আওরঙ্গজেব, ম্যান্ডেলা আর মানিকের গল্পসল্প

আওরঙ্গজেব, দ্য ম্যান অ্যান্ড দ্য মিথ নামে অদ্রে ত্রুস্কের একটি বই মোহাম্মদ হাসান শরীফ আওরঙ্গজেব: ব্যক্তি ও কল্পকথা নামে অনুবাদ করেছেন। সেই বইয়ে একটা বেশ মজার কাহিনি আছে। আওরঙ্গজেবের এক সরকারি কর্মকর্তার নাম ছিল কামগর খান। কামগর খান দ্বিতীয় বিয়ে করেন। ওই সময় আওরঙ্গজেবের রাজ্যে এক কবি ছিলেন। তিনি ব্যঙ্গাত্মক কবিতা লিখতেন। কামগর খানের দুই নম্বর বিয়ের ঘটনার পর সেটাকে ব্যঙ্গবিদ্রূপ করে এই রসিক কবি একটা আদি রসাত্মক কবিতা লেখেন। বোঝা যায়, কবিতাটা জনপ্রিয় হয়েছিল।

অপমানিত বোধ করে কামগর খান যান বাদশাহ আওরঙ্গজেবের কাছে। বলেন, ‘এই কবি আমাকে অপমান করে কবিতা লিখেছে। জাহাঁপনা, আপনি একটা বিহিত করুন।’ জবাবে আওরঙ্গজেব বলেন, ‘আরে, এই কবি তো আমাকে নিয়েও ব্যঙ্গাত্মক কবিতা রচনা করতে ছাড়েনি। তখন আমি কী করেছি, আমি তার পারিশ্রমিক বাড়িয়ে দিয়েছি, যাতে সে আমাকে নিয়ে আর ব্যঙ্গাত্মক কবিতা না লেখে। কিন্তু সে তো আমাকে নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক কবিতা রচনা মোটেও কমিয়ে দেয়নি।’ আওরঙ্গজেব কামগর খানকে উপদেশ দেন, ‘আমাদের উচিত হবে আমাদের সংবেদনশীলতা দমন করা আর সম্প্রীতির সঙ্গে বসবাস করা।’ সোজা কথায়, আমাদের চামড়া আরেকটু মোটা করতে হবে, আর এদের সঙ্গে ঝঞ্ঝাটে না গিয়ে নিজের মতো শান্তিতে বসবাস করতে হবে।

আওরঙ্গজেবের কাণ্ডটা কিংবা রাজনীতিটা আমি একটু বোঝার চেষ্টা করি। এমন যে দোর্দণ্ডপ্রতাপ মোগল সম্রাট, তিনি তাঁর রাজ্যে ব্যঙ্গ কবিতাকে নিরুৎসাহিতও করেননি, নিষিদ্ধও করেননি। এমনকি খোদ বাদশাহকে আক্রমণ করে লেখা ব্যঙ্গ কবিতা রচনাকারী কবিকে তিনি শাস্তি দেননি, নিষেধ করেননি, উল্টো তাঁকে কবিতা রচনার জন্য পারিশ্রমিক দিতেন। বাদশাহর বিরুদ্ধে লেখার পর সেই পারিশ্রমিক তিনি দিলেন বাড়িয়ে। আর বাদশাহর কর্মকর্তা কামগর খানের দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে রসাত্মক কবিতা লিখিত হওয়ার পর বললেন, সংবেদনশীলতা কমাও, শান্তিতে থাকো।

যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট ১৯৮৮ সালে একটি ম্যাগাজিনের বিরুদ্ধে টিভি ধারাভাষ্যকার ও ধর্মীয় নেতা জেরি ফালওয়েলের করা মামলার রায় দেন। ফালওয়েলকে মাতাল বলে উল্লেখ করে বিশাল একটা বোতলের ছবিসহ একটা প্যারোডি বা স্যাটায়ার রচনা প্রকাশ করেছিল অভিযুক্ত পত্রিকাটি। সুপ্রিম কোর্ট রায়ে প্যারোডি বা স্যাটায়ার সংবিধানের প্রথম সংশোধনীর মাধ্যমে কথা বলার স্বাধীনতার গ্যারান্টির সুবিধা পাবে বলে উল্লেখ করেন। ‘স্যাটায়ার, নো ম্যাটার হাউ স্কেইদিং অ্যান্ড আপসেটিং টু ইটস টার্গেট, ওয়াজ প্রটেক্টেড বাই দ্য ফাস্ট অ্যামেন্ডমেন্ট।’

২.

