্নতি সত্ত্বেও প্রতিবছর আনুমানিক ১০ লাখ অকালমৃত্যুর জন্য পরিবেশগত ঝুঁকিকে দায়ী করা হয় (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা)।
পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবগুলো বৈশ্বিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে সীমাহীন বৈষম্য ও দুর্বল নেতৃত্বকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। বাসযোগ্য শহর, স্বাস্থ্যকর খাবার, বৈশ্বিক সুস্বাস্থ্য, দূষণমুক্ত পরিবেশ, নিরাপদ পানি, স্যানিটেশনসহ একটি বিশ্ব গড়তে প্রয়োজন বৈশ্বিক সম্মিলিত প্রচেষ্টা। এই প্রচেষ্টায় আজ সবাই শামিল। একেকটি দেশের কৌশল একেক রকম। এখন প্রশ্ন হলো, আমাদের কৌশলটি কী? এটি কি নির্ধারিত হয়েছে, নাকি নির্ধারণের কাজ চলছে। এই প্রশ্নের উত্তর জানা না থাকলেও এতটুকু বলা যায় যে অনেক তো হলো, আর কত?
আসুন একটি প্রজন্মকে টার্গেট করি। স্বাস্থ্যগত আচার-আচরণসহ সব বিষয়ে তাদের ভবিষ্যৎ পৃথিবীর জন্য তৈরি করি। তাহলে আর পিছিয়ে থাকবে না প্রিয় মাতৃভূমি। এই প্রজন্মই বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেবে বৈশ্বিক প্রচেষ্টার সঙ্গে তাল মিলিয়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসে এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।
ড. মো. তাজউদ্দিন সিকদার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের সাবেক সভাপতি ও সহযোগী অধ্যাপক। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, পাবলিক হেলথ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ।