সম্প্রতি বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের ‘গোলকিপারস গ্লোবাল গোল চেঞ্জমেকার পুরস্কার-২০২১’ পেয়েছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ফাইরুজ ফাইজা বিথার। ফাইরুজ ‘মনের স্কুল’-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। তরুণদের নেতৃত্বে পরিচালিত এ সংস্থা মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করে। তাদের কাছে প্রশিক্ষণ পাওয়া প্যারা-কাউন্সেলররা তরুণদের প্রাথমিক পরামর্শ দেন এবং প্রয়োজনে মনোরোগ চিকিৎসকের কাছে যেতে পরামর্শ দেন। বাংলাদেশে মানসিক অসুস্থতা মোকাবিলায় নানা ধরনের বাধা আছে। তাই এ ধরনের উদ্যোগ প্রশংসনীয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, স্বাস্থ্য ব্যক্তির শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক—এই তিন অবস্থার একটি সমন্বয়। একজন মানুষের স্বাস্থ্য হলো নীরোগ শরীর; সেই সঙ্গে ভয়, হতাশা, বিষণ্নতা, মানসিক চাপ থেকে মুক্তি এবং সমাজের নানাবিধ চ্যালেঞ্জকে গ্রহণ করতে সক্ষম মন। অর্থাৎ স্বাস্থ্যের অন্যতম উপাদান হলো মনের সুস্থতা। মানুষের চিন্তা, আবেগ ও আচরণ মিলেই মানসিক স্বাস্থ্য। যেকোনো সময়ে একজন ব্যক্তির মানসিক সুস্থতা কেমন হবে, তার পেছনে একাধিক সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক ও জৈবিক কারণ থাকে।
বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ১০ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে (বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো)। সরকার ও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট পরিচালিত ২০১৮ সালের একটি জরিপ অনুযায়ী, ১৮ বছর বা তার বেশি বয়সের মানুষের মধ্যে মানসিক রোগের হার ১৮ দশমিক ৭। বিশ্বে আত্মহত্যা ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ। প্রতিবন্ধিতার প্রধান কারণগুলোর একটি হলো বিষণ্নতা। মানসিক স্বাস্থ্যকে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা বিশ্বব্যাপী উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনে মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্বের স্বীকৃতি। কোভিড-১৯ মহামারি বিভিন্ন দেশে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা বাড়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে।
বাংলাদেশে প্রায় ১৭ কোটি মানুষের জন্য মাত্র ২৭০ জন মনোরোগ চিকিৎসক ও প্রায় ৫০০ জন মনোবিজ্ঞানী রয়েছে। বেশির ভাগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের বাস শহরাঞ্চলে। সরকারি স্বাস্থ্য বাজেটের মাত্র শূন্য দশমিক ৪৪ শতাংশ মানসিক স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ করা হয়। বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে অসংখ্য ভুল ধারণা আছে। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে একধরনের লজ্জা বা কলঙ্ক। গ্রামাঞ্চলে অনেকে রোগ নিরাময়ের জন্য হাতুড়ে ডাক্তারের কাছে যায়। তাঁরা এমন সব ব্যবস্থা নেন, যা রোগীর জন্য ক্ষতিকর, অবমাননাজনক। অনেক ক্ষেত্রে তাদের অধিকারের লঙ্ঘন। গ্রাম ও শহরের বেশির ভাগ মানুষই জানে না যে শরীরের মতো মনেরও রোগ হতে পারে। অন্য যেকোনো অসুখের মতোই মানসিক রোগ হলে চিকিৎসকের সহায়তা নিতে হবে।
অনেকে মানসিক অসুস্থতা বিষয়ে খুব অসংবেদনশীল। হাসি–ঠাট্টা ও সামাজিক আলোচনায় এটি প্রতিফলিত হয়। কেউ কেউ মানসিক রোগীকে ‘পাগল’ ভাবে। অসুস্থ ব্যক্তিকে দোষারোপ করা হয়। কখনো কখনো পুরো পরিবার একজন সদস্যের মানসিক রোগের কারণে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এসব কারণেই সাধারণত মানসিক রোগ লুকানোর বা অস্বীকারের প্রবণতা দেখা যায়। অনেকের মানসিক রোগ নির্ণয়ে খুব বেশি দেরি হয়ে যায়, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে রোগীর জীবনে।
যেকোনো ব্যক্তিকে অসম্ভব সাহস, সংকল্প ও ধৈর্য দিয়ে মানসিক রোগের মুখোমুখি হতে হয়। আমরা পরিবারের সদস্য, বন্ধু ও সহকর্মী হিসেবে এই লড়াইকে শ্রদ্ধা করে তাদের পাশে থাকতে পারি। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণ যেন তাদের জন্য আরেকটি সমস্যা না হয়, তা নিশ্চিত করা আমরা চাইলেই সম্ভব
মানসিক রোগ লুকানোর বা অস্বীকারের প্রবণতা সমাজে কতখানি যে বিস্তৃত হয়েছে, তা একজন মায়ের কথায় স্পষ্ট হলো। ১৫ বছর বয়সী এক কিশোরীর মা বলছিলেন, ‘আমি মেয়েকে বলেছিলাম, আমরা যে তাকে কাউন্সেলিংয়ে নিয়ে যাচ্ছি, তা যেন সে কাউকে না জানায়।’ তিনি সমাজের নিষ্ঠুরতা থেকে সন্তানকে রক্ষার চেষ্টা করছিলেন। বিষণ্নতা বা অন্য মানসিক রোগের কারণে কর্মক্ষেত্রে যেতে না পারলে সাধারণত এ বিষয়কে কারণ হিসেবে ছুটির দরখাস্তে উল্লেখ করেন না কর্মীরা। তাঁদের আশঙ্কা, মানসিক অসুস্থতার কথা জানাজানি হয়ে গেলে সহকর্মীরা বৈষম্যমূলক আচরণ করবেন। বেশির ভাগ মানসিক রোগের কার্যকর চিকিৎসা সম্ভব। দেশের একজন স্বনামধন্য মনোরোগ চিকিৎসকের মন্তব্যে বিদ্যমান অবস্থা বোঝা যায়, ‘আমার ভাবতে খুব খারাপ লাগে, বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষ নিয়ন্ত্রণযোগ্য মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যায় অপ্রয়োজনে দীর্ঘমেয়াদি কষ্ট পাচ্ছে।’
আমাদের চিন্তা করার ক্ষমতা, অন্যদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা, কাজ করাসহ অর্থপূর্ণ জীবনযাপনের জন্য মানসিক সুস্থতা জরুরি। তাই মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষাকে ব্যক্তি, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অগ্রাধিকার দিতে হবে। বাংলাদেশ ২০১৮ সালে ১০৫ বছরের পুরোনো একটি আইন বাতিল করে মানসিক স্বাস্থ্য আইন প্রণয়ন করে। এই আইনের লক্ষ্য মানসিক রোগীদের সম্পত্তির অধিকার রক্ষা এবং মানসিক স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা করা। আইনটির কিছু সীমাবদ্ধতা আছে, তবে মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি মনোযোগ বৃদ্ধিতে এটি সঠিক পদক্ষেপ। ২০২০ সালে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য কৌশলগত পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। তবে যাদের প্রয়োজন, তাদের সবার মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে অনেক দূর যেতে হবে।
সরকারের উচিত মানসিক স্বাস্থ্যসেবাকে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার অংশ করা। মানবসম্পদের ঘাটতি পূরণের জন্য চিকিৎসক ও অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন। মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা ও মানসম্মত মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। মানসিক অসুস্থতা কারও ‘দোষ’ বা ‘ব্যর্থতা’ নয়। আমরা যে কেউ মানসিক রোগে আক্রান্ত হতে পারি। যদি কারও আচরণে পরিবর্তন দেখা যায় এবং তিনি দৈনন্দিন জীবনের কাজগুলো করতে অপারগ হন বা সমস্যা বোধ করেন, তবে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। মানসিক রোগের জন্য কারও ‘লজ্জিত’ হয়ে নীরবে কষ্ট পাওয়ার কারণ নেই।
‘আমি আমার বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডারের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারি, কিন্তু আমার প্রতি আপনার দৃষ্টিভঙ্গির চিকিৎসা করাতে পারব না’—অস্ট্রেলিয়ায় মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে চালানো এক ক্যাম্পেইনের এ বার্তা খুব অর্থবহ। মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা মোকাবিলায় প্রয়োজনে সঠিক মাত্রায় ওষুধ ও কাউন্সেলিংয়ের দরকার। স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন এবং পরিবার ও বন্ধুদের দ্বারা পরিবেষ্টিত একটি সহায়ক পরিবেশ থাকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। যেকোনো ব্যক্তিকে অসম্ভব সাহস, সংকল্প ও ধৈর্য দিয়ে মানসিক রোগের মুখোমুখি হতে হয়। আমরা পরিবারের সদস্য, বন্ধু ও সহকর্মী হিসেবে এই লড়াইকে শ্রদ্ধা করে তাদের পাশে থাকতে পারি। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণ যেন তাদের জন্য আরেকটি সমস্যা না হয়, তা নিশ্চিত করা আমরা চাইলেই সম্ভব।
● লায়লা খন্দকার উন্নয়নকর্মী