নেলসন ম্যান্ডেলার জীবনী লং ওয়াক টু ফ্রিডম লিখতে সাহায্য করেন টাইম ম্যাগাজিনের সম্পাদক রিচার্ড স্টেঙ্গেল। ওই বই লেখার জন্য রিচার্ড ১৯৯২ সাল থেকে তিন বছর ম্যান্ডেলার সঙ্গে সঙ্গে থাকেন, ঘোরেন, চলেন। সেই তিন বছরের স্মৃতি নিয়ে রিচার্ড আরেকটা বই লিখেছেন—নেলসন ম্যান্ডেলা: পোর্ট্রেট অব অ্যান এক্সট্রা অর্ডিনারি ম্যান। বইয়ের শুরুতে ম্যান্ডেলার ২০০৮ সালের একটা উক্তি আছে। ম্যান্ডেলা বলেন, ‍‘আফ্রিকায় একটা ধারণা আছে, নাম হলো উবুন্তু। আমরা মানুষ, আমরা মানুষ শুধু অন্যদের মানবতার মধ্য দিয়ে। আমরা এই পৃথিবীর জন্য যা কিছু করি না কেন, তা মাপা হবে অন্য সবাই যে কাজ এবং অর্জন করেছে, তা দিয়ে।’

রিচার্ড স্টেঙ্গেল একদিনের একটা ঘটনা লিখেছেন। হিউটনে ম্যান্ডেলার বাড়িতে ছুটির দিনের এক সকাল। উঠানে একটা চালার নিচে গোল হয়ে ফোল্ডিং চেয়ার নিয়ে বসে পরামর্শ করছেন ম্যান্ডেলা আর তাঁর উপদেষ্টারা। রিচার্ড একটা চেয়ার নিয়ে খানিকটা দূরে বসে আছেন। রিচার্ড বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করলেন, এই মানুষগুলো বেশ জোরের সঙ্গে কথা বলছেন, অনেকেই ম্যান্ডেলার সরাসরি সমালোচনা করছেন, স্পষ্ট ভাষায় বলছেন, ম্যান্ডেলা এই এই জায়গায় এই এই ভুল করেছেন। সবাই শ্রদ্ধা করেই কথা বলছেন, তবে কেউ কেউ বেশ রাগী রাগী ভঙ্গিতেই কথা বলছেন। ম্যান্ডেলা বসে আছেন, সোজা, প্রায় নড়াচড়া করছেনই না। মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই। খুব মন দিয়ে প্রতিটি কথা শুনছেন। সবার কথা শেষ হলে ম্যান্ডেলা নিজে মুখ খুললেন। নিজের কথা বললেন না। সবার কথার সংক্ষিপ্তসার তুলে দিলেন। প্রত্যেকেই খুশি যে ম্যান্ডেলা তাঁদের কথা শুনেছেন। মনে রেখেছেন। তাঁদের মনের ভার কমে গেল।

ম্যান্ডেলা জানেন যে একটা তর্ক নিরসন করার অব্যর্থ উপায় হলো বিরুদ্ধমতটা মন দিয়ে শোনা। পরে রিচার্ড তাঁকে এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেন। আপনি তো আপনার মত বললেন না। ম্যান্ডেলা বলেন, ‘এটা হলো গণতন্ত্র।’ ম্যান্ডেলা বলেন, ‘ন্যাশনাল এক্সিকিউটিভ কমিটিতে আমি একটা মত নিয়ে আসি। তারপর ফোরামে আলোচনা ওঠে। আমার মতের বিরোধিতা হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যরা যদি আমার মতের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, তাহলে ওদের মতই পাস হয়। আমি তাদের অবস্থান মেনে নিই, যদি তারা ভুলও হয়! এটাই গণতন্ত্র!’ রিচার্ড লিখেছেন, ম্যান্ডেলা জানেন, তাঁর একার মতের চেয়ে গণতন্ত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতের মূল্য বেশি।

এই হলো উবুন্তু। তুমি একা একা মানুষ নও। সমস্ত মানবতা মিলে তুমি হলে মানুষ। তুমি যা করো, তাতে মানবতার ভাগ আছে। তোমার যা কৃতিত্ব, তোমার যা অর্জন, সেই গৌরবের পেছনেও অন্য মানুষের অবদান আছে।

৩.

‘বড় হওয়ার দায়’ বলে একটা লেখা আছে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের। এতে লেখক তাঁর কিশোরবেলার একটা ঘটনার স্মৃতিচারণা করেছেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাবা তখন টাঙ্গাইলে। মানিক তখন পড়েন ক্লাস সেভেনে। তাঁর ম্যালেরিয়া হয়েছিল, কুইনাইনে ম্যালেরিয়া সেরেছে, কিন্তু কুইনাইন সারছে না, কানে একটানা কুইনাইনের ভোঁ ভোঁ। স্কুলে যাওয়া বন্ধ। সামনে পূজা। মানিক আর ছোট দুই ভাই মিলে বাজি বানানোর উদ্যোগ গ্রহণ করলেন। একটা মোটা বেঁটে শিশিতে বারুদ রেখে তিনজনে উবু হয়ে বসে পটকা বানানোর কাজ চলছে। এর মধ্যে তাঁর এক ছোট ভাই লালু করল কি, একটুখানি বারুদ শিশি থেকে বের করে সেটা জ্বলে কি না পরীক্ষা করার জন্য দেশলাইয়ের কাঠি জ্বেলে বারুদে ধরল। ‘সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড আওয়াজে শিশিটার বিস্ফোরণ এবং ছররা গুলির মতোই টুকরা টুকরা কাচের তিন ভাইয়ের অঙ্গে প্রবেশ। রক্তে বারান্দা ভেসে যাওয়া।’

তিন ভাই সেদিন বেঁচে গিয়েছিলেন, মানিকের মতে, উবু হয়ে বসে থাকার জন্য। তবে প্রত্যেকের শরীরে আট-দশটা করে ফুটো হয়েছিল গভীর। অতিরিক্ত রক্তপাতের জন্য তিনজনেই কাবু হয়েছিল, ছোট ভাইটির অবস্থা হয়ে পড়েছিল শোচনীয়। তার পরের দিন ডাক্তার তাঁদের শরীর থেকে কাচ বের করবেন। মানিককে বললেন, ‘তুমি বড়, প্রথমে তোমায় ধরব। একটা কথা মনে রাখতে হবে, তুমি বারুদ বানিয়েছ, বোকার মতো কাচের শিশিতে বারুদ রেখেছ। তোমার জন্য ছোট ভাই দুটির এত কষ্ট। কাচ বের করার সময় যদি তুমি বেশি চেঁচামেচি, কাঁদাকাটি করো, ওরা দুজন ভয় পেয়ে ভড়কে যাবে। তুমি বড়, ব্যথা পেলেও চেঁচানো চলবে না। বুঝতে পেরেছ।’

তারপর ক্ষতের মধ্যে ডাক্তার শলা ঢুকিয়ে প্রথমে বোঝার চেষ্টা করলেন কাচটা কোথায়, তারপর কাচ বের করার জন্য ছুরি-কাঁচি চালাতে লাগলেন। অনেকক্ষণ ধরে চলল এই অস্ত্রোপচার। অ্যানেসথেসিয়া ছাড়া। ক্লাস সেভেনে পড়া মানিক দাঁতে দাঁত চেপে রইলেন। একটু শব্দ করলেন না। কেন? মানিক বলছেন, ‘ভাই দুটি ভয় পাবে, ভড়কে যাবে জেনে ওই অবস্থায় কেউ চেঁচাতে পারে না।’

৪.

বড় হওয়ার দায় আছে। বড়রা ব্যথা পেলেও ছোটদের মতো চেঁচামেচি-কান্নাকাটি করতে পারবে না। আওরঙ্গজেবের মতো শাসকও ব্যঙ্গ কবিতার কবির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেননি। বরং তিনি কবির পারিশ্রমিক বাড়িয়েছেন। এসব ব্যাপারে চামড়া মোটা করতে বলেছেন। গণতন্ত্রে বিরোধী মত শুনতে হবে। এমনকি কঠোর সমালোচনাও নিতে পারতে হবে।

আমরা একা একা মানুষ হই না। অন্যদের অবদান আমার মধ্যে আছে। আবার আমি যা করি, তাও সমস্ত মানবতারই অংশ। এবং সভ্য সমাজে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ-প্যারোডি করার অধিকার মতপ্রকাশের অমোচনীয় অধিকারের অংশ হিসেবে স্বীকৃত।

আনিসুল হক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক