অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের কোন পথ নেবে বাংলাদেশ

প্রতীকী ছবি

করোনার অভিঘাতে যে মন্দা পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে, তা থেকে পুনরুদ্ধারের অধিকাংশ আলোচনা কত দ্রুত পুনরুদ্ধার করা যাবে, সেই আলোচনায় সীমাবদ্ধ। অর্থাৎ অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে কত সময় লাগবে, সেটাই যেন সবার বিবেচ্য বিষয়। পুনরুদ্ধারের বাঞ্ছনীয় ধরন বা প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে খুবই কম। এখানে দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের বিচার-বিশ্লেষণ প্রয়োজন। প্রথমত, কী পদ্ধতিতে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করা হবে এবং দ্বিতীয়ত, কোন ধরনের পুনরুদ্ধার হবে?

ইতিমধ্যে অনেকেই বিভিন্ন খাতে পুনরুদ্ধারের আঁচ দেখতে পাচ্ছেন। অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে দ্রুত পুনরুদ্ধার হবে বলে তাঁরা মনে করছেন। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু হওয়া—বিশেষত পোশাক খাত এবং প্রবাসী আয়ের ঘুরে দাঁড়ানোর কথা অনেকেই বলছেন। এসবই ইতিবাচক লক্ষণ।

করোনার আগেই অর্থনীতির অনেকগুলো মৌলিক সত্তা ঝুঁকির মধ্যে ছিল। কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি চলছিল। পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, বেকারত্বের হার বেশ ওপরে ছিল (৪ দশমিক ২ শতাংশ)। ১৪ থেকে ২৪ বছর বয়সী যুব বেকারত্বের হার ১২ দশমিক ৩ শতাংশ ছিল। দীর্ঘমেয়াদি বেকারত্বের (এক বছরের বেশি সময় বেকার) হার ছিল ১৫ দশমিক ২ শতাংশ। দারিদ্র্যের হারও কমছিল। পরিসংখ্যান ব্যুরো জানাচ্ছে, ২০০০ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে বছরওয়ারি ১ দশমিক ৮ শতাংশ হারে দারিদ্র্য কমছিল। ২০১০ থেকে ২০১৬ সাল সময়ে এ হার কমে হয়েছে ১ দশমিক ২ শতাংশ। এ ছাড়া অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুসারে, ৭৮ লাখ ২০ হাজারের মতো প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৭৮ লাখ ১০ হাজারই অনানুষ্ঠানিক খাতের। বিগত বছর শেষে প্রধান রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্প খাতে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ২ শতাংশ। আর্থিক খাত খেলাপি ঋণে জর্জরিত ছিল। সিংহভাগই মুষ্টিমেয়ের হাতে। ক্রমাগত পুঁজি পাচার বেড়েছে। পুঁজিবাজারে মাঝেমধ্যেই ধস নেমেছে। বৈষম্য বাড়ছিল।

বৈশ্বিক করোনা মহামারি এই ঝুঁকিগুলোকে কয়েক গুণ বাড়িয়েছে। অর্থনীতির মৌলিক দিকগুলোর বাইরের ধাক্কা সহ্য করার সক্ষমতা যে নড়বড়ে, তা এ অতিমারি জানান দিল। সুতরাং পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে প্রথমত করোনার অভিঘাত কাটিয়ে আগের অবস্থায় ফিরে যেতে হবে এবং দ্বিতীয়ত করোনার আগেই যে দুর্বলতা ও ঝুঁকিগুলো ছিল, সেগুলো কাটাতে হবে। এ থেকে উত্তরণ ঘটাতে হবে।

পুনরুদ্ধারকৌশল

পুনরুদ্ধারের প্রকৃতি সরকারের গৃহীত নীতিকৌশল দ্বারা সাব্যস্ত হবে। সরকার যদি নীতিকৌশলে সক্রিয় প্রতিরোধব্যবস্থা (অ্যাকটিভ রেসট্রেইন্ট) নেয়, তাহলে একধরনের পুনরুদ্ধার হবে আর গতানুগতিক নীতিকৌশল বা সক্রিয় নিষ্ক্রিয়তার (অ্যাকটিভ ইনঅ্যাকশন) কৌশল নিলে আরেক ধরনের পুনরুদ্ধার ঘটবে।

সক্রিয় প্রতিরোধব্যবস্থাকে চার ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমত, জনগণকে সরকারিভাবে গণদ্রব্য বা পাবলিক গুডস প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ। দ্বিতীয়ত, অর্থনীতিতে সম্পদ এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক সুফল ও সুযোগ-সুবিধাগুলোর বণ্টনমূলক ব্যবস্থা নেওয়া। তৃতীয়ত, কর্মসংস্থানমুখী সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতিকাঠামোর ওপর গুরুত্ব দেওয়া। চতুর্থত, অর্থনীতির কাঠামোগত সংস্কারের জন্য নীতিমালা গ্রহণ। এ শর্তগুলো পূরণ হলে সম্পদ ও সুযোগ-সুবিধাগুলো গুটিকয় গোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত না হয়ে সব নাগরিকের কাছে পৌঁছাবে। ফলে গতিপথ বৈষম্যমূলক না হয়ে একটি অপেক্ষাকৃত কম বৈষম্যের সাম্যাবস্থার দিকে ধাবিত হবে। অন্যথায় অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের গতিপথ ক্রমে চরম বৈষম্যমূলক পথে যাবে। সম্পদ উচ্চবিত্ত কিছু গোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত হবে এবং বিপরীতক্রমে দারিদ্র্যের পরিস্থিতি বাড়তে থাকবে।

পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজগুলো মূলত বড় বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বা আনুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত ব্যক্তিদের মধ্যেই বণ্টন করা হয়েছে। অন্যদিকে অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি প্রতিষ্ঠান উল্লেখযোগ্য সুযোগ পায়নি। এই খাতগুলো মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির ৪০ শতাংশ—সবচেয়ে বড় অংশ। দরিদ্র, ঝুঁকিপ্রবণ ও সমাজের পিছিয়ে পড়া বিশাল জনগোষ্ঠী ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না। এ অবস্থা বলবৎ থাকলে দারিদ্র্যের হার বাড়ার মাধ্যমে সমাজে বৈষম্য ও মেরুকরণ বৃদ্ধি পাবে এবং অল্প কিছু মানুষের হাতে সম্পদ ও ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ ঘটবে। শ্রেণিভেদে সামাজিক পার্থক্য ত্বরান্বিত হবে।

বৈষম্যমূলক পুনরুদ্ধারপথের কারণ রাজনৈতিক বন্দোবস্ত, তথা শ্রেণি ও ক্ষমতাকাঠামোর ধরনের মধ্যে নিহিত। গোষ্ঠীতন্ত্র ক্ষমতার কাছাকাছি থেকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে সুযোগ-সুবিধা আদায় করে নেয় এবং আরও সম্পদশালী হয়। অন্যদিকে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বেশি হলেও তারা রাষ্ট্রের নীতিকৌশল নির্ধারণে প্রভাব ফেলতে পারে না। রাষ্ট্র সর্বজনের কথা না ভেবে গোষ্ঠীতন্ত্রের দিকে ঝুঁকলে বৈষম্য বাড়বে।

দারিদ্র্য ও পৃথক্‌করণ

মহামারি সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। যেমন অল্প আয়ের মানুষ, নারী, শিশু, বৃদ্ধ, বেকার, অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মী, নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত। অধিকাংশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাই জানাচ্ছে, দারিদ্র্য বেড়ে দ্বিগুণের বেশি হবে। ১৯৯২ সালের পর এই প্রথম দারিদ্র্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। ‘উন্নয়ন অন্বেষণ’–এর গবেষণা বলছে, আয় কমে যাওয়ায় ৪৩ দশমিক ৫ শতাংশ পরিবার আন্তর্জাতিক দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যেতে পারে। বেকারত্বের হার আরও ৩ শতাংশ বাড়তে পারে। ফলে মানুষের আয় কমে যাবে।

ইতিমধ্যে শিল্প, সেবা, কৃষি—অর্থনীতির প্রকৃত তিনটি খাতেই আয় কমেছে। অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত ব্যক্তিরাই করোনার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। তবে আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক উভয় খাতের শ্রমিকেরই আয় কমেছে। কারণ, অনানুষ্ঠানিক খাতের মতো অনেক আনুষ্ঠানিক খাতেও শ্রমিকের অধিকার রক্ষিত হচ্ছে না। ফলে কোনো রকম সুবিধা ছাড়াই করোনার প্রথম ধাক্কাতে অনেকে চাকরি হারিয়েছেন। ফলে নতুন দরিদ্র তৈরি হচ্ছে। মূলত সর্বজনীন সামাজিক নিরাপত্তার অভাবেই দারিদ্র্যের হার বাড়ছে। অধিকন্তু ঘূর্ণিঝড় আম্পান ও বন্যার কারণেও দারিদ্র্যের হার বাড়তে পারে। বিপুলসংখ্যক প্রবাসী দেশে ফেরত এলে দারিদ্র্যের পরিস্থিতি আরও অবনতির দিকে যেতে পারে।

নীতিকৌশলের বৈষম্যমূলক প্রভাবের কারণে উল্লম্ব দিকে আর করোনার মতো মহামারি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদি অভিঘাতে আনুভূমিক দিকে সামাজিক পার্থক্য বাড়ছে। বৈষম্যগুলো সমাজকে নানা রকম বিভেদমূলক পরিস্থিতির দিকে ধাবিত করছে। পিছিয়ে পড়া, দুর্বল, ঝুঁকিপ্রবণ দরিদ্র জনগোষ্ঠী—যাদের ক্ষমতা নেই, নিজেদের অভাব-অভিযোগ জানানোর মতো কণ্ঠস্বরহীন মানুষ ক্রমে প্রান্তিক হয়ে পড়ছেন।

বৈষম্য ও মেরুকরণ

গত কয়েক দশকে অসমতা অনেক বেড়েছে। সম্পদ ওপরের দিকের কিছু ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। করোনার আগেই ওপরের দিকের ১০ শতাংশ মানুষের আয় নিচের দিকের ৪০ শতাংশ মানুষের আয়ের চেয়ে বেশি ছিল। সক্রিয় প্রতিরোধব্যবস্থা না নিলে করোনার কারণে এর প্রকটতা আরও বাড়বে। বিশেষত মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তদের অনেকে নতুন করে দরিদ্র হয়ে যাওয়ায় সামাজিক বৈষম্য ও মেরুকরণ বাড়বে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, করোনা মহামারির মধ্যেই কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে ৩ হাজার ৪১২ জন। বিপরীতে দারিদ্র্যের হার বাড়ছে। বৈষম্য বাড়ছে এবং মেরুকরণ ত্বরান্বিত হচ্ছে।

করোনার কারণে কিছু কিছু খাতের আয় অনেক গুণ বেড়েছে আর অনেক খাতে আয় বন্ধ হয়ে গেছে। মূলত তথ্যপ্রযুক্তি খাত এবং যারা তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় ব্যবসা বা কাজ করতে পেরেছে, তারাই সবচেয়ে লাভবান হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিলিয়নিয়ারদের সম্পদ গড়ে প্রায় ২৯ শতাংশ বেড়েছে। গতানুগতিক প্রণোদনা-নীতিকৌশল নতুন দরিদ্র ও বেকার সমস্যা সমাধানে লাগসই হচ্ছে না। প্রচলিত রাজস্ব ও আর্থিক প্রণোদনাগুলো অল্প কিছু ক্ষমতাশালী মানুষের উপকারেই লেগেছে।

বাংলাদেশ এখনো যদি অভিঘাত মোকাবিলায় সক্রিয় প্রতিরোধব্যবস্থা গ্রহণ করে, তবে পুনরুদ্ধারের বৈষম্যমূলক গতিপথ এড়ানো সম্ভব। সবার কাছে সরকারের নগদ আর্থিক সহায়তা এবং কর্মসংস্থানমুখী রাজস্ব প্রণোদনাগুলো পৌঁছাতে হবে। কৃষি, কুটির, ক্ষুদ্র, মাঝারি উদ্যোগগুলো প্রণোদনার সুফল না পেলে বৈষম্যমূলক পথ এড়ানো যাবে না। আবার অর্থনীতির মৌলিক সত্তাগুলোর বিদ্যমান ঝুঁকিগুলো থেকে উত্তরণে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও প্রশিক্ষণের গুণগত দক্ষতা অর্জনের বিকল্প নেই। এ জন্য এসব খাতে ব্যাপক কাঠামোগত পরিবর্তনের প্রয়োজন।

ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক এবং উন্নয়ন অন্বেষণের চেয়ারপারসন

[email protected]